দিলারা হাশেম
আমাদের বৈঠকখানায় দেখেছি তারে
এহসান হায়দার
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:২৩
দিলারা হাশেম। ছবি: সংগৃহীত
এক
আমাদের বড় বৈঠকখানা, সে বৈঠকখানাতে ফুফা পাড়ার ছেলে-মেয়েদের পড়াতেন। পাশের গ্রাম থেকে চাচাতো দুই ভাই এসে রাত্রিযাপন করতো পড়ালেখার কারণে, আমার সেজো ফুফাতো ভাই তোতলা ছিল, সেও পড়তো ওদের সঙ্গে। আমি মূলত এখানে পড়ার চেয়ে আড্ডা জমাতাম। কারণ হলো, এই বৈঠকখানাতেই ছিল বাবার ছুটির দিনে গ্রামের রোগী দেখার জায়গা।
এখানে দেয়ালজুড়ে ছিল তিনটা বড় বই রাখার তাক এবং একটা ওষুধ রাখার আলমিরা। বইয়ের তাকজুড়ে তখন থাকতো বাবার মেডিক্যালের কিছু বই, যা ঢাউস সাইজের-আর ছিল রাদুগা প্রকাশনের বই, প্রগতি প্রকাশনের বই। সঙ্গে ছিল একতা পত্রিকা, সন্দেশ পত্রিকা, ধান শালিকের দেশ, সপ্তডিঙা, দেশ পত্রিকা, রহস্য পত্রিকা, তিন গোয়েন্দার বই, দস্যু বনহুর সিরিজের বই, মাসুদ রানা সিরিজ, ফেলুদার বই, সঞ্চিতা, সঞ্চয়িতা, শরৎসাহিত্য সমগ্র, নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব উপন্যাস, যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য, শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বই, সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, হাবিবুর রহমানের বই, সত্যেন সেনের বই, জহির রায়হানের বই, জসীম উদ্দীনের কবিতা ‘রাখালী’, ওয়েস্টার্ন বইপত্রসহ অন্যান্য অনেক ম্যাগাজিন আর উপন্যাস। আমার কাজ ছিল এই সকল বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করা।
রোজই সুযোগ পেলে এই সকল বইয়ের খোঁজখবর করতাম। এভাবেই বইয়ের তাকে পেয়ে যাই একদিন ‘আমলকির মৌ’ বইটি, তখনো পাঠ করে বোঝার জন্য সক্ষম আমি ছিলাম না, বেশ পরে ওটা পড়েছিলাম। এখন আগস্ট মাস শেষ হয়ে এসেছে, শরতের আকাশে চিলতে চিলতে মেঘ, তুলোর মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, জন্মদিন ‘আমলকির মৌ’-এর, দিলারা হাশেম, আমাদের বৈঠকখানায় দেখেছি তারে! তিনি এমন একজন
কথাসাহিত্যিক যতটা মনে পড়ছে হই-হুল্লোড় থেকে দূরে নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করেছেন, নিজের লেখার প্রতি যার আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে কেবল তিনি এমনটা করতে পারেন। আমাদের আড্ডায় আবুল হাসান-সুরাইয়া খানম নিয়ে কথা উঠলেই এক বড় ভাই বলতেন, ‘দুই নারীকে দেখে ভয় পেয়েছি, কথা বলতে পারিনি। তাদের একজন দিলারা হাশেম, অন্যজন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক।’ আমরা বলতাম কেন? কারণ তিনি হলেন-রূপবতী, গুণবতী, শিক্ষিতা, লেখক, চাকরিজীবী এবং বাগ্মী। এতকিছুর বৈশিষ্ট্যের নারীরা ধারে কাটে ভারে কাটে। ফলে এ নিয়ে আর কথা হতো না তখন।
দুই
১৯৩৬ সালের ২১ আগস্ট যশোরে দিলারা হাশেম জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে ইংরেজিতে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষে তিনি যোগ দেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে। সেখানেই একজন ব্রডকাস্টার হিসেবে তার কর্মজীবনের শুরু, পাঠ করতেন বাংলা সংবাদ। এরপর তিনি ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ করেছেন। একসময় পাড়ি জমান আমেরিকায়, যোগ দেন ভয়েস অব আমেরিকায়। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কাজ করেন, ২০১১ সালে অবসর নেন। এরপর বসবাস করছিলেন আমেরিকাতে। তিনি ছিলেন তার সময়ের অন্যতম লেখক। নারী লেখক শব্দবন্ধটিকে এড়িয়ে যেতে চাই আমরা সর্বদা, অন্তত যারা লেখকের সঠিক মূল্যায়ণ করতে চাই তাদের এটা করা প্রয়োজন। কারণ তার লেখার মধ্যে পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার ছিল না। লেখার সাবলীলতা পাঠককে তার বইয়ে আটকে রাখতো। সেই জন্য তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। ‘আমলকির মৌ’, ‘ঘর মন জানালা’, ‘একদা এবং অনন্ত’, ‘শঙ্খ করাত’, ‘সদর অন্দর’, ‘কাকতালীয়’, ‘স্তব্ধতার কানে কানে’-এর মতো অসামান্য সব উপন্যাসের জন্ম হয়েছে তার হাতে। অথচ এ দেশের কজন পাঠক তাকে স্মরণ করে, তার লেখা পাঠ করে-সেই সংখ্যা আমার জানা নাই। বাজারে খোঁজ করে তার লেখা উপন্যাসগুলোর হদিসও পাওয়া যায় না ঠিকঠাক মতো। তার লেখার মধ্যে যে সৌন্দর্য, আকর্ষণীয়, চিন্তাকর্ষক এবং কাহিনির হৃদয়গ্রাহী বর্ণনাভঙ্গি তা সত্যিকারে একালে মেলা ভার। একালে যে নারীকে পণ্য করে তোলার ব্যাপার দেখা যায়, দিলারা তার উপন্যাসে এই বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে নারীর মানসপট এঁকেছেন। সামাজিক বাস্তবতা, প্রেম-কলহ, মানুষের সামাজিক দ্বন্দ্ব, সংগ্রামী জীবনসহ নানান আখ্যানকে তুলে ধরেছেন তার রচনায়। তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বলেছিলেন, ‘এতদিন যা করতে পারেননি এবার সেদিকে মন দেবেন।’ অর্থাৎ অনেক কিছু করতে না পারার বেদনাবোধ তার মধ্যে ছিল। সেগুলো শেষ করতে পেরেছেন কি শেষাবধি, তা আমাদের জানা নেই। তবু বাংলাসাহিত্যকে তিনি অনেক দিয়েছেন, থেকেছেন দূর দেশ আমেরিকায়। তবু পাঠকের হৃদয়ে তিনি পাকাপাকি আসন করে নিয়েছেন ওই সুদূর থেকে, এখন তার সৃষ্টির সঠিক মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। মানুষ হারিয়ে গেলে থাকে তার সৃষ্টি, যা থেকে নতুন প্রজন্মের শেখার রয়েছে অনেক বেশি, বিশেষ করে তিনি যখন লেখক এবং সফল মানুষ।
