Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

রসবোধ ও দর্শন: সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য ভুবন

Icon

বিচিত্র কুমার

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:১৫

রসবোধ ও দর্শন: সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য ভুবন

সৈয়দ মুজতবা আলী। ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ মুজতবা আলী, বাংলা সাহিত্যের রসবোধ এবং গভীর দার্শনিক চিন্তার এক অনন্য মিশ্রণ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রম্যলেখক, যার রচনায় পাঠকরা খুঁজে পায় জীবনের গভীরতম সত্য, হাস্যরসের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। তাঁর রচনা কেবল পাঠককে বিনোদিত করে না, বরং পাঠককে চিন্তার গভীরতায় নিয়ে যায়, যেখানে রসবোধ এবং দর্শন একত্রে মিলিত হয়ে জীবনের নানা জটিলতা এবং সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করে।

সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্যকর্মে রসবোধের যে অভিনব রূপ আমরা দেখতে পাই, তা শুধু পাঠকের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য নয়। তাঁর লেখায় প্রতিটি হাস্যরসাত্মক বর্ণনা আসলে গভীর জীবনদর্শনের প্রতিফলন। যেমন তাঁর ‘দেশে-বিদেশে’ উপন্যাসটি, যেখানে তিনি আফগানিস্তানে কাটানো দিনগুলির মজার সব ঘটনা এবং অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তবে এখানে শুধু মজাই নেই; রয়েছে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ এবং সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। আফগানদের সরলতা, আন্তরিকতা, এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতির বৈপরীত্যগুলোকে লেখক কৌতুকময় উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি পাঠকদেরকে একটি গভীর বোধের সন্ধান দেন—যেখানে রসিকতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে জীবনের বড় বড় সত্য।

তার লেখায় প্রতিটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে যে জীবনদর্শন প্রকাশিত হয়েছে, তা অত্যন্ত গভীর। ‘শবনম’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে একটি সম্পর্কের পরিবর্তনশীলতা মানুষের মনের গভীরে কীভাবে প্রভাব ফেলে। শবনম এবং প্রধান চরিত্রের মধ্যকার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে জীবনের বিভিন্ন স্তরে প্রেম, ত্যাগ, এবং আত্মত্যাগের রূপ পরিবর্তিত হয়। শবনমের এই গল্পের মধ্যে মানব সম্পর্কের জটিলতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে প্রেম কেবল একটি আবেগ নয়, বরং এটি এক জীবনের গভীর প্রতিফলন।

সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনায় হাস্যরসের আড়ালে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির প্রতি তীক্ষ্ণ সমালোচনা পাওয়া যায়। ‘ময়ূরকণ্ঠী’ গল্পে তিনি একটি পাখির ডাককে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীদের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতার চিত্র এঁকেছেন। এখানে লেখক গ্রামীণ সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং সামাজিক অসঙ্গতিকে কৌতুকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। মুজতবা আলী এই ধরনের ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা একদিকে পাঠকের মনে হাসি ফোটায়, অন্যদিকে সমাজের বিদ্রূপাত্মক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করে।

তিনি তার লেখায় যে ভাষার ব্যবহার করেছেন, তা সাহিত্যের এক বিশেষ দিককে ফুটিয়ে তোলে। তাঁর ভাষা সরল, প্রাঞ্জল এবং অত্যন্ত বহুমাত্রিক। বাংলা সাহিত্যে তিনি এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন যেখানে হিন্দি, উর্দু, ফারসি, আরবি শব্দের মিশ্রণে একটি অনন্য ভাষারীতি গড়ে উঠেছে। ‘রসগোল্লা’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে তিনি একটি মিষ্টির মাধ্যমে সমাজের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর শব্দচয়ন এবং বর্ণনাভঙ্গির সুষম ব্যবহার পাঠকদের এমন এক অভিজ্ঞতা দেয়, যা সাহিত্য পাঠের এক নতুন রূপের সন্ধান দেয়।

‘চাচা কাহিনী’ গল্পে আমরা পাই এক হাস্যরসিক চাচার কাহিনী, যিনি একদিকে মজার, অন্যদিকে গভীর জীবনদর্শন প্রকাশ করেছেন। এই চরিত্রের মাধ্যমে মুজতবা আলী দেখিয়েছেন যে, জীবনের সবচেয়ে তুচ্ছ ঘটনাগুলোর মধ্যেও একটি গভীর জীবনদর্শন লুকিয়ে থাকে। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে একটি কৌতুকময় জীবনের চিত্র অঙ্কিত হলেও, তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে গভীর দার্শনিক মর্ম। এটি পাঠকদের নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করে—জীবনের ছোটখাটো ঘটনা কিভাবে বড় অর্থ বহন করতে পারে।

মুজতবা আলীর রচনায় রসবোধ এবং দর্শনের যে যুগলবন্দী, তা বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি হাস্যরসের আড়ালে জীবনের গভীরতাকে প্রকাশ করেছেন, যা কেবল পাঠককে আনন্দ দেয় না, বরং চিন্তার নতুন দিগন্তও উন্মোচিত করে। তাঁর সাহিত্যকর্ম, বিশেষ করে ছোটগল্প এবং উপন্যাসগুলো, আমাদের সামনে এমন এক জগতের দরজা খুলে দেয় যেখানে প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র, এবং প্রতিটি সংলাপ একটি নতুন দৃষ্টিকোণ নিয়ে আসে। 

সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং জীবনকে নতুন করে বোঝার জন্য। তাঁর লেখায় আমরা দেখি হাসি-কান্নার অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা, প্রেম-বিরহের বেদনাময় রূপ এবং জীবনের গভীর দার্শনিক সত্য। সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যে এমন এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন, যা সময়ের সাথে সাথে আরও দৃঢ় হয়েছে। তার রচনায় রসবোধ এবং দর্শনের এই সমন্বয় বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাকবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫