
প্রচ্ছদ : সংগৃহীত
প্রকৃত নাম মলি খাতুন হলেও মলিবু নামে সে পরিচিত। সবাই মলিবু মলিবু বলে ডাকে। মলির বিরুক্তবোধ নাই। মলি কিছু টোটকা শিখেছিল তার দাদির কাছ থেকে। তিনি মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। সেই দাদির গোপন খুঁতি এখন মলির নিকটে। খুতি ঘেঁটে ঘেঁটে যা শিখেছিলেন আর কি। তাই টিনেজাররা বেশি ভেড়ে মলির কাছে। সেদিন সকালে নাসরিন নামে ম্যাট্রিক পাসের এক ছাত্রী গ্রামে এসে জিজ্ঞেস করে মলিবুর বাড়ি যাব। একজন ইঙ্গিত করে বলল, ‘ওই তো মলির বাড়ি। বেড়ার খুপরিটা… নাসরিন দরজায় ‘মলিবু’ ডাক দিলে মলি এসে দরজা খুলে নাসরিনকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় এবং তার খাস কামরায় নিয়ে যায়। মলি খাতুন আর নাসরিন কী সব গল্প সেরে নাসরিনকে দরজা পার করে দেয়। নাসরিন জামায় কী সব গুঁজতে গুঁজতে বের হয়ে চলে গেল। এভাবে দিনে চার পাঁচজন তো আসেই।
প্রেমে ব্যর্থদের জন্য মলিবু
খুব সুবিধার। পঞ্চাশ থেকে দুই তিনশ টাকা হলেই বেশ টোটকা ও ঝাড়ফুঁক হয়। কেউ স্কুলে যাবার সময় ঢোকে। কেউ আবার স্কুল ছুটি
হলে ঢোকে। দরজায় মলিবু ডাকলেই খুলে দেয়। সিক্স
থেকে শুরু করে নাইন টেনের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব প্রিয় মানুষ হয়ে উঠছে মলিবু।
অল্প খরচে মনের মানুষকে কাছে পাওয়া এ এক বিশাল ব্যাপার। টোটকা যে সবার ঠিকঠাক হয়, তাও
নয়। তবু দরজায় ভিড় কমে না।
পাশের বাড়ির পাঞ্চাশোর্ধ্ব এলিজা খাতুন এসে মলির কানে কানে কী বলল আর মলি ভেতর থেকে একটা কাচের গ্লাসে পানি এনে এলিজার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল। এরপর চোখের কাছে তিনটা ফুঁ দিয়ে বলল, ‘যা বুড়ি, এবার যা দেখসিনে।’ পাঁচ দিন পর মলি এলিজার বাড়িতে বেড়াতে যায়। দেখে পঞ্চাশোর্র্ধ্ব সেই এলিজার সাথে তার বুড়ো স্বামীটা ধরা গলায় গান ধরেছে। কী আনন্দ আহ্লাদ দুজনের। অথচ কয়েক দিন আগে দুজনের সে কী গণ্ডগোল। এলিজা এসে মলিকে কানে কানে বলে, ‘বুড়ো এখন আঁচল ছাড়ে না রে।’ মলি মুচকি হাসে।
আজ সকালে স্কুলে যাবার পথে
নাইম নামের ক্লাস এইটের এক ছাত্র মলির বাড়িতে ঢোকে। তাকে চোখে সুরমা পড়া দিয়ে বলে,
‘যাও হয়ে যাবে।’ নাইম চোখে সেই পড়া সুরমা দিয়ে স্কুলে আসে। আধা ঘণ্টার মধ্যে তাকে ঘৃণা
করে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী বিলকিস দূর থেকে মুচকি হেসে চলে গেল। নাইমের সে কী আনন্দ।
বিলকিস তাকে দেখে হেসেছে। এবার বুঝি প্রেমটা
হয়েই যাবে। মলি খাতুনের পরিচিতি এভাবে গোপনে প্রকাশ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ দিন পর নাইম মলির ভাঙা
খুপরিতে আসে তাকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে একসন্ধ্যা ভালো-মন্দ খাওয়াবে।
ক্লাস শেষে নাইম মলির দরজায় এসে ডাকে, ‘মলিবু আছেন?’ মলি আসে দরজায়।
-কী খবর নাইম?
-আমি আপনাকে দাওয়াত দিতে চাই।
কাল দুপুরে আমার বাড়িতে আসবেন?
-তাই নাকি নাইম। তোমার ও দিকের
কী খবর?
-আজকে আমাকে দেখে হেসেছে। আগে
তাকাতই না
-হা হা হা সব হবে...আমি যাব
তোমাদের বাড়িতে, যাও।
নাইম মলির বাড়ি থেকে হাসতে
হাসতে বাড়ির দিকে পথ ধরে। রাস্তার দুই পাশে কাশফুলের সাদা সাদা। একটু দূরে যেতেই পথে
বিলকিসের সাথে দেখা। কাশফুলের ওঁৎ থেকে খিল খিল করে হেসে ওঠে। নাইম অবাক হয়ে বলে,
‘আই লাভ ইউ।’ বিলকিস মুচকি হেসে ‘ঠু’ বলে অন্য রাস্তা ধরে চলে গেল। নাইম মনে ভাবে পঞ্চাশ
টাকার সুরমা পরার রেজাল্ট ভালো হওয়া চাই।
পরের দিন দুপুরে মলি নাইমদের
ছাদওয়ালা বাড়িতে আসে। গ্রামেও ইদানীং মানুষ টাকা খরচ করে বিল্ডিং করছে। কিন্তু মলিদের
বেড়ার খুপরির কোনো উন্নতি নাই। ভাবছে মলি। নাইম ওর মাকে ডেকে নিয়ে মলির সাথে পরিচয়
করে দেয়।
-আম্মু এই হলো মলিবু, খুব ভালো।
-ও, নাম শুনেছি তোমার। বলে
নাইমের মা ভাতের জোগাড় করতে যায় বারান্দায়। এর মধ্যে নাইমের বাবা অফিস থেকে এসে বাসায়
ঢোকে। প্রতিদিন দুপুরে লাঞ্চ সারে বাসায়। জিন্ম প্যান্ট, ব্লেজার, টাই, বুট পরা। মলি
ওর বাবার দিকে নজর পড়তেই চমকে ওঠে। নাইমের মাকে শুধু ‘খালাম্মা আসি আজ’ বলে দরজা পার
হয়ে চলে গেল মলি। নাইম আর ও মা কোনো মানে খুঁজে পেল না। না খেয়ে এভাবে হুটহাট চলে গেল। তবে নাইমের বাবা চন্দন চৌধুরী চলে যাওয়ার মানে
ঠিকই বুঝেছেন।
মলি বাড়িতে এসে গরিবি ময়লাযুক্ত
কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। আজ ওর জন্যে আমার এ অবস্থা। বিয়েও করিনি ওকে ওকে করে। বয়স কী
বসে আছে। চল্লিশ পার পার। এমন নানানি-বিনানি চিন্তা আর স্মৃতি মলির চোখে ভেসে উঠতে থাকে। মলির শরীর যখন টান টান ছিল,গায়ের
রং ছিল গাঢ় হলদেটে; কিন্তু চন্দনের দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মলি মেনে নিতে পারেনি
বলেই কোনো দিন বিয়ের কথা ভাবেনি। এ জীবন গোল্লায় যাক। চন্দন বিয়ে করেছে, আলিশান বাড়ি
গাড়ি। তার এত উন্নতি মলি এর আগে দেখেনি। মলি কাঁথা জড়িয়ে কাঁদছে। ভাবছে চন্দনকে সেও
সুখে থাকতে দেবে না। চন্দন কীভাবে সুখে থাকে সেটাই দেখবে। মনে ভাবতে ভাবতে মলি দীর্ঘশ্বাস
ছেড়ে উঠে তার সকল শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে কাজে বসে। আসন বায়। ঘরে মোমবাতি জ্বালায়। হাড়হাড্ডি,
জরিবুটি, তাবিজের রঙিন কাগজ, জাফরান। আরও কত কী। এবার ওর সংসার ভেঙে দম। মলি তার সর্বস্ব
খাটিয়ে তার টোটকা প্রয়োগ করতে থাকে। এতদিন মানুষের জন্য কাজ করেছে। আজ নিজের জন্যে।
এভাবে একুশ দিনের একটা কাজ হাতে নেয়। কাজ না হয়ে যাবে কৈ। মলি তার কাজ চালিয়ে যায় আর
গোপন সোর্সের মাধ্যমে চন্দনের খোঁজ নেয়। প্রতি রাতে রাত জেগে জেগে ঝাড়ফুঁক, কাগজ পোড়ানোর কাজ সারে আর চন্দনের খোঁজ নেয় কোনো ঝগড়াটগড়া
শুরু হচ্ছে কি-না। এ রকম উনিশ বিশ দিন চলে যায়; কিন্তু ওদের ঝগড়াটগড়ার কোনো খবর পায়
না। বাইশ দিন পার হয়ে যায়। এই টোটকায় কোনো
কাজ হলো না। এবার একচল্লিশ দিনের আরেকটি আসনে বসে। এটা আরও কঠিনতর সাধনার কাজ। কাফনের
কাপড়, সাত কবরের মাটি, শ্মশানঘাটের হাড় ইত্যাদি জোগাড় করে নতুন করে কাজ শুরু করে। এটাতেও
চল্লিশ দিন পার হয়ে যায় যায়। চন্দনের পরিবারের কোনো ঝগড়া, ক্যাচালের লক্ষণ নাই। মলির
মাথা ধরে যায়। চিন্তায় পড়ে। তার সকল শিক্ষা ব্যর্থ হয়ে যাবে এটা কেমন কথা। কত ইঁচড়ে
ছেলে-মেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় করে দিয়েছে তার গুনতি
নেই। অথচ নিজের ক্ষেত্রে কাজ হচ্ছে না। মলির ভেতর হতাশা বেড়ে যায়। আর চন্দনের টাই বুট পরা চেহারা চোখের
সামনে ভাসতে থাকে। কোনো একদিন স্কুলের পিছনে গিয়ে তার হাত ধরেছিল আলতো করে এটাও মনে
পড়ে যাচ্ছে। নিজের অধঃপতন, চন্দনের জীবনের সীমাহীন উন্নতি।
এর দশ দিন পর সকালে ওর বৃদ্ধ
বাবা কিসমত আলী হুক্কুর হুক্কুর করে কাশতে কাশতে মলির ঘরে যায়। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হচ্ছে দেখে মলির ঘরে ঢুকে আঁতকে
ওঠে। দেখে গলায় মোটা দড়ি পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। কিসমত আলী চিৎকার দিয়ে ওখানেই
পড়ে যায়। অ্যাজমা ধরা মানুষ। একটু পর কিসমত আলীও কাশতে কাশতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে বুক
চাপড়াতে চাপড়াতে মারা যায়। কিসমত আলীর চিৎকারে আশপাশের মানুষ আসে। এলাকায় শোর পড়ে যায়
মলিবু মরে গেছে।