
প্রতীকী ছবি
গ্রামের নাম বসন্তপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। নদীর পাড় ধরে পশ্চিম দিকে হেঁটে গেলে তিন নদীর মোহনা। কালিন্দি, ইছামতী ও কাকশিয়ালি নদী সেখানে মিলিত হয়েছে। ছোটবেলায় তিয়াসা ও বাবান সেখানে কত বসেছে। নদীর পাড়ে বসে পা ঝুলিয়ে আকাশ দেখত। মাঝে মাঝে বড় ঢেউ এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিত। বাবান তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসত।
বাবান একদিন আবুল কাকাকে বলল, ‘কাকা আমাদের তোমার নৌকায় তুলে একটু ঘুরাবে?’ আবুল কাকা নদীতে মাছ ধরতেন, নৌকাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি বললেন, ‘অবশ্যই ঘোরাব বাবা, কিন্তু নৌকায় জুতা খুলে উঠতে হবে।’
ওরা নৌকায় উঠল, ছলাৎ ছলাৎ করে নৌকা চলছে। রোদের আলোয় নদীর পানি ঝিকমিক করছে। নদীর মাঝখানে লাল সুতা দিয়ে সীমানা দেওয়া। সীমানার এ পাশের নৌকায় বাংলাদেশের পতাকা, ওপাশের নৌকায় ভারতের পতাকা। আবুল কাকা সেদিন বলেছিলেন, ‘জানিস বাবান, এই সীমানা মাঝে মাঝে মানুষের সব কেড়ে নেয়। তোরা এখন অনেক ছোট ওসব বুঝবি না।’
তিয়াসা বলেছিল, ‘কাকা আমাদের ওপারে নিয়ে যাবে?’ কাকা বলেছিলেন, ‘না রে মা, ওপারে যেতে পারব না। ওটা আলাদা দেশ। এই লাল সীমানা অতিক্রম করলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।’
ওরা তখন অনেক ছোট, সত্যি ওসব বুঝত না। বাবান বলেছিল, ‘কাকা নদীর পানি তো এক। এ পাশের ঢেউ ওপাশে যাচ্ছে। এ পাশের মাছ ওপাশে ভেসে যাচ্ছে। ওপাশের বক এপাশে উড়ে আসছে।’
আবুল কাকা বলেছিলেন, ‘মাছ, পাখি, পানির কোনো সীমানা নেই। কিন্তু মানুষের সীমানা আছে। মানুষ চাইলেই সেই সীমানা অতিক্রম করতে পারে না।’
নৌকা থেকে নামার পর সেদিন তিয়াসা বলেছিল, ‘বাবান আমি একদিন নদীর ওপারে যাব, দেখে নিস।’ সেদিনই ছোটবেলার বন্ধু তিয়াসার জন্য একটি নদী কিনবে ভেবেছে বাবান।
প্রায় প্রতিদিনই তিন নদীর মোহনায় ওরা। নদীর পাড়ে কেওড়া বাগান, বর্ষাকালে কেওড়া ধরত। তখন বাবান তিয়াসাকে কেওড়া পেড়ে দিত। আর তিয়াসা নুন লাগিয়ে খুব মজা করে কেওড়া খেত। কেওড়ার স্বাদ টক, তিয়াসার খাওয়া দেখে বাবানের জিভে পানি চলে আসত।
সময় গড়াতে থাকে। তিয়াসা ও বাবানের বয়স হচ্ছে। ওদের স্বপ্নগুলো বড় হচ্ছে। ওরা ক্লাস এইটে উঠে গেছে। সেদিন কেওড়া গাছের গোড়ায় বসেছিল বাবান। ওর বুকে মাথা রেখে তিয়াসা বলেছিল, ‘বাবান, নদীর মোহনার মতো আমরাও একদিন মিলে যাব। কিন্তু নদীর মতো আমাদের কোনো সীমানা থাকবে না, তাই না?’ বাবান ওর কথায় হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘সম্পর্কের কোনো সীমানা হয় না।’
সেদিন তিয়াসা ও বাবানকে দেখে ফেলেন ফজের আলী। তিনি গিয়ে তিয়াসার বাবাকে বলেন, ‘তোমার মেয়েকে দেখলাম, নদীর পাড়ে এক ছেলের বুকে শুয়ে আছে! ছি ছি লজ্জা-শরম সব দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে না কি?’ শুধু তিয়াসার বাবাকেই বলেননি, পুরো গ্রামেও বলে বেড়ান ফজের আলী।
বাবা তিয়াসাকে কিছুই বলেননি। কিন্তু রাতে ইছামতী নদী পার করে হিঙলগঞ্জে পাঠিয়ে দেন। বাবার পায়ে ধরেছিল তিয়াসা, কোনো কথা শোনেননি তিনি। কারও বাধা মানেননি। দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে পাঠানো হয় তাকে। পরের দিন সকালে সেই কথা জেনেছিল বাবান। শুনে নদীর মোহনায় গিয়ে খুব কেঁদেছিল বাবান। ভেবেছিল তিয়াসা ফিরবে, কিন্তু ফেরেনি।
তারপর একুশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো নদীর মোহনায় এসে বসে থাকে বাবান। আবুল কাকার কথাই সত্যি, ‘মানুষের সীমানা আছে। মানুষ চাইলেই সেই সীমানা অতিক্রম করতে পারে না।’ বাবানও পারেনি। নদীর মাঝখানের লাল সুতোটাই বাবান ও তিয়াসাকে আলাদা করে দিয়েছে।