প্রবন্ধ
তারাশঙ্করের ‘কবি’ : নেপথ্যের গল্প

জাকির তালুকদার
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৬

প্রতীকী ছবি
উপন্যাস হিসেবে ‘কবি’ ছাপা হয়েছিল পাটনা থেকে প্রকাশিত ‘প্রভাতী’ পত্রিকায়। মণীন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘প্রভাতী’র ১৩৪৭ সালের চৈত্র সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে এই উপন্যাস। শেষ হয় ১৩৪৮ সালের ফাল্গুন সংখ্যায়।
গ্রন্থাকারে এটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৩৪৮ সালের চৈত্র মাসে। ইংরেজি তারিখ অনুসারে সেটি ছিল ১৯৪২ সালের মার্চ মাস। এই উপন্যাসের আখ্যান-নির্মাণে তারাশঙ্কর তার জীবনের অভিজ্ঞতাকে এতটাই কাজে লাগিয়েছিলেন যে কোনো কোনো সমালোচক ‘কবি’-কে তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
‘কবি’ উপন্যাস তারাশঙ্করের পরিণত বয়সের লেখা। এই উপন্যাসের প্রায় সকল পাত্র-পাত্রীর বাস্তব অস্তিত্বের কথা তারাশঙ্কর নিজেই উল্লেখ করে গেছেন। উপন্যাসের মতোই সুখপাঠ্য এবং মনোযোগের দাবিদার ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ স্মৃতিগ্রন্থে এ-সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণই পাওয়া যায়।
সেখানে তারাশঙ্কর জানাচ্ছেন যে ‘কবি’ উপন্যাসের নিতাই চরিত্রটি যার আদলে গড়া সে তাদেরই গ্রামের সতীশ ডোম। পাগলাটে কবিযশঃপ্রার্থী যুবক। কালো আবলুশের মতো গায়ের রং, অল্প-স্বল্প পড়তে পারে, পথেঘাটে কবিগান গেয়ে বেড়ায়।
পাশের রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে। আর লোকের সঙ্গে কথা বলে সাধুভাষায়। মোট বইবার জন্য বেশি মজুরি চাইলে যাত্রী প্রতিবাদ করে। তার উত্তরে সতীশ ডোম সাধুভাষায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই বলে, ‘প্রভু একবার গগনের পানে অবলোকন করেন, দেনমণির তেজটা দেখেন! আপনি প্রভু পাদুকাপদে ছত্রমস্তকে হাঁটবেন, আমাকে মোটমস্তকে শূন্যপদে গমন করতে হবে।
দুঃখীর দুঃখটা চিন্তা করে দেখে বাক্য বলুন।’
মানুষকে শ্রোতা হিসেবে না পাওয়ায় জনশূন্য আমবাগানে ঘুরে ঘুরে আমগাছগুলিকে কবিগান শোনাচ্ছে সতীশ, এমন দৃশ্যও দেখেছেন তারাশঙ্কর। কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষাতেই সতীশ নিজেদের পারিবারিক চৌর্যবৃত্তি থেকে দূরে থেকেছে।
রেলস্টেশনে কুলিগিরি করেছে। পাঁচ-সাত মাইলের মধ্যে যেখানেই কবিগানের আসর বসত, সেখানেই মাথায় চাদর জড়িয়ে সতীশ উপস্থিত। আসরে সে বসত কবিয়ালের দোহারদের পাশে, তাদের সুরে সুর মিলিয়ে দোয়ারকি করত সুযোগ পেলেই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার এলাকার যে কোনো কবিগানেই সতীশের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।
সে দোয়ারকি করছে, এবং ফাঁক পেলেই মুখ বাড়িয়ে কানে হাত দিয়ে দু-এক কলি গানও গেয়ে ফেলছে। সতীশ জানত যে তারাশঙ্কর নিজেও লেখক।
তাই তার সাথে সে কথা বলত বিনম্র শ্রদ্ধায়। তারাশঙ্করকে দেখলেই হেঁট হয়ে প্রণাম জানিয়ে বলত, প্রণাম প্রভু! তাদের পারস্পরিক কথোকথনের কিছুটা মনোজ্ঞ বিবরণও উপস্থাপন করেছেন তারাশঙ্কর তার ‘আমার সাহিত্য-জীবন’ গ্রন্থে। লেখককে বড় আকারে প্রণাম করা মানেই সতীশের মনে মনে ইচ্ছা লেখক তাকে জিজ্ঞেস করুন, ‘কোথা হতে আগমন, কহ কিবা বিবরণ, রসভাণ্ড উপচায় কেন?’
তারাশঙ্কর সচরাচর এমন ধরনের প্রশ্নই করতেন তাকে। না করলে সতীশ নিজেই আগ বাড়িয়ে বলত, ‘কই, কিছু শুধালেন না যে?
কী শুধোব?
কোথা থেকে আসছি? কী ব্যাপার? এত খুশি ক্যানে?
সে তো বুঝতে পারছি। মেলায় গিয়েছিলে। খুব কবিগান করেছ।
এই! ‘রসিকের কথা রসিকে জানে, বংশী বাজে বৃন্দাবনে!’
খুব গাও না----- বুঝলেন প্রভু, নিদারুণ বেপার। দু-দিকে দুই পেল্লায় কবিয়াল। সে একেবারে কর্ণ-অর্জুনে বাণ-কাটাকাটি। তার মধ্যে আমি, বুঝলেন কিনা, খাণ্ডব অরণ্যের দাহনকালে-----বাঁচা নাগের মতো কর্ণের বাণের মুখে বসে অর্জুনের মুকুট কেটে দিয়েছি। ছিষ্টিধরের মুকুট ধুলোয় পড়ে গিয়েছে।
তারপরেই সে শুরু করত বিস্তারিত বর্ণনা। পথ চলতে চলতেই এগুত বর্ণনা। কিন্তু সেই বর্ণনা শেষ হওয়ার আগেই তারা পৌঁছে যেতেন স্টেশনের চায়ের দোকানে। দোকানদারের নাম কোনোদিন শোনা হয়নি তারাশঙ্করের।
সবাই বলত বেনে-মামার চায়ের দোকান। সেখানে বসে থাকত বাতে প্রায় পঙ্গু দ্বিজপদ। লেখকের বাল্যবন্ধু। সেই দ্বিজপদই ‘কবি’ উপন্যাসের বিপ্রপদ। সে সতীশকেও বলত ‘কপিবর’। মাঝে মাঝে ঘুঁটে ছেঁদা করে একফালি দড়ি পরিয়ে সতীশকে উপহার দিত-----নে, মেডেল।
উপন্যাসের রাজার নাম বাস্তবেও রাজা মিয়া। সে ছিল মুসলমান। তবে সে হিন্দি বলত না। ঠাকুরঝি রাজার শ্যালিকা নয়। সতীশের সঙ্গে বাস্তবে তার প্রেমও হয়নি।
তবে ঠাকুরঝির বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। সে ছিল গ্রামান্তরের রুইদাস সম্প্রদায়ের মেয়ে। দুধ বিক্রি করতে আসত। সতীশও তার কাছ থেকে দুধ কিনত প্রতিদিন এক পোয়া করে। মেয়েটি চলাফেরাতেও যেমন ছিল খুব দ্রুত, আবার কথাও বলত দ্রুতলয়ে হড়বড় করে। সে নিজে তার ঠাকুরঝিকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কথায় কথায় ঠাকুরঝির উল্লেখ করত। যেমন-----ঠাকুরঝি বকবে জি!... ঠাকুরঝিকে না-শুধিয়ে লারব।...
দাঁড়াও বাপু ঠাকুরঝি আসুক।... ওই ঠাকুরঝি আসছে, লাও বাপু শিগগির দুধ লিয়ে লাও; ঠাকুরঝি বকবে। সেই মেয়ে বারবার ঠাকুরঝির উল্লেখ করত বলেই উপন্যাসে তার আসল নাম ঢেকে গিয়ে সে-ই পরিণত হয়েছে ঠাকুরঝি-তে।
এই কয়েকটি চরিত্র নিয়েই প্রথমে ‘কবি’ গল্পটি লিখেছিলেন তারাশঙ্কর। পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে রূপ দেবার সময় যোগ হলো ঝুমুর নাচের দল। ঝুমুরদল নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছিলেন পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন।
তার কাছ থেকেই তারাশঙ্কর জেনেছিলেন যে, ‘ঝুমুরদল অনেক স্থানেই আছে। কিন্তু বীরভূমের মল্লারপুরের ঝুমুরদল সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। এখানে এরা বংশানুক্রমিকভাবে বাস করছে।
ঝুমুরদলের মেয়ে ঝুমুরদলে নাচে-----তার মেয়ে, তার মেয়ে নেচে আসছে। গেয়ে আসছে। এরা পদাবলি জানে, খেউড় জানে। আবার আধুনিক খেমটা-টপ্পাও জানে। মল্লারপুরে ঝুমুরদলের একটা পাড়াই আছে। আজকাল হয়তো লুপ্ত হয়ে গেল বা গেছে।
পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্ন আবিষ্কার করেছেন, এককালে, মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গে তখন বৈষ্ণবধর্ম ও কীর্তনের সমাদর বেশি, সেইকালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু কীর্তনিয়ার দল ছোটবড় ভালোমন্দ নির্বিশেষে ওই অঞ্চলে যেত এবং যথেষ্ট উপার্জন করে দেশে ফিরত।
ওই ছোট বড়দের মধ্যে ছোটরা শেষ প্রসার ও সমাদরের জন্য দলের মধ্যে গায়িকা গ্রহণ করে। ক্রমে গায়িকারাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তার থেকে ক্রমে নাচ, তারপর আদি রসাশ্রিত গানের প্রচলন হয়। তারপর হিন্দু-মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের জন্য ধর্ম বাদ দিয়ে নিছক নাচ-গানের দলের পরিণতিতে পৌঁছাল।
ফোঁটা-তিলক-মালা ফেলে কেশবিন্যাস হলো স্বৈরিণীর উপযোগী, গায়ে উঠল পিতলের গহনা-----চুড়ি-বালা-বাওটা-বাজুবন্ধ-চিক হার, কানে কানপাশা, কপালে ঝাপটা।
পায়ের নূপুর ঘুচে উঠল ঘুঙুর। তবুও আজও এরা গৌরচন্দ্রিকা অর্থাৎ মহাপ্রভুর বন্দনা না করে গান শুরু করে না।’
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়দের গ্রামে ছোটদের ঝুমুর দেখা নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে তারাশঙ্কর ঝুমুর নাচ দেখেছেন। ভদ্রজনের আসরে সেটি আসলে ছিল খেমটা নাচের অনুকরণ।
আর যেসব আসরে ভদ্রজনরা যান না, সেখানে এটি পুরোপুরি অশ্লীল দেহনাচানো উৎসব। আর ঝুমুরদলের আবরণের আড়ালে চলে দেহব্যবসা। ‘কবি’ উপন্যাসের বসন বা বসন্তকে এমন একটি ঝুমুরদলের সঙ্গেই দেখেছিলেন তারাশঙ্কর। দেখেছিলেন মাসিকেও। লেখক মোটামুটি বিস্তারিত জানিয়েছেন বাস্তবের বসনের কথাও।
‘আমাদের গ্রামে স্টেশনের ধারে কোনো মেলা-ফেরত একদল ঝুমুর এসে নামল। বড় বটতলায় ঘর পাতলে। তাদেরই একটি মেয়ের হলো কলেরা। এই মেয়েটির নামই বসন।
এককালে সুশ্রী ছিল, শীর্ণকায়া, দীর্ঘাঙ্গী, গৌরবর্ণ রং, বড় বড় উগ্রদৃষ্টি দুটি চোখ, মাথায় অপর্যাপ্ত চুল।
দেহটা দেখে মনে হয়, কোনো রক্তপায়ী সরীসৃপ নিঃশেষে ওর দেহের শুধু রক্তই নয়-----সারাংশও টেনে নিয়েছে। আমি তখন কলেরা-ম্যালেরিয়ায় সেবা করে বেড়াই, আগুন লাগলে বালতি নিয়ে ছুটি, দুর্ভিক্ষে চাল-কাপড় সংগ্রহ করে বিলিয়ে বেড়াই। কলেরার ওষুধ আমার কাছে আছে। ক্যালোমেল ১/৬ গ্রেন আর সোডিবাইকার্ব পাউডার। কেয়োলিন আছে।
রেক্টাল স্যালাইনের গ্লাস ও রবার টিউব রাখি। দিতেও পারি। কিছু প্রতিষেধক রাখি। যাদের হয়নি, ইনজেকশন দিই। কোথাও কারও কলেরা হলে খবর আগেই আসে আমার কাছে। কাজেই খবরটি এলো। গেলাম। দলটির মুখ শুকিয়ে গেছে।
সকলে অদূরে বসে আছে, মেয়েটি ছটফট করছে-----জল আর জল শব্দ। কাছেই অদূরে বসে আছে মাসি। আর-একটা পুরুষ, যে বসনের ভালোবাসার জন। মদও রয়েছে দেখলাম।
যথাসাধ্য করে এলাম।
এটা সকালবেলার কথা। ওই সময়েই বসনের অস্থিরতা দেখে মাসি বলেছিল, ভগবানকে ডাক্ বউ, ভগবানকে ডাক্।
সে বলেছিল, না।
এই সময়টুকুর মধ্যেই এ-কথা সে-কথার মধ্যে ওই কথাটিও শুনেছিলাম-----বসন মলে তার ওয়ারিশ হবে ওই মাসি। বলেছিল, আমার নেকন দেখো না।
বিকেলবেলা ওদের দলের ওই বসনের ভালোবাসার মানুষটি এসে খবর দিলে, একটুকুন ভালো আছে। একবার যদি আসেন।
এ-দিকে অর্থাৎ রোগী ভালো থাকার সংবাদ এলে উৎসাহ এবং আকর্ষণ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। উৎসাহিত হয়েই গেলাম। তখন দেখলাম, ওরা একটু আশ্রয়স্থল পেয়েছে। স্টেশনের পাশেই সে-সময় আমাদের শম্ভুকাকার এক আশ্রম ছিল। শম্ভুকাকা কানে খাটো, সে-আমলের তান্ত্রিক লোক, কারণ করেন, গাঁজা খান, পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় করেন না, যত ক্রোধ তত কোমলতা। তিনিই ওদের অবস্থা দেখে ডেকে ওই ঘরে ঠাঁই দিয়েছেন-----থাক্ এইখানে।
গিয়ে দেখলাম, মেয়েটি ঘুমুচ্ছে।
যেতেই মাসি তাকে ডাকলে, বসন।
আমি বারণ করবার আগেই সে ডেকেছিল, মেয়েটি ক্লান্ত চোখ মেলে চাইলে। প্রাণের আবেগে হাত বাড়িয়ে আমার পা খুঁজলে।
আমি বললাম, থাক।
তার ঠোঁট দুটি কাঁপল, বললে, আপনি না থাকলে মরে যেতাম বাবু, এরা হয়তো জ্যান্তই ফেলে পালাত, আমাকে শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খেয়ে নিত।
...
মনে পড়ছে, ঠিক এমনি সময়েই ঘরের বাইরে মাসির কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম, ওই-----ওই, পলাইছ ক্যানে? ও নোকেরা, ও বাবারা! এসো, এসো! কলেরা লয়। সি ভালো আছে। ওগো! তারপরই শুনলাম, অ! বাবু রইছে!
অর্থাৎ আমাকে বসে থাকতে দেখে কারা পালিয়ে গেল। বুঝতে বিলম্ব হলো না, তারা কেন এসেছিল।
এদের এই জীবন। ক্রমে এদের জীবন সম্পর্কে আরও অনেক কথা জানলাম। জেনে বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। হে ভগবান, এমনও হয়!’
সংক্ষেপে এই-ই হলো ‘কবি’ উপন্যাসের পাত্রপাত্রী এবং তাদের বাস্তব জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র। এইটুকু কাঁচামাল ব্যবহার করেই তারাশঙ্কর সৃষ্টি করেছিলেন তার অবিস্মরণীয় উপন্যাসটি।