Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

আশার বুননে লেখা হো চি মিনের কবিতা

Icon

এমরান কবির

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৫

আশার বুননে লেখা হো চি মিনের কবিতা

হো চি মিন। ছবি: সংগৃহীত

‘কবিতা আবৃত্তির অভ্যাস নেই আমার/ কিন্তু এ বন্দিশালায় কি আছে অন্য কাজ?/ কয়েদি এ দিনগুলো কাটাব কবিতা লিখে/ আর তা গাইতে গাইতেই নিকটে আনব/ স্বাধীনতার দিন’ (ডায়েরির প্রথম পাতা, কারাগারের কাব্য, অনুবাদ- মুনীর সিরাজ, অন্য প্রকাশ)। কবিতার অমোঘ শক্তির প্রতি আস্থা রেখে যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন তিনি বিপ্লবী নেতা ও কবি হো চি মিন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দু-তিনজন বিপ্লবীকে পাওয়া যায়, যারা বিপ্লবের একটা অস্ত্র হিসেবে (শুধুই সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে নয়) কবিতাকে মান্য করতেন, চর্চাও করতেন। চীনের যেমন মাও সে তুং, চিলির পাবলো নেরুদা তেমনি ভিয়েতনামের হো চি মিন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন নেতাকে পাওয়া যায়, যারা তাদের লক্ষ্যে স্থির থেকে কার্য সম্পাদন করে গেছেন। আমাদের যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন নেলসন ম্যান্ডেলা, আমেরিকায় মার্টিন লুথার কিং। বিপ্লব ও ভিয়েতনামের ইতিহাসে তেমনি একটি নাম হো চি মিন। 

জন্মেছিলেন ১৮৯০ সালের ১৯ মে নি-ঘিয়ান প্রদেশের চুয়াগ্রামে। ভিয়েতনামবাসী ভালোবেসে ডাকে আঙ্কেল হো নামে, শেখ মুজিবকে যেমন আমরা বঙ্গবন্ধু বলি কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলাকে বলা হয় মাদিবা- সে রকম। 

হো চি মিন মানে আলোর দিশারী। এই নামেই পৃথিবী তাঁকে চেনে। শৈশবে গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন বাবা নগুয়েন মিন হুয়ে। ফলাফল খুব ভালো করায় ভর্তি করানো হয় শহরের স্কুলে। তখন তিনি বুঝতে পারেন দেশ শাসন করছে ফরাসিরা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরাসি। অন্য শিক্ষকরা ভিয়েতনামি হলেও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস নেই। স্কুলের এসব পরাধীনতা তাকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ১৮৮৩ সালে ফ্রান্স পুরোপুরি দখল করে ফেলে ভিয়েতনাম। তখন থেকেই তিনি বিপ্লবের পাঠ, দীক্ষা আর পদ্ধতি আয়ত্ত করতে নেমে পড়েন। দেশে দেশে চলে তার অভিযাত্রা। বেছে নেন বিচিত্র সব পেশা। ট্রিভিলি জাহাজে সহকারী রাঁধুনির কাজ গ্রহণ করেন। লন্ডনে গিয়ে কাজ নিলেন হোটেল বয়ের। বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসে পৌঁছলেন প্যারিসে। প্যারিসে এসে দেখতে পান ভিয়েতনামে উপনিবেশ গড়ে তোলা ফরাসিদের সঙ্গে সামান্যতম মিল নেই। সুস্থ সংস্কৃতির চেতনার রুশো, ভলতেয়ারের দেশের মানুষ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। সিদ্ধান্ত নেন বিপ্লবের জন্মভূমি ফ্রান্স থেকেই অর্জন করবেন বিপ্লবের মন্ত্র। জীবিকার জন্য কাজ নিলেন ছবির দোকানে তুলি দিয়ে রিটাচার করা। ১৯২০ সালে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯২৫-২৬ সালে তিনি সংগঠিত করেন তরুণ শিক্ষাশ্রেণি। ১৯৪১ সালের পরে তিনি হয়ে ওঠেন অবিসংবাদী নেতা।

লেনিনবাদে বিশ্বাসী হো চি মিন তাঁর মুক্তি-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে যা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তার সারসংক্ষেপ প্রদান করেছিলেন দুটি পদ্ধতির মধ্যে। এক. সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যুদ্ধ চালানো সম্ভব। দুই. বিপ্লবী মতাদর্শে যে পার্টি প্রকৃত অর্থে দৃঢ়, তেমন পার্টিরই বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা জরুরি।

তিনি উপর্যুক্ত বক্তব্য ধারণ এবং প্রয়োগ করেছিলেন বলেই তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয়েছিল ভিয়েতনাম। ফলে ভিয়েতনাম আর হো চি মিন নাম দুটি একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায়।

১৯৪২ সালে হো চি মিন ভিয়েতনামের পিপলস ডেলিগেট হয়ে চীনে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার পথে জাপানি সেনাদের হাতে বন্দি হন। জাপান তখন চীন আক্রমণ করেছে এবং ভিয়েতনাম দখল করে নিয়েছে।

চীনের কোয়াংসি প্রদেশে তেরোটি জেলার তেইশটি কারাগারে বা কারাগারসদৃশ স্থানে চৌদ্দ মাস বন্দি করে রাখা হয়েছিল হো চি মিনকে। সে সময় তিনি লিখে ফেলেন প্রিজোন ডায়েরি, যা চীনা  ধ্রুপদি ভাষায় রচিত কবিতার প্রতিচিত্রসংবলিত। ১৯৬৭ সালে আইলিন পামার গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেন।  

সন্ধ্যার পর অন্ধকারে বসে হো চি মিন দৃকপাত করতেন সকল ঘুমন্ত এবং জাগ্রত বন্দিদের প্রতি। নিষ্পাপ মুখের মানুষগুলো মাটিতে শুয়ে আছে। দেয়ালে ছারপোকার হামাগুড়ি, আকাশে বিমানের ঝাঁকের মতো মশকের ঝাঁক। বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে স্বদেশ এবং কমরেডদের থেকে অনেক দূরে, জেলের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে তিনি মর্ম যাতনায় কাতর। এমন অসম্ভব অস্থির সময়েই একটি ছোট পুরাতন নোট বইয়ে তিনি বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতাগুলো রূপান্তর করেন কবিতায়। উল্লেখ্য, কারারক্ষীদের ভাষাতেই (মান্দারিন ভাষায়) তিনি তা রচনা করেছিলেন। কারণ ভিয়েতনামি ভাষায় কবিতাগুলো লিখলে তিনি সন্দেহের চোখে পড়তে পারতেন। কারারক্ষীরা ভিয়েতনামি ভাষা জানতেন না।

মূলত ভিয়েতনামের সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই হো চি মিনের কবিতার মূল সুর। এতে তিনি যে স্বর ব্যবহার করেছেন তাও সাধারণ। সাধারণে প্রবেশ্য। বিপ্লব এমন এক জিনিস, যেখানে সাধারণ্যের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হো চি মিন সেটা ভালোভাবেই বুঝতেন। 

কবিতায় তিনি রাজনীতি সচেতন এবং স্বদেশের মুক্তির জন্য প্রচণ্ডভাবে বিপ্লবে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাসে তিনি ছিলেন আপোষহীন। এই আপোষহীন বিশ্বাসটিকেই তিনি কবিতার মাধ্যমে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন, ‘দেহ কারাগারে/ কিন্তু চেতনা, কখনো না।/ মহান বিজয়ের তরে,/ উড়ুক উঁচুতে আকাশে চেতনা।’ (চেতনা, কারাগারের দিনলিপি, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী) 

তার কবিতায় অনুধাবনীয় বিষয় নিপীড়িত মানুষের জীবনের কদর্য রূপ,  যা তিনি শিল্পীত করেছেন পঙক্তিতে পঙক্তিতে। এ রকম উপস্থাপনকে তিনি দিয়েছিলেন দার্শনিক ভিত্তি। তিনি নিজেই নিপীড়িত ছিলেন বিধায় তার এই বোধ অধিকতর বাস্তবসম্মত- ‘ক্ষুধায় হাঁ মুখ তার/ পিশাচ দানব যেন লোহার পদবেড়ি/ প্রতি রাতে কামড়ে ধরে মানুষের পা।/ শক্ত চোয়ালে চেপে থাকে/ ডান পা সকল বন্দির, শুধু/ বাঁকানো নড়ানো যায় মুক্ত বাম পা (লোহার পদবেড়ি, কারাগারের কাব্য, অনুবাদ- মুনীর সিরাজ)

তার বিপ্লবী চেতনা ছিল সত্যনিষ্ঠ। এই সত্যনিষ্ঠতা তিনি কবিতায় সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। তাতে তার কবিতায় সৃষ্টি করেছে বিশ্বাস্য দৃঢ়তা। বিষয়টি কবিতায় যেমন নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে তেমনি বিপ্লবে কিংবা বিপ্লবী কবিতার সংশ্লিষ্টতায় যোগ করেছে বিশ্বাস। এই ধারাটি বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে নতুন। সম্ভবত সে জন্যই ভিয়েতনামি সমালোচকরা তার কবিতাকে উল্লেখ করেছেন স্টিলি স্ট্রাকচার হিসেবে। শব্দগুচ্ছটি বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ইস্পাত অবয়ব।’

ধ্বংসের কিনারে বসেও তিনি আশার স্বপ্ন বুনে চলেন, ‘পরিবর্তমান এই চীনের আবহাওয়ায় আমার শরীর/ হয়েছে বিধ্বস্ত খুব, ভিয়েতনামের দুর্দশায়/ আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত ভীষণ, হায়।/ কয়েদখানায় অসুস্থ হওয়াটা কী যে সাংঘাতিক/ ব্যাপার কী বলি-/ কিন্তু আমি কান্নার বদলে গান গেয়ে যাওয়াটাই/ অধিক পছন্দ করি।’ (গুরুতর অসুস্থ, অনুবাদ- শামসুর রাহমান, বিচিত্রা- তৃতীয় বর্ষ, ৪১ সংখ্যা, ০৯ মে ১৯৭৫, প্রথম আলো ২৫ আগস্ট ২০১৩)

শুধু তা-ই নয়। কারগারকে তিনি নিছক কারাগারই মনে করেন না- ‘সন্ধ্যার আহার শেষে সূর্য ঢলে পড়ে/ লোকগীতি আর বাজনার ধ্বনি বেজে ওঠে/ সহসা চারদিকে,/ বিষণ্ণ সিংসি জেল/ নবরূপে মূর্ত যেন ললিতকলা বিদ্যানিকেতন।’ (সন্ধ্যা, কারাগারের কাব্য, অনুবাদ- মুনীর সিরাজ) 

কারাগারকে যিনি ললিতকলা বিদ্যানিকেতন বলতে পারেন তিনিই তো কাগজের স্তূপকে জেলখানার কম্বল জ্ঞান করতে পারেন- নতুন পুরোনো বই/ পাতাগুলো সব একসাথে গাদাগাদি হয়ে আছে।/ কোনো কম্বল না থাকার চাইতে/ একটি কাগজের সম্বল বরং ভালোই/ এই শীতে যারা নিরাপদ আশ্রয়ে আছ/ ঘুমিয়েছে রাজার ছেলের মতো, / জান কি কত মানুষ কারাগারে আছে/ ঘুমোতে পারছে না সারারাত। (কমরেডদের জন্য কাগজের কম্বল- অনুবাদ মৃন্ময় চক্রবর্তী।

কমরেড ঘুমাবে কীভাবে। তার সমগ্র চেতনায় যে বিপ্লবের শিখা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫