Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মাইকেলের অনিবার্য বাঙালিত্ব

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:১২

মাইকেলের অনিবার্য বাঙালিত্ব

মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ছবি: সংগৃহীত

মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাঙালিত্বটি স্পষ্ট। এর খবর বিদ্যাসাগর যেমন রাখতেন, তেমনি রাখতেন বঙ্কিমচন্দ্র। অজ্ঞাত ছিল না মধুসূদনের নিজেরও। কবির মৃত্যুর পরে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘আজ বঙ্গভূমির উন্নতি সম্বন্ধে আর আমরা সংশয় করি না; এই ভূমণ্ডলে বাঙ্গালী জাতির গৌরব হইবে। কেননা বঙ্গদেশ রোদন করিতে শিখিয়াছে, অকপটে বাঙালী, বাঙালী কবির জন্য রোদন করিতেছে।’ আরও বলেছেন, ‘ভিন্ন ভিন্ন দেশে জাতীয় উন্নতির ভিন্ন ভিন্ন সোপান। বিদ্যালোচনার কারণেই প্রাচীন ভারত উন্নত হইয়াছিল, আবার উন্নত হইবে। কাল প্রসন্ন-ইউরোপ সহায়-সুপবন বহিতেছে। জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাওজ্জতাহাতে নাম লেখা শ্রী মধুসূদন।’

বঙ্কিমের এই জয়ঘোষণা তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এখানেও পূর্বসূরী মধুসূদনের সঙ্গে উত্তরসূরী বঙ্কিমের একটা দূরত্ব চোখে পড়বার মতো। বঙ্কিম অবশ্যই বাঙালী, কিন্তু তিনি আবার ভারতীয়ও। যে-কারণে তিনি বাংলার উন্নতিকে ভারতের উন্নতি থেকে আলাদা করে নয়, সংলগ্ন করেই দেখেছেন, এবং তাঁর ভারতীয় পরিচয় হিন্দু পরিচয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছে। অপরদিকে মধুসূদন নিজের ভারতীয় পরিচয় সম্পর্কে যে অসচেতন ছিলেন তা নয়, কিন্তু বাঙালিত্বই ছিল তাঁর কাছে প্রধান। 

মধুসূদন হিন্দুত্ব বিষয়ে মোটেই উৎসাহী ছিলেন না। তাঁকে কেবল অসাম্প্রদায়িক নয়, ধর্মনিরপেক্ষই বলতে হয়। এর মূল কারণ এটা নয় যে, তিনি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিলেন; মূল কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইহজাগতিক ও অসাম্প্রদায়িক। তাঁর মহাকাব্যে রাম প্রধান চরিত্র নয়, প্রধান চরিত্র হচ্ছে রাক্ষসকূলের রাবণ ও মেঘনাদ। বাল্মীকির রামায়ণে রামের যে সাহসী ও ধীসম্পন্ন চরিত্র পাওয়া যায়, মেঘনাদবধ কাব্যে সেটি অনুপস্থিত। তবে যতই যা হোক রাবণ একজন রাক্ষসই, তার সে-পরিচয় নাকচ করে দেওয়া সম্ভব নয়। রাবণের আছে দশটি মুখ ও বিশটি হাত। সীতাকে অপহরণ ও বন্দী করে সে দুরাচারী বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমন একটি চরিত্রকে মানুষের মূর্তিতে বীর হিসেবে দাঁড় করানোটা কঠিন; মধুসূদন চেষ্টা করেছেন তাকে কেবল মানবিক নয়, রামের তুলনায় উন্নত হিসেবে তুলে ধরতে। রাম ও তার দলবলকে তিনি যে পছন্দ করেন না সে-কথা তিনি একটি চিঠিতে পরিষ্কার বলেছেন, এবং মেঘনাদবধ কাব্যে মোটেই সে-সত্যটি অবগুষ্ঠিত থাকেনি। রাম এখানে সুযোগ পেলেই নিজেকে ভিখারী বলে উল্লেখ করে এবং অসংশোধনীয়রূপে আত্মকরুণায় ভোগে। তার নির্ভরতা নিজের শক্তির ওপর নয়; দেবদেবীদের অনুগ্রহ, বানর সৈন্যদের সহায়তা এবং বিভীষণের দেশদ্রোহিতার ওপর। 

মাইকেল সম্পর্কে বঙ্কিমের উদ্ধৃতিটির দ্বিতীয় অংশে ইউরোপের সহায়তার প্রসঙ্গ এসেছে। ওই সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে, এবং সুপবন বইছে, কাজেই পতাকা উড়বে বলে বঙ্কিমচন্দ্র ভরসা করেছেন। ইউরোপের সহায়তার ব্যাপারে মধুসূদনের আগ্রহ ও উৎসাহ মোটেই কম ছিল না; দৃশ্যত সেটা বরঞ্চ ছিল ভীষণ উগ্র। তিনি ইংরেজি ভাষায় কবিখ্যাতি অর্জন করতে চেয়েছিলেন, চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছে যে, ওই পথ ভ্রান্ত, তাঁকে বাংলা ভাষার কবিই হতে হবে, এবং সেটাই তিনি হয়েছেন। বাঙালী কবি হওয়ার জন্য ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে তিনি অনেক কিছু দু’হাতে গ্রহণ করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য তিনি পড়েছেন। তাঁর সামনে মিল্টন ছিলেন, যেখান থেকে অমিত্রাক্ষর ছন্দে মহাকাব্য লেখার ধারণাটা পেয়েছেন। আদর্শ হিসেবে ছিলেন স্বয়ং হোমার, যাঁকে তিনি ইউরোপের একাংশের বাল্মীকি মনে করতেন। মেঘনাদবধ কাব্যে হোমারের ইলিয়াড-এর 

প্রভাব মোটেই অস্পষ্ট নয়।  হেক্টর বধ নামের একটি রচনায় ইলিয়াড-এর উপাখ্যানকে তিনি বাংলায় উপস্থিত করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তাঁর ওই উপস্থাপনায় উল্লেখ আছে যে, হেক্টরকে ট্রয়ের মেঘনাদ বলা যেতে পারে। মধুসূদনের নাট্যরচনায় শেকস্পীয়রের প্রভাব রয়েছে, সনেটে পেত্রার্কের। কিন্তু সবই সহায়তা, ঋণ নয়। এই সহায়তা তাঁকে মোটেই নত করেনি।

দুই

মধুসূদন যে মনেপ্রাণে বাঙালী ছিলেন সে-সম্পর্কে তাঁর উক্তিগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক। নিজের সমাধির জন্য যে-লিপিটি তিনি তৈরি করে রেখেছিলেন সেটি সুপরিচিত। তাতে তিনি মাইকেলের কথা বলেননি, দত্তকুলোদ্ভব কবি মধুসূদন হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন, জন্ম যার যশোহরের সাগরদাঁড়িতে, জন্মদাতা রাজনারায়ণ, জননী জাহ্নবী। বিদেশে বসবাসরত অবস্থায় যে সনেটগুলো তিনি লিখেছিলেন তাদের ভেতর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বঙ্গভাষা-বিষয়ক রচনাটি; যেখানে তিনি বলছেন যে বাংলা ভাষার ভাণ্ডারে আছে বিবিধ রতন, এবং সে-সব উপেক্ষা করে পর-ধন-লোভে মত্ত হয়ে পরদেশে ভ্রমণ করেছেন দেখে নিজেকে তিনি ধিক্কার দিচ্ছেন। তাঁর চোখে তাঁর নিজের আচরণ ছিল ভিক্ষুকের। এ যেন শৈবাল নিয়ে খেলা-করা, কমল-কাননকে উপেক্ষা করে। সৌভাগ্যক্রমে কুললক্ষ্মী তাঁকে উপেক্ষা করেননি, বরঞ্চ স্নেহ করেছেন, স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে বলেছেন, ‘যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে।’ সে-আজ্ঞা তিনি পালন করেছেন, এবং বিনিময়ে যা লাভ করেছেন তা হলো মাতৃভাষারূপ খনি, ‘পূর্ণ মনিজালে।’ ভিক্ষাবৃত্তি তাঁর কাছে গ্লানিকর ও দুঃসহ বোধ হয়েছে। প্রবাসে থাকাকালে তিনি তাঁর গ্রামের নদী কপোতাক্ষের কথা স্মরণ করেছেন, এবং তাঁর মনে হয়েছে যে বহু দেশ ও বহু নদী তো দেখলেন, কিন্তু স্নেহের তৃষ্ণা কি মেটে অন্য কারো জলে, ‘দুগ্ধস্তনরূপী’ ‘জন্ম-ভূমি-স্তন’ ভিন্ন? সনেট-সংগ্রহের শেষ কবিতাটিও বাংলা ভাষাকে নিয়েই। 

তাঁর গীতিকবিতাগুলোর একটিতে প্রবাসী কবি বঙ্গভূমির কাছে যে নিবেদনটি জানিয়েছেন সেটা হৃদয়স্পর্শী; ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।’ আসলে বাইরে যতই সাহেবী ও বিদেশি হোন না কেন ভেতরে, অর্থাৎ যেখানে তিনি শিল্পী সেখানে, তাঁর দাঁড়াবার জায়গাটা ছিল দেশের ভেতরেই, সেখানে তিনি অসংশোধনীয়রূপে বাঙালী। এ বিষয়ে তাঁর নিজেরই একটি সাহিত্য-বহির্ভূত উক্তি আছে, যেটি তিনি করেছিলেন ১৮৭১ সালে, ঢাকায়, একটি সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। বলেছিলেন, ‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের যে কোনো ভ্রমই হোক আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি হওয়া ভারি অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ও শয়ন করিবার ঘরে একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি এবং আমার মনে সাহেব হইবার যেমনি লোভ হয় অমনি আর্শিতে মুখ দেখি। আরো, আমি শুধু বাঙ্গালী নহি, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।’

এই বাঙালীর বঙ্গভূমি তাঁর রচনার এমন স্থানেও পাওয়া যাবে যেখানে তা অপ্রত্যাশিত। যেমন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে, যেখানে ঘটনার মূল হচ্ছে ধবলগিরি, হিমাদ্রীর শিখরে। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনায় কবি উপস্থিত করেছেন বাংলার শাল তাল নারিকেল গুবাক চালিতা জাম তেঁতুল কাঁঠাল, এসব গাছকে। মেঘনাদবধ কাব্যেও বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাপনের অনুষঙ্গ উপস্থিত রয়েছে। যেমন, স্বর্গের বর্ণনায় আছে, “ডাকিল ফিঙ্গা, আর পাখী যত”; রয়েছে বঙ্গে শারদ-পার্ব্বণের আনন্দ্যোৎসবের তুলনা। অপরদিকে লঙ্কায় প্রভাতবেলায় যে বাজনা শোনা যায় সে যেন বঙ্গগৃহে দেবদোলৎসব বাদ্য। প্রমীলা অসামান্যা নারী, রাক্ষসকূলবধূ, তার সিঁথিতে দেখা যায় সিঁদুর; সে মেয়ে যেমন পতিভক্ত তেমনি শ্বাশুড়ীর প্রতি দায়বদ্ধ। সুরমাকে দেখি সীতার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে। যোদ্ধাবেশে প্রমীলা যাবে স্বামীর কাছে, যাওয়াটা কঠিন, রামের বাহিনী লঙ্কাপুরী ঘিরে রেখেছে, কিন্তু প্রমীলা যাবেই, প্রয়োজনে শত্রু সেনাদের বধ করবে, বাহুবলে পরাজিত করবে রামকে। কিন্তু সেই সঙ্গে কটাক্ষ করে জানায় সে তার সঙ্গীদেরকে যে তার কৌতূহল আছে রামকে দেখার, ‘দেখিব যে রূপ দেখি সূর্পণখা পিসী/মাতিল মদন-মদে পঞ্চবটী-বনে।’ প্রমীলার মহিলা দূত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। সেও বৈরীপক্ষের দিকে কটাক্ষপাতের সুযোগ ছাড়ে না। লক্ষ্মণ যখন অন্যায় যুদ্ধে নিরস্ত্র, প্রার্থণারত মেঘনাদকে দৈববলে বলী হয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে এবং অসহায় মেঘনাদ হাতের কাছে যা পাচ্ছেজ্জশঙ্খ, ঘণ্টা, উপহার সামগ্রীজ্জসব লক্ষ্মণের দিকে ছুঁড়ে মারছে তখন লক্ষ্মণের কিছুই হচ্ছে না, কেননা অদৃশ্য অবস্থায় থেকে মায়াদেবী নিক্ষিপ্ত বস্তুগুলোকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, ঠিক যে-ভাবে একজন বঙ্গবাসী মাতা ‘খেদায় মশকবৃন্দ সুপ্ত সূত হতে/করপদ্ম সঞ্চালনে।’ এর পরে লক্ষ্মণের অস্ত্রাঘাতে মেঘনাদ দেবালয়ের মেঝেতে পড়ে গেছে; কবি বলছেন তার রুধির ‘বহে বরিষার কালে যথা জলধারা’। সমুদ্রের বর্ণনাতেও বর্ষার উপমা আছে, ‘বহিছে জলস্রোত কলরবে/স্রোতঃপথে জল যথা বরিষার কালে।’ মেঘনাদবধ কাব্যের সমাপ্তি মেঘনাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আর্দ্র অশ্রুনীরে রক্ষোদল লঙ্কায় ফিরে গেছে, এবং তার পরে, ‘বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে/সপ্ত দিবা-নিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিপদে।’

অন্যত্র উপমা আছে জলশূন্য নদীর এবং বাঁধ-ভাঙা জলস্রোতের। খুবই অপ্রত্যাশিত একটি উপমা পাওয়া যায় প্রথম স্বর্গে। সেখানে পুত্রশোকে কাতর রাবণ বিলাপ করছে। অন্যসব কথার মধ্যে বলছে সে ‘বরজে সজারু পাশে যথা/ ছিন্ন ভিন্ন করে তারে, দশরথাত্মজ/ মজাইল লঙ্কা মোর।’ তুলনাটি পানের খেতে সজারুর ধ্বংসলীলার। অনুমান করা হয় যে কবি অসতর্ক ছিলেন, নইলে স্বর্ণলঙ্কায় বাংলার পানচাষ এভাবে প্রবেশাধিকার পায় কী করে। কিন্তু সত্য এটাই যে মধুসূদনের পক্ষে বাংলাকে ভোলাটা সম্ভব ছিল না। 

এই মহাকাব্যে মধুসূদনের অভিপ্রায় ‘বীর রসে ভাসি’ মহাগীত গাইবার। মহাগীত তিনি অবশ্যই গেয়েছেন, তবে বীর রসের নয়, করুণ রসের বটে। মেঘনাদবধ কাব্যের সমাপ্তি নয় শুধু, সূচনাও করুণ রসের ভেতর দিয়েই। এ কাব্যে বীরত্ব আছে অবশ্যই, কিন্তু কান্নাই প্রধান সত্য। শুরুতেই দেখি মহাবীর রাবণ পুত্র বীরবাহুর শোকে ক্রন্দনরত। সমাপ্তি রাবণসহ লঙ্কাবাসীর অবিরল অশ্রুপাতে। এ কাব্যে সীতা কাঁদে, রাম কাঁদে, কাঁদে প্রমীলা ও মন্দোদরী, কাঁদে বীরবাহুর মাতা চিত্রাঙ্গদা, কাঁদে লঙ্কাবাসী, এমন কি দেশদ্রোহী বিভীষণকেও দেখা যায় কাঁদতে। দেবরাজ ইন্দ্র কাঁপে ইন্দ্রজিতের ভয়ে। 

এই যে বীররসের কাব্য তিনি রচনা করতে পারলেন না এর কারণ যে কেবল ব্যক্তিগত তা বোধ হয় নয়; ধারণা করা অসঙ্গত নয় যে, এর সঙ্গে জাতিগত অপারগতাও জড়িত। বাঙালী তখন পরাজিত জাতি, মধুসূদনদের মতো অসাধারণ মানুষদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও তখন ইংল্যান্ডে যাওয়া ও ব্যারিস্টার হওয়ার সঙ্কীর্ণ বলয়ের বাইরে যেতে অপারগ। সেকালে মেধাবানদের পক্ষে জীবিকার সরল পথ ছিল একটাই, সরকারি চাকরি। মধুসূদন সরকারি চাকরিতে উৎসাহী ছিলেন না, যে জন্য তিনি বিলেতে আইসিএস হবার জন্য যাননি, গেছেন ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য। কিন্তু উপনিবেশের বাস্তবতা এমনই যে তখন ট্র্যাজেডি রচনা করাটাই স্বাভাবিক ছিল, মধুসূদনও সেটাই করেছেন, মহাকাব্যের ভেতরে ট্র্যাজেডিকে স্থাপন করেছেন। রাবণের যে চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন, সেটি বাল্মীকির নয়, একান্তই তাঁর নিজস্ব। আর ওই চরিত্রের মহিমা এইখানে যে, সে একটি ট্র্যাজেডির নায়ক, যে-ট্র্যাজেডি একাধারে ব্যক্তিগত ও জাতীয়। রাম ও তার বানরবাহিনীর দ্বারা যারা পর্যুদস্ত হচ্ছে তারা কোনো একটি পরিবারের সদস্য মাত্র নয়, তারা সমগ্র লঙ্কার প্রতিনিধি। তাদের দুঃখে তাই সমস্ত লঙ্কা শোকাভিভূত হয়, তাদের বীরত্বে যেভাবে উদ্দীপ্ত হয় দেশের সমগ্র জনসাধারণ। 

লক্ষণীয় যে কেবল মেঘনাদবধ নয়, তাঁর অধিকাংশ রচনাই দুঃখে ভারাক্রান্ত, যদিও ব্যক্তিগত জীবনে মধুসূদন ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী ও অপরিমেয় দুঃসাহসী। জাতিগত অবস্থাটা ছিল বীরত্বহীন ও হতাশাগ্রস্ত। তাঁর সময়ে খুব বড় একটা ঘটনা ঘটে, সেটা হলো ১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থান। কিন্তু বাঙালী মধ্যবিত্তের মনে সে অভ্যুত্থান কোনো ইতিবাচক সাড়া তৈরি করেনি। ওই মধ্যবিত্ত বরঞ্চ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিল, নিজেদের স্বার্থে। 

মাদ্রাজে আট বছর খ্রিস্টান ও ইংরেজদের সংস্রবে কাটিয়ে মধুসূদন কলকাতায় ফেরেন ১৮৫৬ সালে, সেখানে ছিলেন ১৮৬২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তাঁর কোনো রচনাতে তো নয়ই, চিঠিপত্রেও ১৮৫৭-এর উল্লেখ মাত্র নেই। তবে এটা মোটেই বিস্ময়কর নয়, বরঞ্চ খুবই স্বাভাবিক। কেননা যে সমাজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তারা সিপাহীদের কাজটাকে মোটেই শুভ বলে ধারণা করেনি। তবে মহাকাব্য রচনার জন্য আবশ্যকীয় বীরত্বপূর্ণ কল্পনা মধুসূদনের নিজের ভেতরই ছিল, মনীষার সঙ্গে সমাজবিদ্রোহ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার সংযোগেই সেটা তৈরি হয়েছে। অনেকদিক দিয়েই তিনি সে কালের রক্ষণশীলদেরকে তো অবশ্যই, ইয়ং বেঙ্গলকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনও মহাকাব্য লিখেছেন, তাঁরাও মনীষাসম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু মধুসূদনের সাফল্য তাঁরা অর্জন করতে পারেননি। এর একটা কারণ, হয়তো-বা প্রধান কারণই, এই যে তাঁদের ভেতর মধুসূদনের বীরত্ববোধ ছিল না; সাহসী ছিলেন, কিন্তু দুঃসাহসী হওয়াটা তাঁদের জন্য ছিল সাধ্যাতীত। স্মরণীয় যে হেমচন্দ্র বড় হয়েছিলেন কঠিন দারিদ্র্যের ভেতর এবং নবীনচন্দ্র ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী। 

যে কবিকে মধুসূদন মূল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সেই জন মিল্টন ইংরেজি সাহিত্যের একমাত্র সার্থক মহাকাব্য ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ রচনা করতে পেরেছিলেন। আমরা লক্ষ্য করি যে, মিল্টনও ছিলেন বিদ্রোহী ও দুঃসাহসী। তাঁর কালের পিউরিটান বিপ্লবে তিনি সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। বিপ্লবের নায়ক ক্রমওয়েল-প্রতিষ্ঠিত সরকারে তিনি সচিবদের একজন হিসাবে কাজ করেছেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্য থেকে উত্থিত আক্রমণের মুখে পিউরিটানদের বক্তব্যগুলো কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। কাজটি করতে হতো ল্যাটিন ভাষায়। এবং এটি তিনি মনেপ্রাণে করেছেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি সবসময়েই ক্ষীণ ছিল, বিপ্লবের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের দরুন তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। প্যারাডাইজ লস্ট তিনি দৃষ্টিহীন অবস্থাতেই রচনা করেন; কলমে লিখে নয়, মুখে মুখে। এই কাব্য রচনার সময় মিল্টন চরম সঙ্কটে ছিলেন। বিপ্লবী উদ্যোগ পরাভূত হয়েছে, রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে, পিউরিটানরা বিধ্বস্ত ও হতাশাগ্রস্ত; তিনি গ্রেপ্তার ও নিগৃহীত হয়েছেন, সম্পত্তি হারিয়েছেন, চোখে দেখেন না। কিন্তু পরাভব মানেননি। প্যারাডাইজ লস্টে বীরত্ব আছে, কিন্তু সে বীরত্ব কর্তৃত্বপরায়ণ ঈশ্বরের নয়, ঈশ্বরবিদ্রোহী স্যাটানের; যে স্যাটানের জাগতিক প্রতিরূপ ছিলেন ক্রমওয়েল। সন্দেহ করা হয়, এবং সে সন্দেহ মোটেই অমূলক নয় যে, মিল্টন ছিলেন স্যাটানের পক্ষে। মহাকাব্যটির কেন্দ্রে আছে অ্যাডাম ও ঈভের ঈশ্বরাদেশ অমান্য করার ঘটনা। সেও এক বিদ্রোহ বটে। সে বিদ্রোহের পরিণতিটা করুণ; আদি পিতা-মাতা অ্যাডাম ও ঈভের স্বর্গচ্যুতি। মিল্টনকে জয়ের নয়, পরাজয়ের কাহিনীই লিখতে হয়েছিল।

তিন

মধুসূদন যে অসামান্য শক্তির অধিকারী ছিলেন যে সত্য তাঁর জীবন ও সাহিত্যের যেদিকেই তাকাই স্পষ্ট করে দেখতে পাব। কি নতুনের উদ্ভাবনায়, কি পুরাতনের ব্যবহারে, কি মহাকাব্যে, কি প্রহসনেজ্জসর্বত্রই তিনি শক্তিমান। প্রহসন দু’টি সম্পর্কে যদিও তিনি একদা বলেছিলেন, ‘I half regret having published these two things;’ এবং টেকচাঁদ ঠাকুরের ভাষাকে ‘মেছুনীদের’ ভাষা বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন বলে যদিও প্রসিদ্ধ আছে, তবে প্রহসন দু’টির মধ্যে দিয়ে তাঁর যে শক্তি প্রকাশ পেয়েছে সে-ই শক্তির সঙ্গে ‘মেঘনাদবধে’র মধ্যকার শক্তির বিরোধ তো নেই-ই, বরং আসলে তারা উভয়ে একই শক্তির দু’টি ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র মতো রচনার লেখকের পক্ষেই ‘মেঘনাদবধ’ রচনা করা সম্ভবপর, অন্য কোনো কারও পক্ষে নয়। এই দুই প্রহসনে মাইকেল বাঙালী সমাজের দু’টি বিচ্যুতিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছেন। একটি বিচ্যুতি তথাকথিত আধুনিকতার অপরটি সামন্তবাদী শোষণের। 

প্রহসনে মধুসূদন-প্রতিভার কোন্ লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছে? প্রকাশ পেয়েছে জীবনকে অকাতরে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করবার ক্ষমতা; জীবনের দৈন্য ও সামান্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; এবং তৃতীয়ত, নিপীড়িতের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি।

মধুসূদন ত্যাগ করেছিলেন নিজের ধর্ম, শুধু ত্যাগ করেননি, বিজাতীয় ধর্ম গ্রহণও করেছিলেন। শুধু বিজাতীয় ধর্ম নয়, ভাষাও। তবু নিজের গভীর ও মৌলিক সত্তায় তিনি যে সম্পূর্ণরূপে বাঙালী ছিলেন তার প্রমাণ মধুসূদনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ রচনাতে যেমন আছে, তেমনি রয়েছে প্রহসন দু’টিতেও। পরিত্যাগ ও বর্জনের সকল প্রকাশ চেষ্টা, ভঙ্গি ও ধ্বনির মধ্যেও নিজের দেশ ও সমাজ যে অবিচলিতভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর ভাবনা, অনুভব ও কল্পনার ভেতর তার প্রমাণ প্রহসনেই বরঞ্চ অধিকতর স্পষ্ট। বস্তুত বর্জন নয়, মধুসূদন হচ্ছেন গ্রহণের শিল্পী। দেশীয় উপাদানের সঙ্গে বৈদেশিক চেতনা ও রূপকল্পকে একত্রিত করে একটা নতুন ঐতিহ্যধারা তিনি সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন নিজের মৌলিকত্বকে প্রকাশ করবার অনিরুদ্ধ প্রয়োজনে। গ্রহণের এই ক্ষমতার জন্যই তাঁর রচনার মধ্যে অসাধারণ বৈচিত্র্য এসেছে, এসেছে ব্যাপকতা ও গভীরতা। গভীরতম দুঃখকে যিনি চিত্রিত করেছেন তিনিই আবার সৃষ্টি করেছেন চটুলতম কৌতুকের, সমুন্নত ভাষার শীর্ষদেশে যাঁর অনায়াস অধিকার ‘মেছুনীদে’র ভাষাও আবার ছিল তাঁরই অনুগত ভৃত্য। একই রচনা, ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে বাচস্পতির ভাষা ও হানিফের ভাষার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। মধুসূদন দুই ভাষাই জানতেন, যেমন জানতেন তিনি উভয় চরিত্রকেই। দীনবন্ধু মিত্রের তোরাপ, এমনকি শরৎচন্দ্রের গফুরের তুলনায় মধুসূদনের হানিফ অনেক বেশি সত্যিকার মুসলমান, অর্থাৎ অনেক বেশি স্বাভাবিক ও জীবন্ত মানুষ। বর্জনবাদীর মানসিক সঙ্কীর্ণতা ছিল না বলেই মুসলিম বিষয়বস্তু নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির ইচ্ছা তিনি প্রকাশ করেছিলেন একসময়ে। অন্যরা করেননি। 

মধুসূদন করেছেন, কেননা মধুসূদন বিদ্রোহী ছিলেন। তাঁর বিদ্রোহ সমাজ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে তো ছিলই, ছিল জীবনের দৈন্য ও সামান্যতার বিরুদ্ধেও। সেখানেই বোধ হয় তাঁর আসল ঘৃণা। ইয়ং বেঙ্গলরা অনাচারী হতে পারে, হতে পারে উগ্র, উচ্ছৃঙ্খল ও মদ্যপ, কিন্তু তাদের অতিরেকের মধ্যে বিদ্রোহও যে ছিল সে তো সকলেরই জানা কথা। মাইকেল নিজেও ইয়ং বেঙ্গল ছিলেন, কিন্তু ইয়ং বেঙ্গলের মধ্যে যে দৈন্য আছে, আছে সামান্যতা, সেও তাঁর অজানা ছিল না, সেসবের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহী ছিলেন তিনি, আর সেই জন্যই লিখেছিলেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’ লেখার আগেই, ভেতর থেকে মধুসূদন এই নতুন ‘সভ্যতার’ বর্বর অন্তঃসারশূন্যতার সংবাদ সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। দীনবন্ধু ঠিকই বলেছিলেন, ‘নিম কখনো মধু হতে পারে না’, মধুসূদনে নিমচাঁদে বিস্তর পার্থক্য। মধুসূদন নিমচাঁদের ব্যর্থতাকে জানতেন বলেই নবকুমার ও কালীনাথকে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মধুসূদনের নবকুমার না পেরেছে পুরাতনকে সৃষ্টি করতে, না নতুনকে গ্রহণ করতে তার আধুনিকতার দৌড়টা দু’চার শব্দ ইংরেজি বলা পর্যন্ত। স্বাধীনতার অর্থ তার কাছে মদ খাওয়ার স্বাধীনতা, তার সে না-ঘরের না-বাইরের। তাকে প্রথমে দেখি ঘর থেকে বা’র হয়ে যাচ্ছে মদের খোঁজে, শেষে দেখি মদ খেয়ে ফিরে এসেছে আবার সেই পুরাতন ঘরেই। আধুনিকতার ছোট ও নোংরা গলিতে সে যে লোভীর মতো ঘোরাঘুরি করে তাই থেকেই বোঝা যায় সে ভীষণভাবে বন্দি এবং অতিশয় সামান্য। নবকুমারের নবত্ব তার আপন নবকুমার নামের চেয়ে গভীর নয়। অন্যদিকে তার সঙ্গে মধুসূদনের দূরত্বই মধুসূদনের অসামান্যতার পরিমাপ। নিজের জীবনে মধুসূদন পূর্ণতার সমৃদ্ধি আনতে চেয়েছিলেন, সেই জন্যই তিনি নতুন নতুন সাহিত্যিক রূপকল্প এনে উপস্থিত করেছেন দেশবাসীর সামনে, যেমন সাধনা করেছেন ইংরেজ হবার তেমনি আবার পরিহাস করেছেন নকল ইংরেজি-নবিশদেরকে নিয়ে। 

কিন্তু দৈন্য ও সামান্যতা নবকুমারের একার নয়, দৈন্য ও সামান্যতা রয়েছে নবকুমারের ধার্মিক পিতা কর্ত্তামহাশয়ের জীবনেও, আছে কর্ত্তা-নিয়োজিত বাবাজীর মধ্যে, আছে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সার্জন ও চৌকিদারের চরিত্রে। সর্বোপরি রয়েছে কর্ত্তামহাশয়ের গৃহে, যেখানে মেয়েরা আধুনিকতা সাজবার ব্যর্থ প্রয়াসে তাস খেলে এবং যেখানে গৃহিণীকে বলতে শুনি,জ্জ“এ কলকাতা মহাপাপ নগর, কলির রাজধানী, এখানে কি কোনো ভদ্রলোকের বসতি করা উচিত?” অত্যন্ত সত্য কথা বটে! কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? এ পাপ কার? শুধু নবকুমার ও কালীনাথের? না, শুধু এ দু’জনের নয়, পাপ কর্ত্তামহাশয়েরও, যাঁদের গৃহে প্রাণের উপস্থিতি নেই, নেই আনন্দের উপাদান, যাঁরা তেমন কোনো ভাষা জানতেন না, যে ভাষায় ডাকতে পারেন তরুণকে। ডেকে কথা বলতে পারেন তাদের সঙ্গে। নবীনের জীবন যদি কৃত্রিম হয়, তবে প্রবীণদের জীবনও কিছু কম যায় না। বস্তুত প্রবীণের ব্যর্থতাই কলঙ্ক হয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে নবীনের জীবনে। প্রবীণ ও নবীন একই অন্তঃসারশূন্যতার দুই ভিন্ন প্রান্তে দণ্ডায়মান। একটি নীরব, অন্যটি সবাক, তফাৎ মাত্র এইটুকুই। 

কর্ত্তামহাশয় তাঁর সন্তানের কল্যাণ চান। কল্যাণ-অকল্যাণ নয়, আসলে চান ভালো-মন্দ সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা তথা নিজের ইচ্ছাকে জোর করে সন্তানদের অনিচ্ছুক স্কন্ধে তুলে দিতে। ছেলে নবকুমারের ওপর একটি স্ত্রীকে তিনি ও তাঁর গৃহিণী তাঁদের নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী চাপিয়ে দিয়েছেন, পাত্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে পরামর্শ করেননি। সেই বালিকা-বধূর সঙ্গে নবকুমারের জীবনের যে কোনো যোগ নেই, সে তো আমার নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। বেচারী নবকুমার, জীবন বলতে তার কিই-বা আছে বদ্ধগলিতে ঘোরাফেরার বাইরে? পূর্ণ ও সমৃদ্ধ জীবনের যে আদর্শ মাইকেল মধুসূদনের মনের ভেতর রয়েছে তার বিচারে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র সকল চরিত্রের মধ্যেই ঘাটতি আছে। আর সেই ঘাটতিকে নিয়েই মাইকেলের হাস্যকৌতুক। 

কিন্তু কর্ত্তামহাশয় যদি কৃত্রিম হন, তবে বুড়ো শালিক ভক্তপ্রসাদ হচ্ছে ভণ্ড ও প্রতারক। সেই সঙ্গে মস্তবড় অত্যাচারীও। কর্ত্তামহাশয় অত্যাচার করেছেন পরিবারের মধ্যে, ভক্তপ্রসাদের অত্যাচারকে নিয়োজিত দেখছি অন্য পরিবারের সর্বনাশ সাধন করবার কাজে। ভক্তপ্রসাদ ধর্মাচারণ করে, কিন্তু দরিদ্র নারীর সতীত্ব হরণে তার আগ্রহের কোনো অবধি নেই। অবশ্যই এই নৃশংস কর্ম তার কাছে অধর্মাচরণ নাও হতে পারে, কেননা অধর্ম বলতে সে বোঝে ব্রাহ্মণের প্রতি অবহেলা, গঙ্গাস্নানের ব্যাপারে ঘৃণা, সকল জাতের একত্র ওঠাবসা এবং মুসলমান রাঁধুনির হাতে রান্না খাওয়া। হানিফ গাজীর স্ত্রী-সম্ভোগ তো তাঁর নিজের সংখ্যা অনুযায়ীই অধর্মের কাজ হবার কথা। তবু তা হয়নি, কেননা এই ভণ্ডের মধ্যে চাতুর্যের অভাব নেই। 

নিজেই সে নিজেকে বলে দিয়েছে, ‘হ্যাঁ, স্ত্রীলোক তাদের আবার জাতি কি? তারা তো সাক্ষাৎ প্রকৃতিস্বরূপা, এমন তো আমাদের শাস্ত্রেও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।’ তবে আর বাধা কোথায়? বিঘ্ন কী? এই ভণ্ড তপস্বীর একটি তপস্যায় ভুল নেই, সে তপস্যা হচ্ছে অর্থের। লোকটি অর্থের ভক্ত। কিন্তু সেই লোলুপতাকেও ছাড়িয়ে ওঠে নারীর প্রতি তার লালসা। সেইখানে আপাত পরাক্রমশালী ভক্তপ্রসাদ অতিশয় দুর্বল। বাইরে পরম বৈষ্ণব হয়েও ভেতরে যে অর্থলোলুপ ও আসঙ্গলিপ্সু, বাইরে মুসলমানের হাতে রান্না খেলে পাপ হয় বলে প্রচার করে ভেতরে যে মুসলমান স্ত্রীকে উপভোগে অত্যুৎসাহী তার চরিত্রে ভণ্ডামী ও লাম্পট্য পুরোমাত্রায় আছে সত্য, কিন্তু ‘বুড় শালিকে’ যা বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে হয় তা ভণ্ডামি নয়, লাম্পট্যও নয়, তা হচ্ছে নিপীড়ন। 

পরাক্রান্ত ভক্তপ্রসাদ নিপীড়ন করছে অনেকের ওপর, মেয়ে কেড়ে নিয়েছে, জমি দখল করেছে, এখন সে লোলুপতা প্রসারিত করেছে অতিদরিদ্র কৃষক হানিফের পত্নী ফতেমার দিকে। ভক্তপ্রসাদের বয়স নাই; কিন্তু তার জমিদারি আছে, আছে অর্থ, সেই শক্তিতে সে সর্বনাশ করেছে অনেক দুর্বল মানুষের। ফতেমাকে তার চাই, কেননা ফতেমা যুবতী ও সুন্দরী; ফতেমাকে সে পেতেও পারে, কেননা ফতেমারা অতিশয় দরিদ্র। নাটকের সূচনাতেই হানিফকে বলতে শুনিজ্জসে মরলে বাঁচে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান কৃষক ও প্রজার স্ত্রীকে লাভ করা এমন কী কঠিন কাজ? হানিফের গৃহ উন্মুক্ত,জ্জ‘কুঁকড়োর পাখা, প্যাঁজের খোসা’, কোনো বাধাই নয় ভক্তপ্রসাদের পক্ষে। পীতম্বর তেলীর মেয়ে পঞ্চীর কথা আলাদা, সেই মেয়েও যুবতী, সেও সুন্দরী, তদুপরি তার মধ্যে ‘ছেনালি’ আছে (ভক্তপ্রসাদের মতে)। কিন্তু পঞ্চী তো আর ভূমিহীন কৃষকের পত্নী নয়, সে টাকাওয়ালা তেলীর মেয়ে, অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান, তাই ‘কুঁকড়োর পাখা, প্যাঁজের খোসা’র তুলনায় অনেক শক্তবড় বেষ্টনী আছে তার বাড়ির চারদিকে, তাকে পাওয়া সহজ কর্ম নয়। বাধা আছে, আছে বিঘ্ন, আর সেই বাধা ও বিঘ্ন অন্যকিছুর নয়, অর্থের। ভক্তপ্রসাদ পঞ্চীকেও চায়, যেমন চায় ফতেমাকে, যেমন আজ ত্রিশ বছর ধরে চেয়ে এসেছে অসংখ্যজ্জ‘কুলের ঝি, বউ... রাঁঢ়... মেয়ে’কে, কিন্তু পঞ্চীকে সে পাবে না, কেননা পঞ্চী দরিদ্র নয়। পঞ্চীর নিরাপত্তা ধর্ম থেকে আসেনি, এসেছে অর্থ থেকে। অর্থই শক্তিজ্জযেমন ভক্তপ্রসাদের তেমনি পঞ্চীর। ওদিকে অর্থ নেই বলেই বাচস্পতি দুর্বল। ভক্তপ্রসাদ বাচস্পতির জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। মৃত মাতার সৎকার করে এমন পয়সাও তার কাছে নেই। 

বাচস্পতি খাঁটি হিন্দু, হানিফ গাজী খাঁটি মুসলমান। কিন্তু তাদের যথার্থ পরিচয় ধর্ম নিয়ে নয়, যথার্থ পরিচয় এইখানে যে তারা উভয়েই নিপীড়িত মানুষ, অত্যাচারী ভূস্বামীর হাতে। এইখানে তারা এক। হানিফের প্যাঁজের গন্ধের কোনো অস্তিত্ব নেই বাচস্পতির সঙ্গে হানিফের মৈত্রীর ক্ষেত্রে। তারা দু’জনে, একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু অন্যজন উত্তপ্ত মুসলমান, এক হয়ে গেছে অনায়াসে, এক হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের উভয়ের শত্রু ভক্তপ্রসাদের বিরুদ্ধে। নিপীড়নকারী ভক্তপ্রসাদকে জব্দ করার শক্তি তারা বাইরে থেকে পায়নি, পেয়েছে আত্মরক্ষার অনিবার্য প্রয়োজন থেকে। হরিণের যেমন ক্ষিপ্র গতি, বাচস্পতি-হানিফের তেমনি সজাগ বুদ্ধি। যাদের হাতে অন্য অস্ত্র নেই, বুদ্ধি না থাকলে তারা বাঁচবে কেমন করে? 

শুধু বাচস্পতি ও হানিফ বলে নয়, ভক্তপ্রসাদ যাদের গোলাম করে রেখেছে তাদের মনেও কোনো ভক্তি নেই ভক্তপ্রসাদের প্রতি। গদাধর ভক্তপ্রসাদের বেতনভুক কর্মচারী, কিন্তু তার পক্ষপাত ও সহানুভূতি হানিফের দিকেই। ভক্তপ্রসাদকে নিয়ে সে গোপনে পরিহাস করে এবং তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় সেই দৃশ্যে যেখানে সে ভক্তপ্রসাদের নরম বিছানায় উঠে গা এলিয়ে দেয়, এলিয়ে দিয়ে বলে, ‘আহা কি আরামের জিনিস। এই বাবু বেটারাই মজা করে নিল। যারা ভাতের সঙ্গে বাটি বাটি ঘি আর দুধ খায়, আর এমনি বালিসের উপর ঠেস দিয়ে বসে, তাদের মতো সুখী কি আর আছে?’

নিপীড়িতের দুঃখ ‘নীলদর্পণে’ আরও অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য। দুঃখের সেই চিত্র মধুসূদনকে নিশ্চয়ই গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, নইলে নিজের লেখা থামিয়ে তুলনায় কম প্রতিভাশালী লেখকের লেখার ইংরেজি অনুবাদ তিনি করবেন কেন? কিন্তু নীলচাষীদের চেয়ে কিছু কম দুর্ভাগা নয় সাধারণ কৃষক। নীলকরদের অত্যাচার যত সহজে চোখে পড়ে, জমিদারদের অত্যাচার তত সহজে পড়ে না। কেননা নীলকররা বিদেশি, তাদের অত্যাচারের ধরনটা অতিনাটকীয়, যেখানে আছে ত্বরিত ফল লাভের দ্রুতগতি কর্মতৎপরতা। ভূস্বামীদের অত্যাচারটা স্থানীয়, কম নাটকীয়, ধীরস্থীর, নিশ্চিত ক্যানসারের মতো। জমিদারের অত্যাচার চোখে পড়ে কম, সেজন্যই এটা আরও বেশি বিপজ্জনক। সেই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, ‘নীলদর্পণে’র মতো কোনো চাঞ্চল্যকর জমিদারদর্পণ বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি। এর প্রধান কারণ সাহিত্য যাঁরা রচনা করেন তাঁরা জমিদারের থেকে খুব বেশি দূরে নন। মধুসূদন দূরে ছিলেন গ্রামের জীবন থেকে, কিন্তু তিনি কৃষকদের, প্রজাদের নিকটবর্তী ছিলেন সহানুভূতির দিক থেকে ঠিক যেমনভাবে সন্নিকটবর্তী হলেও তিনি দূরবর্তী ছিলেন ইয়ং বেঙ্গলের। 

কৃষকের কথা বাংলা প্রবন্ধে যেমন ভাবে আছে, কল্পনাধর্মী রচনায় তেমন ভাবে নেই, অন্তত মধুসূদনের সময়ে ছিল না। যে মধুসূদন পুরাণ থেকে চরিত্র নিয়েছেন তিনিই আবার চরিত্র নিয়েছেন কৃষকের জীবন থেকে। শুধু চরিত্র নেননি, গ্রামের নিপীড়িত মানুষের মধ্যে, বাচস্পতি ও হানিফের মধ্যে যে ঐক্যকে তিনি চিত্রিত করেছেন তা অন্যের রচনায় দেখি না, অনেককাল পরে তা সাহিত্যে এসেছে। যুগের থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন এই আধুনিক লেখকজ্জঅনেক দিক দিয়ে, প্রগতিশীল চিন্তার দিক দিয়েও। দীনবন্ধু মিত্রের হৃদয়ে সহানুভূতি ও করুণার কোনোই অভাব ছিল না, তথাপি ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে নবীনমাধব ও তোরাপের মধ্যে যে ঐক্য তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার সঙ্গে বাচস্পতি ও হানিফের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছেজ্জএই দুই ঐক্যের একটা মূলগত পার্থক্য বিদ্যমান। ‘নীলদর্পণে’র নবীনমাধব সব সময়েই ভদ্রলোক, বিপদের মধ্যেও তাই; আর তোরাপ সর্বদাই অধীনস্থ কৃষক, বিপদের সময়েও তাই। বাচস্পতি ও হানিফ যখন এক হয় তখন তাদের মধ্যে কোনো দূরত্বই থাকে না। একজন হিন্দু, অন্যজন মুসলমান, একজন সংস্কৃতবহুল ভাষায় কথা বলে, অন্যজনের ভাষা মুসলমানত্বের পরিচয়বহুল; কিন্তু অত্যাচারিত মানুষ হিসেবে তারা অভিন্ন, তারা একই সমতলে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টিভঙ্গির এই অগ্রসরমানতাটা দীনবন্ধুতে নেই, টেকচাঁদে নেই, বঙ্কিমচন্দ্রেও নেই। 

লক্ষ্য করবার দ্বিতীয় বিষয় এই যে, ‘নীলদর্পণে’ যে ট্র্যাজেডি আছে ‘বুড় শালিকে’ তা পাওয়া যাচ্ছে না। অত্যাচারীর শক্তিকেই শুধু দেখেননি মধুসূদন, অত্যাচারীর মধ্যকার অসঙ্গতিও দেখেছেন, তার দুর্বলতা দেখেছেন, অত্যাচারীর নিজের ভেতরে কৌতুকের অসামান্য উপাদান খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ক্রুদ্ধ না হয়ে তিনি বরং আমোদিত হয়েছেন, উষ্মা প্রকাশ না করে পরিহাস করেছেন। শক্তিমান মধুসূদনের শক্তির পরিচয় সর্বত্র আছে, রয়েছে এই দৃষ্টিভঙ্গিতেও। অত্যাচারিত মানুষকে তিনি জয়ী করে দিয়েছেন আপাত শক্তিশালী; কিন্তু ভেতরে দুর্বল অত্যাচারীর বিরুদ্ধে। বস্তুবাদী ভক্তপ্রসাদের জীবনে পরম আদরের যে বস্তু অর্থ সেইখানেই সে যা খেয়েছে। তার যে নারী সম্ভোগলিপ্সা, যা তার অর্থলোলুপতাকেও ছাড়িয়ে যায়, সেই লিপ্সা চরিতার্থ হয়নি। এই প্রহসরে সে সম্পূর্ণ পরাভূত, তারই প্রজাদের হাতে। দরিদ্রের এই জয় কাম্য ছিল মধুসূদনের, অন্যদের তা ছিল না। বিদ্রোহী মধুসূদন এখানেও বিদ্রোহী। 

প্রহসন দু’টির মধ্যে ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ যে শ্রেষ্ঠতর তার একটা কারণ কাহিনী, দ্বিতীয় কারণ চরিত্র। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র কাহিনীটা সামান্য। ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র কাহিনী তার উপজীব্য জীবনের মতোই গভীর। ইয়ং বেঙ্গল উচ্ছৃঙ্খল বটে, কিন্তু অত্যাচারী নয়। এই তরুণদের মধ্যে উল্লাস, উত্তেজনা, স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি এসব আছে। কিন্তু অন্যের কন্যা কিংবা স্ত্রীর সর্বনাশ করা, অন্যের জমি কেড়ে নেওয়ার মতো কাজে তারা নিয়োজিত হয় না। ‘বুড় শালিকে’র পেছনে রয়েছে যে সামাজিক জীবন সেটা গভীরতর বলেই চরিত্র সৃষ্টির সুযোগও সেখানে বিস্তৃততর। ফলে এই দ্বিতীয় প্রহসনে চরিত্র সৃষ্টি অনেক বেশি সার্থক। ভক্তপ্রসাদ জীবন্ত মানুষ, সে যখন বলেজ্জ‘এ পাজি বেটাকে ধরে নে যেয়ে জমাদারের জিম্বে করে দে আয় তো’, অথবা স্বগতোক্তি করে পঞ্চী সম্পর্কেজ্জ‘আহা, ছুঁড়ির কি চমৎকার রূপ গো, আর একটু ছেনালিও আছে’, অথবা যখন অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে বেলা পড়বার, তাজ পরে মাথায়, আতর মাথায় গায়, তখন একটি পূর্ণরূপে জীবন্ত মানুষ এসে দাঁড়ায় আমাদের চোখের সামনে। হানিফ, ফতেমা, পুঁটি, বাচস্পতিজ্জএরা প্রত্যেকে একই সঙ্গে স্বতন্ত্র ও জীবন্ত। জীবন্ত বলেই স্বতন্ত্র। তুলনায় গৌণ যাদের ভূমিকা তারাও প্রাণহীন নয়। 

ভক্তপ্রসাদের চরিত্র কেবল একজন ব্যক্তির নয়, প্রতিনিধি সে একটি শ্রেণীরই। ভূমিনির্ভর এই শ্রেণী ভূমি কর্ষণ না করেও ভূমি থেকে অর্থ আকর্ষণ করতে জানে, ভালো করেই জানে; কিন্তু জানে না সেই অর্থ নিয়ে কী করবে। এই অর্থ উৎপাদক খাতে ব্যয় করবে এমন বুদ্ধি তাদের নেই। অর্থ তাই ব্যয় হয় রিপুর সেবায়, কিন্তু এদের লালসার মধ্যেও একটা কাপুরুষতা আছে, যা নেই ‘নীলদর্পণ’-এর সাহেবদের মধ্যে। তাই এরা অন্ধকার খোঁজে, গোপনে দূত পাঠায়; লাঠিয়াল বা ঘোড়া ব্যবহার করে না, ইংরেজ দস্যুদের মতো। নীলকররা তবু নীলের উৎপাদনে তৎপর ছিল; জমিদারদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না উৎপাদন বিষয়ে। 

বাংলাদেশের অনগ্রসরতা ও দুর্গতির চিত্র ও কারণ উভয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই প্রজাপীড়নকারী, উৎপাদনবিমুখ, অর্থবিনিয়োগে অসমর্থ ও রিপুশাসিত জমিদার শ্রেণীর জীবন ও আচরণের দিকে তাকালে। 

মধুসূদনের ভাষা ব্যবহার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তেমন ভাষা তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেছেন ‘মাগী’ ও ‘ভাতার’ যে ভাষায় অতিসাধারণ শব্দ। ব্যবহার করেছেন চরিত্রসৃষ্টি তথা শিল্পের প্রয়োজনে। আরও একটি সত্য এই যে, ভদ্রজীবন ও গ্রাম্যজীবনের মধ্যকার বিরোধটা তখন, সেই কালে, আজকের মতো গড়ে ওঠেনি। ভদ্রতার পক্ষে বিশেষ বিশেষ শব্দ পরিহার করার ওপর নির্ভর না করলেও চলত। সেকালের ভদ্রজীবনে অন্যপ্রকার কৃত্রিমতা অবশ্যই ছিল, যার চিত্র মধুসূদন নিজেই এঁকেছেন, এমনকি ইংরেজি শব্দ ব্যবহারেও সেই কৃত্রিমতা প্রতিফলিত, কিন্তু তথাকথিত অভদ্র শব্দ বর্জনের ব্যাপারে সে জীবনে আগ্রহ ছিল না। তবে এই আগ্রহ যে একদিন আসবেই তার লক্ষণও ছিল, ছিল ইংরেজি শব্দ তথা আধুনিকতার প্রতি উগ্র আকর্ষণের ভেতরই। মধুসূদন শব্দ বর্জন করেননি, যে ধরনের কৌতুকবোধকে আমরা আজ গ্রাম্য বলি তাকেও বর্জন করেননি। বর্জনের পরবর্তীকালীন নীতিতে, তথাকথিত শালীনতাবোধের আগমনে জীবনের যাই হোক, সাহিত্যের ক্ষতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। অনেক শব্দ এবং এমনকি কৌতুকবোধের অনেকটা নির্বাসন নিয়েছে স্বেচ্ছায়। পরে সাধ্যসাধনা করেও তাদের আর ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হয়নি। এমনকি ইয়ং বেঙ্গলদের মধ্যেও বর্জনবাদ ছিল, কোনটা নেটিভ সাহেবী তা তারা জানত। শিল্পী মধুসূদনের ক্ষেত্রে তেমন জ্ঞানের কোনো আবশ্যকতা ছিল না। শিল্পী মধুসূদন বর্জনবাদী ছিলেন না। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫