
প্রতীকী ছবি
জাদুকর মোড়ের এক মাথায় একটা বড় আয়না বসিয়ে রেখেছে। বড় বলতে কতটা বড়, সেটা নিশ্চিত বলা মুশকিল। একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল আয়নার সামনে দিয়ে, সে যত এগোয় দেখে আরেকটা পাখি উড়ে আসছে তার দিকে। একসময় সে বুঝতে পারে আকাশের নকল করে একটা আয়না বসানো হয়েছে। একটা হাতি বলছে, আয়নাটা তার মাপের আবার আরেকটা পিঁপড়া বললো- আয়নাটা বেশ বড়, এমনকি একটা শিশিরবিন্দুর চেয়েও বড়।
আয়নার আকার শুধু নয়, প্রকৃতি নিয়েও তৈরি হয়েছে ঝামেলা। কেউ বলছে- আয়নাটা জলের মতো, টলটল করে। কেউ বলছে আয়নাটা বিরাট একটা মরুভূমির মতো, উজ্জ্বল বালুতে ভরপুর। কেউ বললো- না তো, আয়নাটা একটা হীরকখণ্ডের মতোই উজ্জ্বল, শক্ত পাথর। আবার একজন বললো- আয়নাটা পুকুরের জলের মতো, কাজল কালো একটা পুকুর। বেশ গভীর, চারপাশে গাছপালা ছাওয়া। আবার একজন এসে বললো এই আয়নাটা একদম গভীর সমুদ্র; তবে শান্ত, নীল, যেন প্রশান্ত মহাসাগর।
মোড়ের মাথায় বসানো হলেও আয়নাটা গোপন, একান্ত এবং এক অর্থে ব্যক্তিগত। এই আয়নায় একসঙ্গে দুজনকে দেখা যায় না। দুটো প্রাণ বা বস্তু একসঙ্গে দেখা যায় না। শিলা ও মনোজ একসঙ্গে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আয়না তাদের দুজকে একসঙ্গে দেখায়নি। শিলা শুধু শিলাকে দেখেছে, মনোজ শুধু মনোজকে।
: ও শিলা, তোমারে তো আয়নায় দেখতে পাই না।
: আমিও তো শুধু একলা আমারেই দেখি।
: হু, জাদুকরের আয়না বলে কথা।
: হু, জাদুকরের আয়না বলে কথা।
ক্রমে শহরে সবাই জেনে গেলো মোড়ের মাথার এই আয়নায় কেবল নিজেকে দেখা যায়। একসঙ্গে যদি পাঁচজনও দাঁড়ায়; একজন কেবল নিজেকেই দেখতে পাবে, আর কাউকে নয়। লোকজন এতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। আদতে নিজেকে দেখার মধ্যে আহামরি কি-ইবা আছে। সবারই ঘরে আজকাল একটা-দুইটা আয়না থাকে। এমনকি মানুষের স্নানঘরে, শোয়ার ঘরে আয়না অনিবার্য। বিখ্যাত স্থপতি সৈয়দ সাঈদ তো তার সিঁড়িধাপেও আয়না বসিয়েছেন। লোকজন যখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠে বা নামে তারা তাদের পা দেখতে পায়। পা নয়, তখন মনে হয় আয়নাই চলছে। আবার শিল্পী মুমিনের বাসার সব দরজাতেই আয়না লাগানো। দরজার এপিঠ-ওপিঠ পুরোটাই আয়না।
আজকের দিনে আয়না আদতে আহামরি কিছু নয়। ফুটপাতের দোকানদারও ১০০ টাকায় সুন্দর আয়না বিক্রি করেন। সেসব আয়নায় নিজেকে যেমন দেখা যায়, তেমনি চাইলে পরিজন নিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখা যায়; দেখা যায় নিজের চারপাশের দেয়াল, দরজা, জানালা। আয়নার কাজই হলো তার সামনে যা আসবে সে ঠিকঠাক তা-ই তুলে ধরবে। জাদুকরের আয়না সব যে ঠিকঠাক তুলে ধরে তা তো নয়। একই আয়নায় কেউ যদি বালু দেখে, কেউ দেখে পাথর, কেউ পানি; তা হলে কি সেই আয়নার ওপর ভরসা করা যায়? ফলে, নিজের ঘরের ব্যক্তিগত আয়না রেখে মোড়ের মাথার বেহুদা আয়নায় আর কারও আগ্রহ রইল না একদিন। মানুষজন আবার যার যার সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়ে থাকল, ঘাড় গুঁজে মোবাইল চালাতে লাগল, টিভিতে টক শো দেখতে লাগল; লাইক, শেয়ার, ভিউ গুণতে লাগল- এসব গোনা-গুণতির ভিড়ে জাদুকরের আয়নার খোঁজ আর কেউ রাখলোই না।
ক্রমে জাদুকরের আয়নায় ধুলা জমলো। ধুলার আস্তরের ফাঁকে ফাঁকে আয়নাটার দুই-এয়কটি জায়গা তখনও চকচক করে। তখন আয়নাটাকে ত্রিমাত্রিক মনে হয়; মনে হয় আয়নার ভেতর থেকে কে জানি উঁকি দিচ্ছে। ধুলার ফাঁক দিয়ে অবয়ব যেন উঁকি মারতে থাকে।
এ সব অবশ্য সবার মনে হয় না। সাদিয়ার মনে হয়। সাদিয়া আজকের যুগের মেয়ে হয়েও তেমন ব্যস্ত নয়, কোনো প্রতিযোগিতা, দৌড়-ঝাঁপ, ভাইরালে সে নিয়োজিত নয়। ফলে তার আছে অফুরান সময় আর অবিরাম কৌতূহল। সাদিয়া এ নিয়ে অন্তত একশবার এই আয়নার সামনে এসেছে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে দেখেছে। প্রত্যেকবারই তার মনে হয়েছে আয়নাটা তাকে কিছু বলতে চায়; কিন্তু কী বলতে চায়, তা এখনও ধরতে পারছে না সে। ফলে জাদুকরের আয়নার কোনো অলিখিত রহস্য-রোমাঞ্চ তাকে টানে। কেমন একটা নেশার মতো হয়ে গেছে জাদুকরের এই আয়নাটা। সাদিয়া বারবার ফিরে আসে আয়নার কাছে।
যদিও জাদুকরটা কে সেটাও এই শহরে কেউ জানে না। কারও অবশ্য জানার কোনো ইচ্ছাও নেই। এই শহরের লোকগুলো এতো জানা-বোঝার ধার ধারে না। সবারই যার যার নিজস্ব সমস্যা ও সম্ভাবনা আছে, তা নিয়েই সবাই ব্যস্ত। হয়তো একজন কেউ কখনো বলেছিল- গোলাপকুঞ্জের মোড়ের
মাথায় এক জাদুকর একটা আয়না বসিয়েছে। ব্যস, মুখে মুখে সেটা রটে গেছে। সবাই মেনে নিয়েছে কথাটা; কিন্তু কারও মনেই প্রশ্ন আসেনি- জাদুকর কে? জাদুকরকে কি কেউ দেখেছে কখনো? মানুষ, এখন সৃষ্টিকর্তা কে, তা নিয়েই ভাবে না, আর তো কোথাকার কোন জাদুকর!
সাদিয়ার অবশ্য কৌতূহল বরাবরই বেশি। সব কিছু সে খতিয়ে দেখতে চায়। গড়পরতার কোনো কথায় তার মন বসে না। তাই সে বারবার এই আয়নার কাছে আসে। তার মন বলে- এই আয়না আর আয়নার মালিকের মধ্যে একটা কোনো রহস্য আছে।
সাদিয়া আদিম মানুষের মতো একদিন আয়নার সামনে দাঁড়াল। দিন নয়, এই শহরে দিন-দুপুরে নগ্ন হওয়া সম্ভব নয়। সে একটা বোরকা পরে রাত বারোটার পর চলে এলো আয়নাটার সামনে। বোরকার নিচে কিন্তু কিচ্ছু নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চারিদিকে দেখলো। না, কোথাও কেউ নেই। ব্যস্ত মোড়টা এখন নির্জন। সে বোরকা খুলে ফেললো। পায়ের স্যান্ডেলও খুলে ফেললো। এইবার সম্পূর্ণ নগ্ন। বোরকাটা দিয়েই আয়নাটা ভালো করে মুছল। এইবার মগ্ন হয়ে আয়নার দিকে তাকাল। সাদিয়া দেখলো তার শরীরের ভেতর থেকে যেন একটা আলো বেরোচ্ছে। সাদিয়া দেখলো তার পিঠের পেছন থেকে একজোড়া ডানা বেরোচ্ছে। ডানাদুটো যেন ক্রিস্টালের তৈরি। আলোতে ঝিলমিল করছে। আর মাথার ওপরে একটা গোল চক্র; যেমন চক্র সে দেখেছে ধ্রুপদী চিত্রকলায় যিশু কিংবা দেব-দেবীর মাথার ওপরে। সাদিয়া জানে পবিত্র এই চক্রকে ‘হলো’ বলে। নিজেকে তার একটা দেবদূত মনে হলো সাদিয়ার। তার চোখে কান্না এসে গেলো! এতো সুন্দর সে! সে কি সত্যিই একজন দেবী, স্বর্গের কোনো অপ্সরা? এই মর্তলোকের কোনো সাধারণ নারী নয়? এই ডানা, এই মাথার ওপরের আলোর স্বর্ণালি
চক্র- এসব কি সত্যিই দেখছে সে। সাদিয়ার মনে হলো- সে আসলে এই পৃথিবীর মানুষ নয়। যে মানুষগুলো ট্রাফিক জ্যামে হর্ন বাজায় ক্রমাগত, যে মানুষগুলো কেবলই ওভারটেক করে, একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়; সে তাদের কেউ নয়। এই পৃথিবীর কেউ নয় সে। নিজের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সাদিয়া। তার ঊরুতে কামড়ের দাগ নেই, তলপেটে আঁচড়ের বিশ্রি দাগগুলো নেই। ওরা যখন তাকে নির্যাতন করেছিল, ধর্ষণ করেছিল, তখন সাদিয়ার বুকের নিচে একটা ছুরি দিয়ে টান দিয়েছিল; সেই দাগটিও নেই। সাদিয়া দেখলো সে সব রকম দাগ, বেদনা, চিহ্নের ঊর্ধ্বের একজন মানুষ। সাদিয়ার মনে হলো- তার শরীর নিয়ে যে যতোই অত্যাচার করে থাকুক না কেন, সে আসলে অমল এক আত্মা। আর এই আয়নাই আজ চিনিয়ে দিলো তার সত্যিকারের আত্মাকে।
নিজের আত্মাকে মগ্ন হয়ে দেখতে থাকল সাদিয়া; কিন্তু কখন ভোর হয়ে গেলো, সাদিয়া খেয়াল করল না। খেয়াল করার মতো উপায়ও তার নেই। সে ধীরে ধীরে আয়নার নিকট এগিয়ে এলো। তার পর একসময় আয়নার ভেতরে ঢুকে গেলো সাদিয়া।
আর আলো ফুটতেই এই শহরের ব্যস্ত মানুষরা ছোটছুটি শুরু করল। তার পর কোনো একজন লক্ষ্য করল, মোড়ের মাথায় জাদুকরের আয়নাখানি নেই। কথা নেই-বার্তা নেই, আয়নাখানি হাওয়া। আর ভিড়ের মধ্যে কোনো একজন দেখলো একটি বোরকা পড়ে আছে মোড়ের মাথায়। আয়না কোথায় গেলো, বোরকা কেন পড়ে আছে মোড়ের মাথায়- এসব নিয়ে লোকে দুদিন জল্পনা-কল্পনা করল, ফেসবুকে পোস্ট দিলো, নানা মুনি নানা মত দিলো; কিন্তু তিন দিনের মাথায় আয়না আর আলোচনায় থাকল না। কারণ তিন দিনের মাথায় এই শহরে যথাবিহিত আরেকটি মানুষ খুন হয়েছে। এই খুন হওয়া মানুষটি ছিল বিরাট ব্যবসায়ীর পুত্র, তার বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণের অভিযোগও ছিল। আদালতে অবশ্য সে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। এই মানুষটির লাশ পাওয়া গেলো মোড়ের মাথাতেই, যেখানে জাদুকরের আয়নাটি ছিল, যেখানে বোরকাটি পড়ে ছিল। মজার বিষয় হলো- লোকটি কীভাবে খুন হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারল না। লোকটির গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। সুরতহাল প্রতিবেদনে খুনের কারণটিও লেখা নেই; কিন্তু লোকটির যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তা মৃতের চেহারাতেই স্পষ্ট। লোকটির মৃত মুখে তীব্র আতঙ্কের স্থায়ী ছাপ ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন বলতে চাইছে- আমাকে মারবেন না, আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমাকে বাঁচান। অ্যাডওয়ার্ড মাঞ্চের সেই বিখ্যাত ‘চিৎকার’ ছবিটির মতো তার মুখেও একটা চিৎকারের ছাপ ছিল। দুদিন লোকজন এই রহস্যময় খুন অথবা মৃত্যু নিয়েও ফেসবুকে, টুইটারে নানা কথা বললো।
সাদিয়ার কথা বলার অবশ্য কেউ ছিল না এই শহরে। সাদিয়ার পরিবার বলে কেউ নেই, কিচ্ছু ছিল না। সে একা একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত। সে কোথায় যেতো কী করতো তেমন করে কেউ কিছু জানতো না। কেবল সাদিয়ার বাড়িঅলা জানলেন, তার এই ভাড়াটিয়া নিখোঁজ। নিয়ম মতো পুলিশকে জানান হলো; কিন্তু পুলিশও আর খুঁজে বের করতে পারল না নিখোঁজ হওয়া একটি নারী কিংবা দেবীকে। তা ছাড়া, এই শহরে পুলিশের অনেক কাজ আছে। একজন সাদিয়া নিখোঁজ হলে কি-ইবা আসে যায়।