Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

দুয়ারে দাঁড়িয়ে হেমন্ত

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:০৫

দুয়ারে দাঁড়িয়ে হেমন্ত

দুয়ারে দাঁড়িয়ে হেমন্ত। প্রতীকী ছবি

বাংলা সনের হিসাব-নিকাশ এখন তেমন কেউ মনে না রাখলেও ঋতু বৈচিত্রের ধারায়  প্রত্যেকটি ঋতু বদলের সঙ্গে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন সেটি সার্বিকভাবেই মানুষকে আন্দোলিত করে। হেমন্তের এই দিন বদলের সাড়া মানুষ অনুভব করে। তবে গ্রামীণ জীবনে পঞ্জিকার প্রভাব এখনও রয়েছে। ফলে আজ যে হেমন্তের প্রথম দিন, আজ মরা কার্তিকের শুরু। আজ আকাশ স্থির হয়ে আছে। ধানের ক্ষেতে শিশিরের আল্পনা মুক্তো দানার মতো জ্বলছে। প্রকৃতিতে গাঢ় সবুজের মধ্য থেকে উঠে আসছে সোঁদা গন্ধ। পাওয়া যাচ্ছে মিষ্টি শীতের আমেজ। 

গ্রীষ্মের তাপদাহ নেই, নেই বর্ষার ঝরো ঝরো বাদল দিন, শীত  নেই, আমেজ আছে আবহ আছে- আজ হেমন্তের প্রথম দিন, আজ কার্তিকের শুরু। ঋতু বৈচিত্র্যের দোলাচলে বিদায় নিয়েছে শরৎ, গুটি গুটি পায়ে দুয়ারে এসেছে  হেমন্তের হেম বরণী দিন। কালের দোলাচলে আজ পয়লা কার্তিক, আজ হেমন্তের শুরু। শুষ্ক দিনের আবাহনপাতা  নিয়ে শীতের বার্তা ছড়াবে দ্রুতই। 

কবি জীবনানন্দের ভাষায় নবান্নের কার্তিক। তিনি লেখেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় / হয়তো মানুষ নয় হয়তোবা শাঁখচিল শালিকের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।’

এ ঋতুর রয়েছে অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য। সকালের শিশির ভেজা ঘাস মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অনুষঙ্গ। বৈচিত্র্যময় এ ঋতুতে চলে শীত-গরমের  খেলা। হেমন্তের শুরুর দিকে অনুভব হয় এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে আরেক অনুভূতি।  ভোরের আকাশে হালকা কুয়াশা, শিশিরে  ভেজা মাঠ-ঘাট। অন্যদিকে ধরণী হতে থাকে উত্তপ্ত। সৌন্দর্য এবং  বৈশিষ্ট্য অনন্য বাংলার ঋতুর রাণী  হেমন্ত। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে এ ঋতুতেই প্রধান ফসল ধান ঘরে ওঠে। সারা বছরের মহাজনের কাছ থেকে ধার নেওয়া পাওনা পরিশোধের সুযোগ হয় ফসল ঘরে ওঠার পরেই। সারা বছরের মুখের অন্নের জোগানও আসে এ সময়।   

শরতের পরে হেমন্ত এলে ব্যাপক বদল হয় প্রকৃতির আবহে- মানুষের জীবনযাপনে। গ্রামের পরিবেশে আনন্দ বিরাজ করে। গ্রাম্য মেলা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস বানানোর আয়োজন, ঢেঁকির শব্দ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রকৃতিকে বরণ করে নেয় হেমন্তে। এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, বকফুল।  খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হতে  দেখা যায় গাছিদের।  সে এক ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন আমেজ, ভিন্ন আবহ।

কাকডাকা সকালে অনেক এলাকায় এরইমধ্যে হালকা কুয়াশার পাতলুনের দেখা মেলে। ঘাসের ডগায় শিশিরের উপস্থিতি , দিগন্ত বিস্তৃত নিথর আকাশ কেমন স্থির তাকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা নামতেই শীত শীত এক অনন্য শিহরণ শুরু হয়েছে। দিনের সময় কমে এসেছে। দ্রুত অস্তাচলে নুয়ে পড়ে নিরুত্তাপ সূর্য। শরতের শেষ দিনগুলোর আবহ এখন মিইয়ে যায়নি। এরমধ্যেই  হেমন্তের আগমন ঋতুবতী কালের এ আরেক সীমান্ত কালের মিথষ্ক্রিয়া। 

দেশের উত্তরাঞ্চলের কোল ঘেঁষেই হিমালয়। এখানে শীতের আগমন ঘটে অন্যান্য এলাকার থেকে একটু আগেই। সেসব  জনপদে সন্ধ্যা নামতেই শীতের আবেশ আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশ মেঘলা হওয়ার পাশাপাশি রাতভর ঝরছে হালকা কুয়াশা। সেই কুয়াশা থাকছে সকাল আটটা অবধি। তাপমাত্রা নেমে এসেছে ২৩-২৪ ডিগ্রিতে।  তাপমাত্রা যত ডিগ্রিতেই নামুক এর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষেরা ছোটে কাজের খোঁজে। সড়ক-মহাসড়কে কুয়াশার কারণে গাড়ি বাতি জ্বালিয়ে চলতেও সংকটের মুখোমুখি হয়। হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক। একে অনেকেই মরা কার্তিক নামে বুঝতো। বিশেষত  দেশের উত্তরাঞ্চলের জনপদে এ সময় মানুষের জীবনের সবটুকু কষ্ট যেন উঠে আসতো। উত্তর জনপদে আকালের সন্ধানে ঢাকা থেকে গণমাধ্যমকর্মীরা যেতেন অভাবের সংবাদ সংগ্রহ করতে। মঙ্গার সচিত্র প্রতিবেদন উঠে এসেছে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ‘চিলমারীর এক যুগ’ বইয়ে। পুরো বইটি উত্তর জনপদের ক্ষুধার্ত মানুষের অভাব-আাকাল দুঃসময়ের বয়ান। হেমন্তের মরা কার্তিকের পরেই আসে অগ্রহায়ণ । হেম বরণী ধানে প্রকৃতি যেন হেমন্তের গান গায়। কৃষক ফসল কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কৃষকের আনন্দ ধারা ভর করে আসে নবান্ন। কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতির বাংলায় কৃষকের বিভিন্ন্ উৎসব শুরু হয়। কৃষকের এই হাসি খুশির দিন উঠে এসেছে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতানের দু’টি চরণ এরকম- ‘আজি এল হেমন্তের দিন/কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন’। অল্প কথায় বিশ্ববরেণ্য কবি বুঝিয়ে দিলেন  হেমন্তকে। শরৎ আর শীতের মধ্যস্থ ঋতু হেমন্তের না আছে শীতের কুহেলী, না আছে শরতের ভূষণ।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন-  ‘উত্তরীয় লুটায় আমার/ ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়।/ আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে/ নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়।/ ভাঁড়ির শীর্ণা নদীর কূলে/ আমার রবি-ফসল দুলে, /নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর/ চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়।’ 

(হৈমন্তী তেওড়া)

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫