
প্রতীকী ছবি
সাহিত্য একটি নিরবচ্ছিন্নভাবে চর্চার মাধ্যমে হয়ে ওঠা চিন্তা, রুচি ও মননশীলতার শৈল্পিক পাঠকেন্দ্র। সাহিত্যে তাই সততা এবং নিষ্ঠার কমতি থাকলে, তা আর সঠিকরূপে বিকশিত হতে পারে না। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলে যেমন থমকে যেতে হয়, ঠিক তেমনিভাবে সাহিত্যের জন্য ব্যক্তির স্বাধীনভাবে পূর্ণ মনোনিবেশের মধ্যে দিয়ে চিন্তার উৎকর্ষ স্তরে পৌঁছতে হয়। ফলে সাহিত্য চর্চার জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সততার প্রয়োজন হয়।
বহুকাল আগে থেকে সাহিত্য চর্চা বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সত্যিকারের সাহিত্য নির্মাতা কখনও কিছুতে মাথা নত করে না, সাহিত্য সর্বদা সত্য ও সুন্দরের পথে অগ্রসরমাণ একটি প্রক্রিয়া। সমাজ বিনির্মাণে সাহিত্য চর্চার মানুষদের কদর সে কারণে অধিক। এরা রাষ্ট্র গঠন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। ইতিহাসে রাজ-রাজড়াদের যুগ থেকে সাহিত্যচর্চাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতার তথ্য আমরা জেনেছি বিভিন্ন গবেষণা এবং নানান বইয়ের মাধ্যমে; কিন্তু সেগুলো ছিল রাষ্ট্রনেতাদের নিয়ে স্তুতিসাহিত্য চর্চার প্রথম স্তর, স্তুতিমূলক সাহিত্য আধুনিককালে এসেও কমেনি, বরং তা বেড়েছে বহুগুণে। স্তুতিসাহিত্যে অর্থলোভ বা পৃষ্ঠপোষকতা প্রধানভাবে প্ররোচনা দেয়। দেশে দেশে আধুনিক এই সময়ে এসে শিল্প-সাহিত্য
চর্চার লোকদের দেখা যায় বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে স্তুতিরচনা হাজির করতে। যে কারণে পত্র-পত্রিকার মালিকপক্ষ সব সময় স্তুতি প্রদানকারীদের সঙ্গে রাখে। শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য আধুনিককালে খবরের কাগজগুলো জুড়ে একটি বিভাগ রাখা হয়, যেখানে লেখক-সাহিত্যিকরা তাদের সমকালীন চিন্তা ও চর্চা লিখে প্রকাশ করতে পারে। এই বিভাগটির দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি সাহিত্য সম্পাদক। এখন আসা যাক, সাহিত্য সম্পাদকের দায় কী এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। একজন সাহিত্য সম্পাদক যা ছাপেন তার সাময়িকীতে তা পাঠকগণ পাঠ করেন, সেই লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে নতুন ভাবনার উদয় হয়, মানুষের রুচি নির্মাণ আর ভাবনার জগৎকে উসকে দেওয়ার কাজে, সমাজ বিনির্মাণের জন্য সাহিত্য পাতার ভূমিকা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সাহিত্য সম্পাদক যা ছাপতে চান তা সমাজের মানুষের নিকটও গ্রহণীয় হতে হয়। ফলে একজন গুণী সাহিত্য সম্পাদক সমাজে নানাভাবে তার চিন্তার ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটাতে যেমন পারেন, ঠিক তেমন করে সমাজের অনিষ্টসাধনও তার দ্বারা সম্ভব।
সম্পাদনার ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে তুলে ধরা যায় কয়েকজনের নাম, যারা বাংলাভাষার সাহিত্য জগতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে সঠিকরূপে পালন করে গেছেন। প্রমিত ভাষায় প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করেন যেমন প্রমথ চৌধুরী, নতুন এবং প্রতিভাবান কবিদের আশ্রয়স্থল কবিতা পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু, বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি ও সম্পাদক আহসান হাবীব, সমকাল সম্পাদক আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সুন্দরম সম্পাদক মুস্তফা নূরউল ইসলাম, কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রবাদপ্রতিম। এরা নানাভাবে সমকালের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র করে তুলেছিলেন নিজেদের কাগজকে। এদের কাগজে যারা লিখেছেন তারা সুনামের সঙ্গে সাহিত্য পরিমণ্ডলে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। সমাজ চিন্তার জন্য সাহিত্য সম্পাদকের ভূমিকা সেই কারণে সবকালে প্রাসঙ্গিক। নতুন চিন্তার আশ্রয় এবং নতুন ভাবনার কদর একজন দায়িত্বশীল সাহিত্য সম্পাদক এ কারণেই করে থাকেন- তার সম্পাদিত কাগজে যে কবিতা ছাপা হয়, যে গল্প ছাপা হয়, যে প্রবন্ধ ছাপা হয়, যে সাক্ষাৎকার ও কলা বিষয়ক রচনা ছাপা হয় তা সময়কে ধারণ করে এবং এই রচনার স্রষ্টারা শেষাবধি সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা অনুভব করেন।
ফলে ভালো লেখা পাঠ করানোর জন্য সময়োচিত নতুন ভালো লেখাটি প্রকাশও জরুরি। গোষ্ঠীবদ্ধ হলে সময়কে ধারণ করার যে একটি সুযোগ তা থেকে পাঠক বঞ্চিত হয়, আর এ ধরনের গোষ্ঠীভিত্তিক সাহিত্যচর্চা সাহিত্য সম্পাদকদের এক ধরনের গুরুতর অপরাধ এবং সাহিত্যে হীনমন্য রাজনীতি। ভালো সাহিত্যকে মন্দ বলা আর অপাঠ্য সাহিত্যকে ভালো বলে ছাপিয়ে পাঠকের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়ার কাজটি বহুকাল ধরে বাংলাভাষায় চলে আসছে। এর মধ্যে ভাষার রাজনীতিও আর একটি গুরুতর অপরাধ। যারা মনে করেন লেখায় এক রকম ভাষা আর কথা বলায় আরেকটি ভাষা ব্যবহার করা, এই বিষয়টি কতটা যৌক্তিক তাও বিবেচনা করা সাহিত্য সম্পাদকের দায়ের মধ্যে পড়ে। গ্রন্থ আলোচনা বিভাগে যেমন সেরা বই বিবেচনা করা হয়, সেরা বই বলতে কী বোঝায় এর ব্যাখ্যা নেই। হতে পারে নতুন ভাবনার বই, সেগুলোকে তুলে আনা জরুরি। পাঠক নতুন চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, এটা একটি মহৎ কাজ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বই, কবিতা, গল্প বা চিন্তা বিষয়ক রচনাকে বাদ দেওয়া- কোনো সাহিত্য সম্পাদকের দায় হতে পারে না, এটি যৌক্তিকভাবে অসততা এবং সাহিত্যে অপরাজনীতি, এই ধরনের সাহিত্য চর্চা যারা মস্তিষ্কে নিয়ে ঘোরেন, তাদের সাহিত্য সমাজ থেকে প্রথমেই তিরস্কার করা উচিত এবং এরা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বলেই বিবেচিত হয় শেষাবধি। সাহিত্য সম্পাদক আর শিক্ষক সমান গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ, শিক্ষক ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক গড়ে তোলেন যেভাবে, সাহিত্য সম্পাদকও ঠিক একইভাবে সমাজের অগ্রসরতার জন্য ভালো সাহিত্য ছাপেন দায়িত্বশীল হয়ে।