বাস স্টপে দেখা হল তিন মিনিট : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এস ডি সুব্রত
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৩

কবি ও ঔপ্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল ছবি
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি/ ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল/ শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে/ তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী/ আর এলোনা/ পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি। ( কেউ কথা রাখেনি-- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সাবেক পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায় মাইজপাড়া গ্রামে। পিতা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার টাউন স্কুলের শিক্ষক। সেই সূত্রে ১৯৩৮ সাল থেকেই উত্তর কলকাতায় বসবাস শুরু। চার ভাইবোনের মধ্যে সুনীলই বড়। সংসারে অনটন ছিলই সেটা আরও বাড়ল দেশভাগের পর বিশাল পরিবারে তখন কালীপদর রোজগারই ভরসা। ফলে পিতার সঙ্গে সুনীলের তেমন যোগাযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। সুনীলকে বই পড়ার নেশাটি ধরিয়েছিলেন মা মীরা দেবী। দাম্পত্য সঙ্গী স্বাতী বন্দোপাধ্যায়। সন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়। মাত্র চার বছর বয়সে কলকাতায় চলে যান।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশ শতএকজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বাংলাভাষী এই ভারতীয় সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অনেক মূল্যবান লেখা উপহার দিয়েছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তার পিতার ভূমিকাই বেশি ছিল। সুনীল তখন টাউন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। ছুটির ক ’মাসে ছেলে যাতে বিপথে না যায় , পিতা আদেশ করলেন সময়টা ইংরেজি চর্চার কাজে লাগাতে হবে। টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করে দেখাতে হবে। কিছু দিন চলল সুনীল লক্ষ্য করলেন, ইদানীং তাঁর পিতা আর অনুবাদ আক্ষরিক কি না , মিলিয়ে দেখছেন না। তখন নিজেই লিখতে শুরু করলেন কিছু লাইন আর সেগুলোই দেখতে দিলেন পিতাকে। এই ভাবেই কবিতায় হাত অভ্যাস করা শুরু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরে লিখেছেন , “আমার সৌভাগ্য এই, আমার প্রথম বয়েস থেকেই আমি কোনও সাহিত্যিক গোষ্ঠীর পাল্লায় পড়িনি । আমি পূর্ববঙ্গের গণ্ডগ্রাম থেকে আগত কিশোর, কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কোনও লেখককে চোখে দেখিনি, কোনও সম্পাদককে চিনতাম না।” ডাকযোগে লেখা পাঠানো ছাড়া অন্য উপায় তার জানা ছিল না।
১৯৫৩ সাল থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন এবং ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী, হঠাৎ নীরার জন্য, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি।
সিগনেট প্রেস তথা দিলীপকুমার গুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ হলে দিলীপকুমারের পরামর্শ এবং সহায়তায় ‘কৃত্তিবাসে’র পথ চলা শুরু কলকাতার রাজনৈতিক আবহ তখন উত্তাল। প্রথম সম্পাদকীয়তে সুনীল লিখলেন , “বিভিন্ন তরুণদের বিক্ষিপ্ত কাব্য প্রচেষ্টাকে সংহত করলে – বাংলা কবিতায় প্রাণছন্দের উত্তাপ নতুন আবেগে এবং বলিষ্ঠতায় লাগতে পারে এবং সকলের মধ্যে প্রত্যেকের কন্ঠস্বরকেই আলাদা করে চেনা যেতে পারে।” তখন এক মলাটে সুনীলদের সঙ্গে লিখতে লাগলেন সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরা। এরপর যোগ হল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। তারপর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে গিয়েছে এঁদেরই লেখনীতে। সুনীল ও শক্তির এক একটা পংক্তি বাঙালির কাছে প্রবাদে পরিণত হয়েছিল তখন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন ’ প্রকাশ পায় ১৯৫৮ সালে। ১৯৬২ সালে কলকাতায় এলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ। সুনীলের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠল তার। পরের বছরই আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গেলের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দিলেন সুনীল। নিউ ইয়র্কে সালভাদর দালির সঙ্গে পরিচয় হল তখনই। ফেরার পথে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়টের সঙ্গে পরিচয়। ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে প্যারিস ভ্রমণ। তারপর একা একাই সুইজারল্যান্ড , রোম , কায়রো হয়ে দমদম বিমানবন্দরে নামলেন।
১৯৭০ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তার পরে দেশ – আনন্দবাজার মিলিয়ে একাধিক বিভাগের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। দু’বার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজার সংস্থার ঘরের মানুষ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা দেশ – এ প্রকাশিত হয়, তার প্রথম উপন্যাসও দেশেতেই প্রকাশিত হয়। ‘আত্মপ্রকাশ ’ বেরোয় ১৯৬৬ তারপর একে একে অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী, অর্জুন, জীবন যে রকম। ১৯৭১ সালে সন্তু–কাকাবাবু সিরিজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আশির দশকে হাত দিলেন বৃহৎ উপন্যাসে। জন্ম নিল ‘সেই সময়‘। ক্রমান্বয়ে রচিত হলো পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো। উনিশ থেকে আটাত্তর। এর মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুধু বইয়ের সংখ্যাই আড়াইশোর বেশি। সম্পাদিত গ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, চিত্রনাট্য, শিশুসাহিত্য–এতগুলি শাখায় সাবলীল বিচরণ ছিল বাউন্ডুলেপনা তাঁর কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগণা থেকে প্যারিস, নিউ ইয়র্ক থেকে শান্তিনিকেতন, সুনীলের উৎসাহ সমান। তিনি নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনও দুরাকাঙ্খা তার ছিল না। কলেজজীবনে সুনীলের স্বপ্ন বলতে একটাই, জাহাজের খালাসি হয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া। প্রিয় বই ছিল মহাভারত। সেই মহাভারত লেখাতেই হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ হল না তাঁর স্বপ্নের মহাভারত। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার আনন্দ পুরস্কার (১৯৭২, ১৯৮৯), সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫)। খ্যাতিমান এই লেখক ২৩ অক্টোবর ২০১২ সালে চলে যান না ফেরার দেশে।
বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল/ স্বপ্নে বহুক্ষণ/ দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে / সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন–/ বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে/ তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের/ নীল দুঃসময়ে। (হঠাৎ নীরার জন্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )।