Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

কমলকুমার মজুমদার আর্টের সব শাখার মহত্তম স্রষ্টা

Icon

ওবায়েদ আকাশ

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৭

কমলকুমার মজুমদার আর্টের সব শাখার মহত্তম স্রষ্টা

কমলকুমার মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

এক বিরল ভার্সাটাইল স্রষ্টা কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একবার জানতে চেয়েছিলেন কমলকুমারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের কাছে। জবাবে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘কমলকুমার নোজ অল দ্য আর্টস’।

নতুন করে যদি জিগ্যেস করি, কমলকুমার কি শুধুই একজন ক্ল্যাসিক কথাসাহিত্যিক ছিলেন? তার সম্পর্কে উৎসুকমাত্র জানেন, তিনি, কমলকুমার, এই সব্যসাচী ছিলেন। ছিলেন সংগীত ভাবুক, গণিতবিদ, নাট্যকার, পরিচালক, চিত্রকর, সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, দার্শনিক, ভাবুক, লোকসাহিত্য গবেষকসহ আর্টের আরও আরও শাখার মহত্তম স্রষ্টা। আসলে কমলকুমার ছিলেন এমনই একজন ক্ল্যাসিক শিল্পী যার সবকিছুই ছিল অনুসরণ করার মতো। এবং সেভাবেই তিনি পূজিত হয়েছেন। এটাও বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের পরই কমলকুমার। শিল্পের নানা শাখার সমঝদারগণ এই স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেছেন নানানভাবে, নানান শিল্পকলায়। পারদর্শিতায়। 

তার সম্পাদনা জগতের ইতিহাস জানলেও বিস্মিত হতে হয়। তার লিটল ম্যাগাজিন চর্চার যে বহুমাত্রিকতা, সেখান থেকেও তার ভাবনা ও জ্ঞানবৈচিত্র্যের সক্ষমতার ধারাটি পরিষ্কার। তিনি সম্পাদনা করেছেন বিচিত্র ধরনের লিটল ম্যাগাজিন। অঙ্ক বিষয়ক পত্রিকা ‘অঙ্কভাবনা’, গোয়েন্দা পত্রিকা ‘তদন্ত’ এবং সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘উষ্ণীষ’ সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি এটা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন যে, আসলে এসব লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার ক্ষেত্রে তার বিকল্প বিরল। প্রতিটি সম্পাদনার ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে, এই সম্পাদনা কর্মটির জন্য কমলকুমারই অদ্বিতীয় ব্যক্তি। যেভাবে তিনি তার গল্প ও উপন্যাসের ভাষা ও স্বর সৃষ্টিতে এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তার গদ্য ভাষাটা এমনই যে, অনেকে তাকে বাংলা ভাষা বলতেও দ্বিধাবোধ করতেন। তা এতটাই ক্ল্যাসিক ও এতটাই স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। একবার দেবেশ রায় তার এক রচনায় বলেছিলেন, ‘তাহলে কমলকুমারের বই আজকাল বাংলা বই বলে গণ্য হচ্ছে, মাত্র এই সেদিনও যে বাংলা নয় এ নিয়ে কত গবেষণা দরকার ছিল।’

কমলকুমার যত না লিখেছেন, আলোচনা হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ। এই আলোচনাগুলো এমন সব বিখ্যাত পণ্ডিতের কলম থেকে বেরিয়েছে, যা কখনো অগ্রাহ্য করা যায়নি। সবাই তার ভাষা ও আখ্যানের প্রশংসাই করেছেন। তবে কমলকুমারের পাঠক সবাই নন। তার পাঠক সংখ্যা হাতেগোনা। আর তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন লেখক। এবং এই যে নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠক, তারা কিন্তু সাধারণ পাঠক নন। কেননা গড়পড়তা পাঠক তার গদ্যের বাকল খুলে ভিতরের শাঁস নিতে পারেন না। প্রস্তরবৎ এই ভাষার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ছিল কমলকুমারীয় রহস্য। এ রহস্য একবার যে ভেদ করতে পেরেছেন, তিনি আর তাকে ছাড়তে পারেননি। তার এক রচনা টেনে নিয়ে গেছে অন্য রচনায়। তাই কমলকুমারের পাঠকদের মধ্যে যদি আলাদা এক আভিজাত্য থেকেও থাকে, তার যৌক্তিকতাও ততোধিক। 

কমলকুমার কলোনিয়াল মডার্নিজমকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলা যায় এটিও তার রচনারীতির স্বাতন্ত্র্যের একটি অনন্য দিক। তিনি যে আধুনিক-পূর্ব কালের প্রকৃতিগত, ঐতিহ্যগত স্বদেশীয় বিশ্বাসকে গভীরভাবে তার চেতনায় ধারণ করেছিলেন, তাকেই তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন। তাতে তার নিজস্ব রচনাশৈলীতে ঠাঁই পেয়েছে আপন ভূখণ্ডের জনজীবনের সরলতা, বিশ্বাস, আচার, সংস্কারের মতো সামগ্রিকতা। যে পাশ্চাত্য আগ্রাসন আমাদের জীবন যাপনে প্রবল দাপটে বিস্তার করে চলেছে, তিনি তা অনুধাবন করেছিলেন গভীরে, এবং এসবের প্রত্যাঘাত হিসেবে তিনি বারবার পুনর্ব্যক্ত করেছেন আমাদের মায়া, স্নেহ, সারল্য ও বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠাকে। কমলকুমারের প্রথম গল্প ‘লালজুতো’তেই এসবের সুস্পষ্ট বর্ণনা লক্ষ্যযোগ্য। তার পরবর্তী রচনাবলি নানা বাঁকে বিস্তার পেলেও তিনি স্বচিন্তিত অবস্থান থেকে সামান্যতম সরে আসেননি। তার এই দৃঢ় অবস্থান ও ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যের কারণে তিনি আজও পর্যন্ত সাধারণ্যে জনপ্রিয়তা পাননি। এ ছাড়া তিনি অনর্গল এক্সপেরিমেন্ট, ভাঙচুর, বিকল্পায়ন করতে পছন্দ করতেন। এটিও তার অনন্য স্বকীয়তা। এ কারণে তাকে বলা হতো দুরূহতম ও দুর্বোধ্যতম লেখক। তবে কমলকুমার যে তার লেখালেখির কারণে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা চেয়েছিলেন এমন কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না। 

তার প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বোদ্ধা পাঠক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পায় গভীরভাবে। তবে এ বইকে আশ্রয় করে চলচ্চিত্র নির্মিত হলে, তার নির্দিষ্ট পাঠকের বাইরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এখনো পর্যন্ত ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ও কমলকুমার মজুমদারের নামটি পাঠক মহলে পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। নিবিষ্ট পাঠকসত্তাকে তিনি আকৃষ্ট করেন তার আরও একটি উপন্যাস ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এর মাধ্যমে। কমলকুমার কতটা নিমগ্ন ও অগভীরতা সন্ধানী লেখক ছিলেন, এই উপন্যাসটি তার অন্যতম প্রমাণ হতে পারে। এই ২৫০ পৃষ্ঠার উপন্যাসে তিনি যতিচিহ্ন ব্যবহার না করে এক ব্যাক্যে শেষ করেছেন। তার গোলাপ সুন্দরী, অনিলা স্মরণে, শ্যাম নৌকা, পিঞ্জরে বসিয়া সুখ, খেলার প্রতিভা উপন্যাসগুলিও পাঠের জন্য ব্যাপক নিবিষ্টতা দাবি করে। যেখানে সাধারণ পাঠকের প্রবেশের সুযোগ নেই বললেই চলে। ‘তাকে যে লেখকদের লেখক’ বলা হতো, তা বুঝি এসব কারণেই। 

কমলকুমার মজুমদারের বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘নিম অন্নপূর্ণা’। উপন্যাসের বাইরে মূলত এ গ্রন্থেই তার গল্পের জাদুকরী ভাষার খনির সন্ধান মেলে। একই সঙ্গে তার গল্পে ডিটেইলের ব্যবহারও আমাদের বিস্মিত করে। সন্ধান পাই তার নিজস্ব ইমেজ ও বর্ণনার। এ নিবন্ধে উচ্চারিত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণের জন্যও তার একটি রচনার উদ্ধৃতি জরুরি মনে করি। এখানে তার ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্প থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা যাক :

“যূথী বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবুজ পাখীটির ঘোরাফেরা দেখছিল। এ সময় তার হাত দুটি অদ্ভুতভাবে উঁচু করা ছিল, এ কারণ, যে ফ্রকটি তার পরনে ছিল সেটিতে একটিও বোতাম নেই এবং বোতামের জায়গা থেকে সোজা শেষপর্যন্ত ছিঁড়ে দু’হাত খোলা, ফলে বেচারীকে সর্বক্ষণই সাধারণভাবে চলাফেরার সময় তার আপনকার হাত দুটিকে উঁচু করে রাখতেই হয়, এতে করে মনে হয় তার ভারি আনন্দ হয়েছে।... সম্মুখের টিয়া কেমন পঙ্কবিস্তার করে- কেমনে পঙ্কবিস্তার করত লাল ঠোঁট দ্বারা কী যেন বা পাখাতেই খোঁজে, এসবই তার নজরে পড়ছিল।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫