শচীন দেববর্মণের মৃত্যুবার্ষিকী
বাড়িটি সংরক্ষণে বাধা কোথায়

দীপংকর গৌতম
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:০৭

সঙ্গীতশিল্পী শচীনদেব বর্মণ। ফাইল ছবি
‘নীশিথে যাইও ফুল বনে’- মীরা দেববর্মণের লেখা গানটি শচীন দেববর্মণের গলায় শোনেননি এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। বাংলা গানের দিকপাল শচীন দেববর্মণের পৈতৃক ভিটে বা শৈশবের স্মৃতিময় বাড়িটি কুমিল্লা শহরে অবস্থিত। এখন এটি একেবারেই অযত্নে-অবহেলায় সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকায় শচীন দেববর্মণের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনটি অবস্থিত। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকায় রাজবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেববর্মণ। বাড়ির বাইরের দেওয়ালে একটি শ্বেতপাথরের খোদাই করা স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শচীন দেবের এই বাড়িতে একবার অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে এ বাড়িটি বাংলা গানের ইতিহাসের একটি মাইলফলক।
কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকার গোলপুকুরের দক্ষিণ পাড়ে এই বাড়িটি ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের ভাই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেববর্মণ বাহাদুরের। বাড়িটা ব্রিটিশ আমলের জমিদার বাড়ির আদলে তৈরি। এর গঠনশৈলী রাজপ্রাসাদের মতো না হলেও এটিই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেববর্মণ বাহাদুরের বাড়ি। কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার রাজা-মহারাজাদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনকেন্দ্র। সে কারণেই এ শহরে রানীর কুঠি, রানীর দীঘি, রাজবাড়ি গড়ে ওঠে। কিন্তু অবহেলা- অনাদরে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে সেসব স্বাক্ষর।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় শচীন পরিবারের সবাই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। এর পর থেকেই বেদখল হতে থাকে তাদের সম্পত্তি। এতবছর স্থায়ী হলেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাবে বাড়িটির এখন বেহাল। শচীন দেববর্মণের পিতা নবদ্বীপ কুমার দেববর্মণ বাহাদুর ত্রিপুরার রাজবংশ থেকে বিতাড়িত হয়ে কুমিল্লা নগরীর দক্ষিণ চর্থায় প্রায় ৬০ একর জায়গায় বাড়ি গড়ে তোলেন। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর এ বাড়িটিতেই জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেববর্মণ।
১৯৬৫ সালে শচীনের পৈতৃক ভিটার সামনের অংশে গোলপুকুর পাড়ে স্থাপিত হয় সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। বাড়িটির উপরে জনগণ এ সময় ঔৎসুক্য হারায়। ছায়াবৃত হয়ে পড়ে শচীন দেববর্মণের বাড়ি। ১৯৮২ সালে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমান কুমিল্লায় নজরুলের বিচরণস্থল আবিষ্কার করতে গিয়ে শচীন দেব বর্মণের বাড়ির বিষয়ে সন্ধান পান। ওইসময়েও খামারটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলেন কুমিল্লার সংস্কৃতি কর্মীরা। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৪ সালে সাবেক জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল বাড়ির সীমানার মূল অংশ (০.৮৩ একর) চিহ্নিত করে লাল পতাকা টানিয়ে দেন। ২০১৫ সালে বাড়িটি সংস্কারের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয়। পুরাতন কাঠামো ঠিক রেখে এর ওপর চুন-সুরকির প্রলেপ দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে শচীন দেববর্মণের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিন দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানেই তার বাড়িতে কমপ্লেক্স করার কথা জানানো হয়।
২০১৫ সালের পর কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জোয়ার আসে। ২০১৬ সালেও মেলা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে আবার যাহা পূর্বং তাহা পরং হয়ে যায়। বাড়িটির দায়সারা সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার পর গেটে তালা পড়ে।
জেলা প্রশাসন ছাড়াও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি সংরক্ষণ করে টিকিট ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু এ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর রহমানের বদলির পর সেটিও আর আলোর মুখ দেখেনি।
দিনে দিনে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় বাড়িটি একদম নাজুক অবস্থায়। সদর দরজার সঙ্গে ঘরের মাঝামাঝিতে বারান্দা আকৃতির তিনটি কক্ষ। বারান্দার মতো কক্ষগুলোর পলেস্তরা খসে পড়ছে। বাড়ির সীমানা প্রাচীরে অঙ্কিত আলপনা মুছে যাচ্ছে। কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মীদের দাবি শচীন দেববর্মণের বাড়িটি কমপ্লেক্স করা হোক। কিন্তু আদৌ তা হবে কী? এ বাড়িটি সংরক্ষণ করতে বাধা কোথায়?