Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সুর-অসুর

Icon

সুজিত সজীব

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:২১

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সুর-অসুর

সাংস্কৃতিক বিপ্লবে অবদান রাখা গুণীজন। ছবি: সংগৃহীত

সংস্কৃতির দুটি আভিধানিক সংজ্ঞা দিয়েই আলোচনাটি শুরু করা যাক। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের সম্পাদনা ও সংকলনে বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (কলিকাতা ১৯৮৮)-এ সংস্কৃতির সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘সংস্কার; বিশুদ্ধীকরণ...অনুশীলন-লব্ধ দেহ-মন-হৃদয় ও আত্মার উৎকর্ষ; কৃষ্টি’। আর অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে ‘কালচার’ বা সংস্কৃতির সংজ্ঞা হলো, ‘মন, রুচি ও আচরণের প্রশিক্ষণ, উন্নয়ন এবং শুদ্ধিকরণ; এভাবে প্রশিক্ষিত ও পরিশুদ্ধ হওয়ার অবস্থা; সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক দিক।’ 

প্রথম সংজ্ঞাটি মূলত উপমহাদেশের এবং এখানে হৃদয় এবং আত্মা কথা দুটি আছে। দ্বিতীয়টি পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিকে সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মোদ্দা কথা, বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রোমান্টিকতা এবং আধ্যাত্মিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছে আর পশ্চিম বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ওপর জোর দিয়েছে। 

নিউ কালচার মুভমেন্ট 

নিউ কালচার মুভমেন্ট ছিল ১৯১০ এবং ১৯২০-এর দশকে চীনের একটি প্রগতিশীল আর্থ-রাজনৈতিক আন্দোলন। অংশগ্রহণকারীরা চীনা সংস্কৃতির নতুন ফর্মুলেশনের পক্ষে এই আন্দোলন শুরু করেন। চেন দুক্সিউ, কাই ইউয়ানপেই, চেন হেংজে, লি দাঝাও, লু জুন, হু শিহ-র মতো প্রভৃতি চীনা তরুণ দার্শনিক ও শিল্পীরা চীনের প্রাচীন কনফুসিয়ানিজমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আন্দোলনটি নিউ ইয়ুথ ম্যাগাজিনের লেখকদের দ্বারা শুরু হয়েছিল। তারা প্রাচীন ঐতিহ্যগত লেখার পদ্ধতি ত্যাগ করে স্থানীয় ভাষা ব্যবহার শুরু করুন।

তরুণ বুদ্ধিজীবীরা ঐতিহ্যবাহী কনফুসিয়ান ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রচার করেছিলেন। এই আন্দোলনের ইশতেহার হিসেবে ১৯১৭ সালে মি. হু শি-র তার বিখ্যাত ‘আট নীতি’ উপস্থাপন করেন। 

ইউরোপের সাংস্কৃতিক আন্দোলন

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্ট পুরো পশ্চিমা দুনিয়ায় যে বিশ্ববীক্ষা তৈরি করেছিল, তার মূলকথা ছিল বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির আশ্রয়, ভাবের বিপরীতে বস্তুর প্রাধান্য। এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টই ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি। 

এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে আছে যুক্তির মহিমা উদযাপন ও প্রয়োগ; বিশ্বাস ও পূর্বধারণা থেকে মুক্তি; যে ধীশক্তি দিয়ে মানুষ এই অনন্ত বিশ্বকে জানতে পারে ও মানবসমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে, সেই শক্তির উন্মেষ ঘটানো; জ্ঞান, মুক্তি ও সুখ হলো যুক্তিবাদী মানবতার লক্ষ্য ইত্যাদি।

এনলাইটেনমেন্ট মুভমেন্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ফরাসি বিপ্লবের পূর্বক্ষণে জনগণের প্রস্তুতির পর্বটিতে দেখা যায়, ভলতেয়ার, রুশোসহ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে কালের অগ্রবর্তী চিন্তাবিদদের এবং লেখকদের একটি দল ব্যাপকভাবে লেখালিখি শুরু করেন। 

তাদের লেখায় ছিল রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, মহাবিশ্ব, মানুষ, ঈশ্বর ইত্যাদি সম্পর্কিত দার্শনিক চিন্তা। এই দর্শনে ছিল মানবিক যুক্তির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব। আর ছিল প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় ও বিরাজমান রাজনৈতিক অনুশীলনের সমালোচনা। ফ্রান্সের জনগণ তাদের এই দর্শন ব্যাপকভাবে পাঠ, গ্রহণ এবং ঘোরতর পরিবর্তন সাধনের জন্য সর্বাত্মক বিপ্লবের প্রস্তুতি নেয়। 

চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া ও প্রাচীন পুঁজিবাদী ও সামন্তীয় সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করে সমগ্র সমাজে জ্ঞানভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ সৃষ্টি করা। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া এই বিপ্লবের আনুষ্ঠানিক নাম ‘মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মাও সে তুং পার্টিতে আবারও নিজের মতাদর্শিক অবস্থান সংহত করেন। পার্টির কেন্দ্রীয় অনেক নেতা, এমনকি শীর্ষে অবস্থানরত লিউশাউচীসহ পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতা, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকর্তার অবস্থান বিপ্লবের জন্য ক্ষতিকর, বিপজ্জনক বলে অভিহিত হয় এবং তারা তীব্র সমালোচনা ও আক্রমণের শিকার হন। ১৯৬৯ সালে মাও আনুষ্ঠানিকভাবে এর সমাপ্তি ঘোষণা করলেও এর রেশ ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে কেন্দ্র করে চীনে যখন বিরাট উথালপাথাল হয়ে যায়। মাওয়ের সমর্থক ও তেং শিয়াওফিংয়ের সমর্থকের কারণে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে যায়। চীনের তরুণদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে লিটল রেড বুক নামে মাওয়ের বক্তব্যমালা প্রকাশ করেন। তরুণদেরকে নিয়ে গঠিত রেড গার্ডও জনপ্রিয়তা পায়। তারা মাওয়ের বক্তব্যগুলোকে সর্বত্র প্রচার করতে থাকেন। এ ছাড়াও তারা মাওয়ের বিরুদ্ধবাদীদের মারধর ও বাড়ি-ঘর, জাদুঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এবং চীনে অরাজক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। 

বাংলার ভাববাদী আন্দোলন

বৈষ্ণব আন্দোলন চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রবর্তিত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও পরিচিত। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নদীয়ায় এ আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার প্রভাব পড়ে সারা ভারতে। শুধু বাঙালিরাই নয়, ভারতের নানা ভাষাভাষীরাও এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের মধ্যে সংস্কারের কাজ শুরু করেন। বৈষ্ণব আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মূলত চৈতন্যদেবের পূর্বে চণ্ডীদাস (চতুর্দশ শতক) ও বিদ্যাপতির (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) বৈষ্ণবপদ রচনার মধ্য দিয়ে; চৈতন্যদেব এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন এবং তার নেতৃত্বে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

চৈতন্যদেব হিন্দু সমাজে সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শ যুক্ত করে একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন। তিনি রাধাকৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার তত্ত্বকে গ্রহণ করে অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদের কথা বলেন। 

উপমহাদেশের রেনেসাঁ 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় যে জাগরণ ঘটে তাও এমনই একটি রেনেসাঁস : যার প্রভাব হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। ধর্ম-সংস্কৃতি-সাহিত্য-রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় আদর্শ-সব ক্ষেত্রেই নবীন ভারতে যে রূপান্তর ঘটল তার মূলে এক বড় শক্তিরূপে কাজ করেছে এই রেনেসাঁ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের স্বদেশি আন্দোলনে এই জাগরণ নিজেকে জানান দেয় এক অসাধারণ বিক্রমে; কিন্তু তারপর বাংলায় শুরু হয় এক উন্মাদনার কাল-সন্ত্রাসবাদ, রাজরোষ, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এমনি বিচিত্রমূর্তির উন্মাদনা। সেই সময়ের অবসান হয়েছে, তারপর হয়েছে স্বাধীনতার নব অরুণোদয়। 

এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায়। তার সংস্কার চিন্তাতে শুরু হয় এই রেনেসাঁসের। এর পথ ধরে বাংলা সাহিত্যে চিত্রকলাসহ শিল্পকলার এক অনন্য সময় উপস্থিত হয়। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, ডিএল রায়, সুকান্ত, সৈয়দ মুজতবা আলী, বঙ্কিম-কে নেই সাংস্কৃতিক জাগরণে। 

ষাটের দশকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণ

সাধারণের রুখে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক সচেতনতা ক্রমাগত অগ্রসর হয়েছে, যা রাজনৈতিক আন্দোলনে জনগণকে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পরে আন্দোলন আরও অগ্রসর হয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবলরূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করে। ৬ দফায় যে সীমাবদ্ধতাগুলো ছিল, তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় ১১ দফা কর্মসূচি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তি ছিল বলেই এ রাজনীতি আপামর জনগণের মাঝে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিতে পেরেছে।

এখানে আরেকটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যে ইতিহাস লেখা হয়, সেখানে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের কথা খুব কমই উঠে আসে। আমাদের মনে রাখা দরকার, তৎকালীন পূর্ব বাংলায় যে জাগরণ ঘটেছিল, তা সমগ্র গ্রামগঞ্জজুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। তার আলোকেই আমাদের চিন্তার বিস্তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতার অজুহাতে তা বাস্তবায়িত হয়নি। যা মূলত আমাদের কালো অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫