Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

গোয়ের্নিকা

শত মানুষের আর্তনাদ লুকানো যে চিত্রে

Icon

সাফিন আহমেদ

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৫৮

শত মানুষের আর্তনাদ লুকানো যে চিত্রে

একটি চিত্রকর্ম। ছবি: সংগৃহীত

গোয়ের্নিকা, শত মানুষের আর্তনাদ লুকানো যে চিত্রে, চিত্রগোয়ের্নিকা, মাদ্রিদের কুইন সোফিয়া মিউজিয়ামে অবস্থিত ১৩৭.৪ বাই ৩০৫.৫ ইঞ্চি আকারের একটি চিত্রকর্ম। কিন্তু এটি শুধু একটি ছবিই নয়, ফ্যাসিবাদী ফ্রাংকোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক মৌন প্রতিবাদের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। পাবলো পিকাসোর অমর সৃষ্টি এবং আধুনিক শিল্পকলার এক শক্তিশালী প্রতীকী চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’। ১৯৩৭ সালে গৃহযুদ্ধ চলাকালে স্পেনের বাস্ক অঞ্চলের ছোট্ট শহর গোয়ের্নিকাতে জার্মান নাৎসি বাহিনীর বোমা হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ এই চিত্রকর্মটি সৃষ্টি করা হয়। 

সাদা-কালো এবং ধূসর রঙের মাধ্যমে আঁকা ‘গোয়ের্নিকা’ যুদ্ধের ভয়াবহতা ও মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞের একটি ভিজ্যুয়াল ভাষা প্রদান করে। পিকাসো এতে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কান্না, আহত পশু, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ি এবং ভাঙা অস্তিত্বের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এ চিত্রকর্মটি শুধু স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একটি মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। 

১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ। আর দশটা দিনের মতোই নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলেন স্পেনের বাস্ক প্রদেশের ছোট সাজানো গোছানো শহর গোয়ের্নিকার বাসিন্দারা। দিন শেষে সকলে যখন নিজ নিজ নীড়ে ফেরার আয়োজন করছেন, তখনই আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল যুদ্ধ বিমানের গর্জনে। শুরু হলো মুহুর্মুহু বোমা নিক্ষেপ। নিমিষেই তছনছ হয়ে গেল শহর। ফ্যাসিবাদী ফ্রাঙ্কোর রোষানলে পড়ে ক্ষণিকের ব্যবধানে মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গেল শহরের শত শত নিরীহ মানুষের। 

কথায় বলে, শব্দ যেখানে নীরব হয়ে যায়, শিল্প সেখানে কথা বলে। শিল্পী পাবলো পিকাসোর তুলির আঁচড়ে ঠিক তেমনি বিধ্বস্ত এ শহরের স্তূপের মাঝে জন্ম নিল এক অমর ছবি, গোয়ের্নিকা।

পিকাসো যখন ম্যুরাল তৈরি করবেন কি করবেন না, এ নিয়ে নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, এমন সময় স্প্যানিশ রিপাবলিক ও পিকাসোর বন্ধুমহল তাকে অনুরোধ করলেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে নয়, তিনি যেন ফ্যাসিবাদী ফ্রাঙ্কো ও স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের আসল রূপ তুলে ধরে একটি ম্যুরাল আঁকেন। 

এমতাবস্থায় ১৯৩৭ সালের ২৯ এপ্রিল তার চোখ পড়ল L'Humanite নামের এক পত্রিকার পাতায়। পত্রিকা পড়ে গোয়ের্নিকা শহরের নির্মম পরিণতির খবর জানতে পারলেন তিনি। হামলার ভয়াবহতা দেখে আত্মা কেঁপে ওঠে পিকাসোর। এমন হীন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ না করাও যে পাপ। ১৯৩৭ সালের মে মাসে পিকাসো তার ছবির স্কেচ শুরু করলেন।

নিজের সকল রাগ, ক্ষোভ, অভিমান উগরে দিলেন ছবির পটে। রঙ হিসেবে ব্যবহার করলেন কালো ও ধূসর। এ রঙ যেন কষ্টকে প্রতিনিধিত্ব করে। ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল কষ্টের মাঝে থাকা নারী, শিশু, ঘোড়া, ষাঁড়ের ছবি। এ যেন যন্ত্রণার বজ্রকঠিন প্রকাশ। শুরুতে জনপ্রিয় ছিল না এই চিত্রকর্ম ‘এটা কি ছবি নাকি জগাখিচুড়ি?’, ম্যুরালটি দেখে এমনই মন্তব্য করেছিলেন এক জার্মান সাংবাদিক। যথেষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষ না থাকায় ফ্রান্স সরকার তো এককথায় বাতিলই করে দিলেন ছবিটিকে। রাশিয়াও ছবিটির কোনো প্রশংসা করল না। প্যারিস ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশনে অনেকটা অপাঙ্ক্তেয় হয়েই পড়ে রইল এটি।

১৯৩৯ থেকে ১৯৫২, এই সময়ের মধ্যে গোয়ের্নিকার তাৎপর্য ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেন শিল্পবোদ্ধারা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এটি। গোয়ের্নিকাকে একনজর দেখতে ঢল নামে হাজারো মানুষের। 

কী আছে এতে?

গোয়ের্নিকার মূল প্রতিপাদ্য যুদ্ধ ও যুদ্ধের নির্মম পরিণতি। ছবির বাঁ পাশে আছে একটি শিশুর লাশ ধরে হাত বাড়িয়ে থাকা এক নারীর ছবি। তার ঠিক উপরে আছে রক্তচক্ষুর একটি ষাঁড়। ছবির মাঝখানটা জুড়ে আছে যন্ত্রণাকাতর এক ঘোড়ার প্রতিকৃতি। ঘোড়ার শরীরের উপর আবছাভাবে আছে একটি মানুষের মাথার খুলি।

ছবির উপরের অংশে আছে বিশালাকার একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব যা সূর্যের প্রতীকী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিটির নিচের দিকে খেয়াল করলে একটি কাটা হাত দেখা যায়, যেটি এখনও একটি ভাঙা তলোয়ার ধরে রেখেছে। ডানদিকে আছে দুটি নারীমূর্তি। এর মধ্যে একটি নারীমূর্তি তার শূন্য দৃষ্টি ফেলছে সামনের চলমান বিভীষিকার দিকে। অপর নারীমূর্তিটিকে দেখে মনে হবে হিংস্র কোনো পশুর করাল গ্রাসে তলিয়ে যাচ্ছে। 

গোয়ের্নিকার অর্থ

গোয়ের্নিকার অর্থ ও পিকাসো ছবিটির মাধ্যমে কী বুঝাতে চেয়েছেন, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। মতবিভেদটা মূলত ছবির ঘোড়া ও ষাঁড়টিকে নিয়ে। অনেকের মতে ঘোড়া ও ষাঁড় স্পেনের তৎকালীন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় এ দুটো প্রাণীকে পিকাসো তার ছবিতে ব্যবহার করেন। আবার অনেকের ধারণা ঘোড়াটিকে সাধারণ মানুষ ও বুনো ষাঁড়টিকে ফ্রাঙ্কোর প্রতীকী রূপে এঁকেছেন পিকাসো। তবে ছবিটি সম্পর্কে সকলেরই ঐকমত্য আছে, এ রকম কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গবেষক বেভারলি রে-এর লেখায়। তার মতে- গোয়ের্নিকায় ব্যবহৃত আকৃতিগুলো প্রতিবাদের। ছবিটি দুঃখ ও যন্ত্রণার, তাই পিকাসো কালো ও ধূসর রঙ ব্যবহার করেছেন। বৈদ্যুতিক বাল্বটির মাধ্যমে পিকাসো সূর্যকে চিত্রায়িত করেছেন। ছবির ভাঙা তলোয়ারটির মাধ্যমে শাসকের কাছে শোষিতদের পরাজয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

পিকাসোর নিজের মতামত

পিকাসো নিজে কী বলেছেন ছবিটির ব্যাপারে? পিকাসো বলেন, ঘোড়া হলো একটি ঘোড়া, ষাঁড় হলো একটি ষাঁড়। আপনি আমার ছবিতে কোনো অর্থ খুঁজে পেলে সেটিই সত্য, কিন্তু সেটি আমার আরোপিত নয়। আমি ছবির জন্য ছবিটি এঁকেছি। এঁকেছি যে যা, তাকে তা-ই ভেবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫