
বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প বইয়ের প্রচ্ছদ।
শিল্প শুধু সুন্দরেরই আধার নয়, কদর্যেরও ধারক। মাঝে মাঝে তা কেবল সুন্দরের রূপে দেখা দেয়। কিন্তু দূরের দিগন্তে তাকালে, কিংবা অন্যপিঠে দেখলে তখনই না ধরা পড়ে তার পূর্ণাঙ্গ রূপ। এভাবেই একজন শিল্পী যখন তার নিজের কথা বলেন, নিজের কথা শোনাতে চান, তার যাপিত জীবন নিয়ে তুলে ধরেন শিল্পের আধারে- তখনই দেখা যায় আসল জীবন ও পৃথিবীর রূপ। যেন জীবনের মধ্যে আরেক জীবনের বিনির্মাণ।
কথাগুলো মনে হলো সম্প্রতি প্রকাশিত বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প নামীয় গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো পাঠের পর। লিখেছেন এমরান কবির। প্রকাশিত হয়েছে অনুপ্রাণন প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন।
গল্পগুলো বিশেষ অর্থে নতুন নয়- চেনা সুরে বাজা রাগিণীর মতোই। কিন্তু কোথায় যেন কী আছে, যা ভাবনার গভীরে টেনে নিয়ে যায়। পাঠক যেন সেখানে নিজেকেই দেখতে পায়। এভাবে লেখক নিজের অনুভূতি পাঠকের অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে দেন। বইটিতে মোট দশটি গল্প রয়েছে। দশটি গল্প যেন দশদিগন্ত। কারণ এর বিষয় বৈচিত্র্য। প্রথম গল্প ‘বিভাজন অথবা নন্দ নাদের টুপি’তে লেখক ধর্মের বিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমন্বয়ের কথা বলেছেন। সকল বিভাজনের ঊর্ধ্বে যে মানবতা- তারই জয়গান গেয়েছেন। আর স্বার্থের ক্ষেত্রে যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সমান- তাও দেখিয়েছেন। বিভাজনের বিপরীতে তিনি সমন্বয়ের এমন এক স্বপ্ন দেখেন তা দেখে অভিভূত হতে হয়। গল্পের শেষ অংশ থেকে, ‘যেতে যেতে আরো দেখি নন্দ নাদের ডান পাশে আমার বাবা। তাঁর সাথে এলাকার সব মুসলিম হেঁটে যাচ্ছে। আমি দেখি নন্দ নাদের বামপাশে তাঁর জ্ঞাতি গোষ্ঠী। তারাও হেঁটে যাচ্ছে। তাঁরা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে একটা মাঠের দিকে। সে-মাঠ জুড়ে সবুজ আর সবুজ। আর গাছের ফাঁকে উকি দিচ্ছে একটি লাল সূর্য।’
বলবার অপেক্ষা রাখে না এমরান কবিরের মূল অভিষ্ঠ্য কী। ‘হাঁস’ গল্পে তিনি যেন দারিদ্র্যের ধারাপাত রচনা করেছেন। ‘ডাবঘর’ গল্পে বৃদ্ধ পিতার প্রতি সন্তানের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন। ‘বিবর্ণ পাতার ভোরে’ দেখিয়েছেন একজন সংগ্রামী নারীর জীবন। ‘জুতা’ গল্পে প্রতীকীভাবে দেখিয়েছেন এই সমাজের রূপ। ‘স্বপ্ন ও বিপন্ন বিস্ময়’ গল্পে দেখিয়েছেন অব্যখ্যায় রহস্যের অনন্ত জিজ্ঞাসা। ‘ভ্রম ও বিভ্রম’ গল্পে দেখিয়েছেন মানবজীবনের প্রকৃত আয়না। আর নামগল্প ‘বৃষ্টি ও নাকফুলের গল্প’-এ দেখিয়েছেন কর্পোরেট দুনিয়ার নানাবিধ নগ্ন নির্লজ্জ কৌশল।
ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে, ‘এখন। আশেপাশে তাকালে এমন কিছু দেখা যাচ্ছে যা ধারণ করা যাচ্ছে না। বরণও করা যাচ্ছে না। নিস্তারও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সয়ে যেতে হচ্ছে।’ গল্পগুলো পাঠান্তে এই কথাগুলোকে একটুও মিথ্যা মনে হয় না।