
দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। ছবি: সংগৃহীত
সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার নোবেল এ কথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রতিবছরই সারা বিশ্বের সাহিত্যাঙ্গনের লোকজনের অপেক্ষা থাকে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য লেখকদের নিয়ে। অনেকে বিশ্বসাহিত্যাঙ্গন থেকে কে কে নোবেল পেতে পারে তার একটি তালিকাও করে ফেলেন। বিভিন্ন দেশে আলোচিতদের সাহিত্য নিয়ে আলোচনাও হয়। কিন্তু দেখা যায়, সব তালিকার নাম ছাপিয়ে এমন একজন পুরস্কার পেয়ে বসেন যিনি থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। নোবেল পুরস্কারই হয়তো তার পরিচিতির সূত্র বের করে দেয়। এমন ঘটনা যে ঘটে না তা কিন্তু নয়। তবে যিনি পান তিনি যে পুরোপুরি যোগ্য এ কথার সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই।
নোবেল পুরস্কারে ভূষিত দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। তাকে কেন এ পুরস্কার প্রদান করা হলো তার ব্যাখ্যায় নোবেল কমিটি বলেছে, হান কাংয়ের গদ্য তীক্ষ্ণ ও কাব্যময়। তার লেখায় ইতিহাসের যন্ত্রণাবিদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে বোঝাপড়ার প্রচেষ্টা রয়েছে; রয়েছে মানবজীবনের প্রতি পরিচ্ছেদে ভঙ্গুরতার কথাও। দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনিই প্রথম লেখক, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সাময়িকীতে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। পরের বছর গল্প সংকলন ‘ইয়েসু’ প্রকাশের পাশাপাশি শুরু করেন উপন্যাস লেখা।
‘রেড অ্যাঙ্কর’ নামে তার প্রথম উপন্যাসটিই সাহিত্য প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা জিতে নেয়। তার গল্পে সমাজের যে চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এবং তার গল্পের সঙ্গে লেখক ও পাঠকের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তারই ধারাবাহিকতায় হান কাং দীর্ঘকার গদ্য লিখতে শুরু করেন। ‘দ্য ভেজেটারিয়ান’ তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বইয়ের একটি। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের জন্য ২০১৬ সালে ‘ম্যান অব বুকার পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছিলেন। এ উপন্যাসে মানুষের নিষ্ঠুরতার নির্মম পরিণতির শিকার আতঙ্কিত এক তরুণীর ‘জড় বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার যে চিত্র হান কাং এঁকেছিলেন তা পাঠক-সমাজের মননে অনুরণন তুলেছিল। ‘গভীর কাব্যিক গদ্য, যা ঐতিহাসিক আঘাতগুলোকে উন্মোচন করে এবং মানবজীবনের নাজুকতাকে সামনে আনে’- এই অনন্য লেখনীশৈলীর জন্য তাকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালে তার উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এর জন্য বুকার প্রাইজ পেয়েছিলেন হান। এবার নোবেল পুরস্কার এলো তার ঝুলিতে। নোবেল কমিটির তরফে বলা হয়েছে, হানের গদ্যের মধ্যেও মেলে কবিতার ছন্দ। মানবজীবনের ভঙ্গুরতার কাহিনি, দেহ এবং মনের যোগ- এমন নানা বিষয় উঠে এসেছে হানের সাহিত্যে। এর আগে ২০২৩ সালে নরওয়ের লেখক ও নাট্যকার জন ফস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সাহিত্যে শুধু লেখা নয়, এখন সাহিত্যে আবিষ্কারের বিষয়টিও বড় করে দেখা হচ্ছে। হান কাংয়ের সাহিত্যে যে গীতিময়তা ও মানবজীবনের বহুমুখী সংকটের সূক্ষ্ম বর্ণনাশৈলী তার সাহিত্যকে করেছে গীতল, ছন্দময় ও প্রাণস্পর্শী।
হান কাং ২০১৪ সালে তার লেখা ‘হিউম্যান অ্যাক্ট’-এর প্রেক্ষাপট এ রকমই এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৮০ সালে গুয়াংজুতে বিক্ষোভ দেখিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু মানুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন পড়ুয়ারাও। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা, হিংসা, প্রতিরোধ উঠে এসেছিল ‘হিউম্যান অ্যাক্ট’-এ। হান কাং তার ‘উদ্ভাবনী নাটক ও গদ্য’-এর জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনের ঘটনা এটাই- যা অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোতে কণ্ঠ দেয়। তার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল’-এর জন্য ২০২৩ সালে ফ্রান্সে মডিসিস পুরস্কার পেয়েছিলেন। নোবেল কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, হানের লেখনীতে মানুষের মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণা উঠে এসেছে বার বার। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলে, তা বারবার খুঁজেছেন হান। তার পর তুলে ধরেছেন নিজের লেখনীতে। সেখানে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির যন্ত্রণা মিলেমিশে একাকার হয়েছে।
হান কাংয়ের গদ্যের কাব্যময় দিক ও বহুমাত্রিকতা, যার মধ্য দিয়ে দেখা যায় অনুসন্ধিৎসু মন মানুষের জীবনের নানা দিককে সাহিত্যশৈলীর মাধ্যমে এমনভাবে এগিয়েছে যে, তার সাহিত্যকর্মকে কোনো সীমানায় আটকানো যায় না। বাস্তব জীবনযাপনের ধারাপাতে তিনি সূক্ষ্ম গদ্যশৈলীর মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন সামাজিক সহিংসতা, মানুষের দুঃখকষ্ট ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা বিষয়-আশয়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য ভেজেটারিয়ান’ বুকার জয়ের পর ২০১৬ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেবোরাহ স্মিথ, যদিও প্রায় এক দশক আগে প্রকাশ হয়েছিল হান কাংয়ের এ খ্যাতনামা উপন্যাস। উপন্যাসটি ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করার মধ্য দিয়ে লেখক হিসেবে হান কাংয়ের জীবন পাল্টে যায়। এর পরই এক এক করে প্রকাশ হয় তার অন্য আরও কয়েকটি উপন্যাস- ‘দ্য হোয়াইট বুক’, ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ ও ‘গ্রিক লেসনস’ ইত্যাদি। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানে সুইডিশ এাকাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস মাম বলেছেন, শরীরের সঙ্গে আত্মার, জীবিতের সঙ্গে মৃতের যোগাযোগ নিয়ে হান কাংয়ের সচেতনতা অসাধারণ। তার গদ্য কাব্যিক ও নিরীক্ষায়। সমসাময়িক গদ্যসাহিত্যে তিনি একজন উদ্ভাবকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে জন্মেছিলেন হান কাং। এর পর সিউলে বসবাস শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্প, সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন তিনি। কাব্যচর্চায় ঝোঁক ছিল বরাবর। তার বাবাও একজন নামকরা ঔপন্যাসিক। গদ্য লেখার পাশাপাশি ছবি আঁকা এবং সংগীতচর্চাতেও সমান আগ্রহ রয়েছে তার।
নোবেল পুরস্কার বোর্ড তার পরিচিতি দিতে গিয়ে বলেছে, তিনি এমন একজন, যিনি সংগীত ও শিল্পকলার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। কোরিয়া টাইমসের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় হান কাং বলেছেন, নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেও তার আনন্দে তিনি পুরস্কার উদযাপন বা সংবাদ সম্মেলন করবেন না। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতসহ বিশ্বের করুণ সব পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বিশ্বে যখন যুদ্ধ বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর মানুষ নিহত হয়, তখন নোবেল পুরস্কার উদযাপন করার সময় নয়।’
হান কাং কোরিয়া টাইমসকে বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্বের এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে দয়া করে এই পুরস্কার বিষয়টি উদযাপন করবেন না। সুইডিশ একাডেমি আমাকে মজা করার জন্য এই পুরস্কার দেয়নি। এই ভূমিকার মধ্য দিয়ে তাকে বিশ্বের একজন দায়বদ্ধ লেখকের তালিকায় ফেলা যায়। যেসব যুদ্ধ নিয়ে সারা বিশ্ব চুপ তখন নোবেল বিজয়ী হান কাংয়ের এ বক্তব্য সারা বিশ্বের যুদ্ধাহত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে চলে যায়। একজন লেখক শুধু ভালো লেখক হলেই চলে না। বিশ্বের মানুষের প্রতি তার এই সমবেদনা ও দায়বদ্ধতা সারা বিশ্বের লেখকদেরও প্রাণিত করবে।