
কবি শহীদ কাদরী। ফাইল ছবি
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শহীদ কাদরী, ১৯৪৭-পরবর্তীকালে সেই কবি যিনি তার কবিতার কাব্য ভাষায় বাঙালি জীবনের নাগরিকতা ও আধুনিকতার মেল বন্ধন গড়েছিলেন। তার কবিতার কাঠামোর বিনির্মাণ ও কবিতার ভাষায় যে ফুরফুরে আমেজ ব্যবহার করতেন তাতে পাঠক প্রাত্যহিক যন্ত্রণার বিবমিষা থেকে উত্তীর্ণ হতেন সহজেই। তার ভাষা, বর্ননারীতি ও বক্তব্যের শাণিত রূপ তার কবিতাকে স্বকীয়তা দান করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এবং যুদ্ধোত্তর নাগরিক জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত শহীদ কাদরীকে আচ্ছন্ন করে রাখতো। এরমধ্য দিয়ে আবার ঘটেছে দেশভাগ। সে আরেক ভয়াবহ আখ্যান। দেশভাগ হলে ভারত থেকে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে আসেন। অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গ থেকে ৫৮ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ভারতে দেশান্তরী হন। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি। বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে এই দেশান্তরী হওয়া ছিল বিরামহীন। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কুশীলবরা সংখ্যালঘু অনেককেই ভয়-আতঙ্ক দেখিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে আজও মুক্ত হয়নি এই উপমহাদেশ। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার পর প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। ভারত থেকে মুসলমানরা পাকিস্তানে, আর পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা ভারতে আসতে থাকে। দেশভাগের ওই সময়ে প্রায় এক মাস ধরে দাঙ্গা চলেছিল। এ সময় সহিংসতায় নিহত হয় কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ। এই বাস্তবতা শহীদ কাদরীকে কাছ থেকে জীবন দেখিয়েছিল। শহীদ কাদরীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার শৈশব কৈশোরের এক চিত্রল ছবি চোখে পড়ে। এ বইয়ের নামকবিতার মধ্য দিয়ে দেখা মেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল ও তার জন্ম প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয় নিয়ে। তিনি লিখেছেন ‘সন্ত্রস্ত শহরে/ যেখানে নিমজ্জিত সবকিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউট আঁধারে।’ ব্ল্যাক আউট, কাঁটাতার, তাঁবু, কুচকাওয়াজ, সারিবদ্ধ সৈনিক, কামান ও বিউগল। এসব শব্দই বলে দেয় আমরা সবাই বিদেশি সেনা-কবলিত ছাড়াও নাগরিক জীবন বিদেশি সেনা-পরিবৃত, শৃঙ্খলিত। তাছাড়াও সন্ত্রস্তসহ বিভিন্ন শব্দের ব্যবহারে শহীদ কাদরী বিশ্বযুদ্ধের কালকে চিহ্নিত করেন। বাংলা কবিতা ক্ষেত্রে শহীদ কাদরী জনপ্রিয় ধারার কবি ছিলেন এটা বলা যাবে না। তবে তার কবিতা ব্যাপক পাঠক আদৃত এটাও সঠিক। এক কথায় বলা যায় বিরলপ্রজ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মননশীল পাঠকের জন্য ছিলেন অনন্য।
কবি হিসাবে তিনি কবিদের কবি ছিলেন। এই বিরলপ্রজ কবির জীবনের প্রথমার্ধ স্বদেশে কাটলেও দ্বিতীয়ার্ধ তার কেটে গেল প্রিয় স্বদেশ থেকে বহুদূরে, স্বেচ্ছানির্বাসনে। তার প্রকাশিত চারটি কাব্যগ্রন্থ হলো- উত্তরাধিকার(১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিতমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)।
‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ বোধ করি তার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও পাঠক প্রিয় কবিতা। তিনি শুধুমাত্র এই কবিতাটি দিয়ে কবি শহীদ কাদরীকে চিহ্নিত করা যাবে না। তবে এই কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা ভাবনার গলিপথ এতটাই মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে যে বিশ্বেও তাবৎ মানুষ মনে করবে এই কবিতার চরণগুলি তার জন্য লেখা। এমন আরও অনেক কবিতা তার রয়েছে। বলা যায় ঝুট কাপড়ের মতো কবিতা তিনি লেখেননি। শহীদ কাদরী আজন্ম নাগরিক। জন্মেছেন কলকাতার নাগরিক প্রতিবেশে শৃঙ্খলিত বিদেশির পতাকার নিচে এবং জন্মেই শুঁকেছেন বারুদের কটু গন্ধ। তার কবিতায় তাই তিনি লিখেছেন-‘শৃঙ্খলিত, বিদেশির পতাকার নিচে/আমরা শীতে জড়োসড়/নিঃশব্দে দেখেছি প্রেমিকের দীপ্ত মুখ/থেকে জ্যোতি ঝরে গেছে।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল কবির কবিতায় ছায়াপাত করেছে শৈশবে সংঘটিত দাঙ্গার অমানবিক চিত্রকল্পের ভিতর দিয়ে। তার চিত্রকল্প নির্মাণের সূক্ষ্ম কারুকার্যেও দেখা মেলে তিনি যখন লেখেন-‘সেখানে রাতের বেলা বাউলের একতারার মতো বেজে ওঠে চাঁদ, অমাবস্যা-রাত্রির ময়দানজুড়ে গোলাপঝাড়ের মতো পুঞ্জ-পুঞ্জ জোনাকি জ্বলে আর নেভে।’ এসব চিত্রকল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালকে তিনি যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন তার সরল বর্ণনা। তিরিশোত্তর কবিদের অনেকেরই ভেতরে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে। ওই সময়কালে অনেকের কবিতাই প্রকৃতি সচেতন না। যেখানে প্রকৃতির অবারিত স্পর্শ সেখানে কবির প্রকৃতি সচেতনতার অভাব নিশ্চয়ই অবাক করার বিষয়। সেদিক থেকে শহীদ কাদরীর কবিতাকেও অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃতিবিমুখ মনে হলেও প্রকৃতি কবিতার অন্যতম উপাদান। কবির চারপাশের প্রতিবেশ, চলমান মানবগোষ্ঠীর মতো তাকে ঘিরে আছে গ্রামীণ বা নাগরিক নিসর্গ। কিন্তু কবি যখন লেখেন: ‘বাতাস আমাকে লম্বা হাত বাড়িয়ে/ চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সারাদিন, কিংবা, লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মতো কৃষ্ণচূড়া/ হেঁকে বলল:/ তুমি বন্দী!’ তখন প্রকৃতির উপাদানগুলো তার কবিতাকে কতটা প্রাণ দিয়েছে- কতটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে সেটা অনুমান করা যায়। প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় শহীদ কাদরী নিপুণ চোখেই লক্ষ করেন। জীবন ও প্রকৃতিতে যত অঘটন ঘটে তা কবিকে আহত করে, নিঃসঙ্গ করে। তাঁর প্রেমের কবিতা অসম্ভব ঐশ্বর্যমণ্ডিত। শহদ কাদরীর কাছে প্রেম ক্ষণিকের মিলন মাধুরী হলেও তার প্রেমের মানুষকে তিনি আহ্বান করেন বা বর্ণনা করেন অন্য দশজন কবির মতো নয়। কবিতার নানা উপাদান মিলেমিশেই নির্মিত হয়ে ওঠে কবিতার সামগ্রীকতা। তিনি লিখেছেন-“সর্বদা, সর্বত্র পরাস্ত সে/ মৃত প্রেমিকের ঠাণ্ডা হাত ধ’রে/সে বড়ো বিহ্বল, হাঁটু ভেঙে-পড়া কাতর মানুষ।/ মাঝে মাঝে মনে হয় শীতরাতে শুধু কম্বলের জন্যে/ দুটো চাপাতি এবং সামান্য সব্জীর জন্যে/ কিংবা একটু শাস্তির আকাক্সক্ষায়, কেবল স্বস্তির জন্যে/ বেদনার অবসান চেয়ে তোমাকে হয়তো কিছু বর্বরের কাছে/অনায়াসে বিক্রি ক’রে দিতে পারি অবশ্যই পারি।/ শহীদ কাদরীর এই অস্তিত্বসচেতনতা তার প্রেমের কবিতাকে করে তুলেছে অর্থবহ ও বাঙময়।
বন্য শুকর, প্রিয় কাদা খুঁজে পাক বা মাছ রাঙা অন্বেষণের মাছ খুঁজে পাক তাতে তার কোনো কথা নেই। শুধু একটু কষ্টবোধ প্রেমিক প্রেমিকার জন্য-এটা অভিসম্পাত হতে পারে এজন্য যে তারা মিললেও শান্তি পাবে না। কবিতায় পার্থিব জীবন ও জগৎ নিয়ে শহীদ কাদরী নানাভাবে তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেছেন। এ-কালের হননমত্ত পৃথিবী বিপর্যস্ত করেছে তাঁর চেতনাকে। এ-কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষই তার প্রিয় আবাসভূমিকে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও সমরপ্রিয় নেতৃবৃন্দ ধ্বংস করে দিচ্ছে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ।
বিশ্বব্যাপী সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন এবং হত্যা ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে শহীদ কাদরীর বিখ্যাত প্রতীকী কবিতা ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’। প্রিয়তমার প্রতি সংরাগ নিবেদন করতে গিয়ে কাদরী তার যুদ্ধবিরোধী মনোভঙ্গির শিল্পীত প্রকাশ ঘটিয়েছেন এ-কবিতায়। এ কবিতায় তিনি বিশ্বব্যাপী সামরিক আগ্রাসনের চিত্রই এঁকেছেন। এর মধ্যেই তিনি লিখেছেন তার অমর প্রেমের কাব্য। তার কবিতায় শিল্পের বিভা জ্বেলে দেয়া ভাষার যে দুটি উপাদান চিত্রকল্প ও রূপক অলংকার ব্যবহারে তিনি ছিলেন দক্ষ এক স্বর্নকারিগর। তার কবিতার কাঠামো বিন্যাস প্রকৃত পাঠককে মুগ্ধ করবে। তার কবিতার মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ, কাল মহাকালব্যাপী এই প্রতিভাধর।