চিরায়ত দর্শনের স্বরূপ অণ্বেষক মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

রেজাউদ্দিন স্টালিন
প্রকাশ: ০৯ মে ২০২০, ১১:৪৮

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান আমাদের কালের একজন বিশিষ্ট কবি। যদিও গীতিকবি হিসেবেই তার পরিচিতি সমগ্র বাংলাদেশের যে কজন কবি গান লিখে মানুষের হৃদয়লগ্ন হয়েছেন, তাদের মধ্যে আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবিদ আনোয়ার, মাহমুদ শফিক, জাহিদুল হক, নাসির আহমেদের নাম সংগীতপিপাসুরা জানেন।
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের বড় ভাই ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এ দেশের শ্রেষ্ঠতম কবি ও গীতিকবিদের অন্যতম। তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার সেই গানের চরণ ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন’ আমাদের হৃদয়ে এখনো অনুরণিত হয়। আরেকজন কবি পঞ্চাশের দশকে গান লিখে সাড়া ফেলেছিলেন- গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তার রচিত ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল/ বাতাসের আছে কিছু গন্ধ’ গানটির সমাদর এখনো লক্ষ করি।
‘সাম্প্রতিক কালে একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, কবিরা গান লিখছে না বলে এখন ভালো গানের কথা পাওয়া যায় না।’ সৈয়দ শামসুল হক প্রায়ই কথাটি বলতেন। সৈয়দ হকের অসংখ্য গান সিনেমায় গীত হয়েছে এবং তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে। আমি অনেকদিন পর্যন্ত জানতামই না, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ সৈয়দ হকের লেখা। হক সাহেবের মৃত্যুর পর ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস’ গানটি আবারও নতুন করে আলোচনায় আসে।
এ গানের মধ্যে জীবন-মৃত্যুর চিরায়ত দর্শনের স্বরূপ স্ব-প্রকাশিত। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান ত্রিশের দশকের উত্তরাধিকার যেমন পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন পঞ্চাশ ও ষাট দশকের গান। তবে বাংলা গানের পঞ্চপাণ্ডবের গান তিনি মুছে ফেলেননি।
‘আধুনিক’ শব্দটি আপেক্ষিক জানি, তবুও আধুনিক কবিতার একটি সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্য রীতি ও ভাব-কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। আধুনিক কবিরা এখন আর গান লিখতে চান না। কারণ সুরারোপ ও সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে গান রচনা করতে গিয়ে কবিকে অনেক ছাড় দিতে হয়। ফলে কবিতার গুণগত মান ও গভীরতায় কমতি ঘটে- এ কথা হয়তো ভুলে মনে করেন প্রসিদ্ধ কবিরা। যদিও রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তাঁদের কালে আধুনিক হয়েও গান লিখে অমর হয়েছেন।
সম্প্রতি গান লিখে মার্কিন কবি বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তি আধুনিক কবিতা ও গীতিকবিতার বেড়াজাল ছিন্ন করেছেন বলে বিদগ্ধজনেরা বলেছেন। বিশ শতকের বিখ্যাত আধুনিক কবি William Butler Yeats মনে করতেন, ‘যেখানে রোমন্টিকতার শেষ, সেখানে আধুনিক কবিতার মুক্তি।’ একজন গীতিকবি রোমান্টিকতামুক্ত হবেন, তা ভাবা কঠিন। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই আধুনিক কবিতায় সুর দিয়ে গান করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কেউই তেমন একটা সাফল্য পাননি।
এদিকে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান রোমান্টিকতা বিরোধী কোনো কাব্যাচরণ উপস্থাপন করেননি। কিন্তু তার সময়ের যেসব নৈরাজ্যের মাধ্যমে মৃত্যু ও হতাশা সংঘঠিত হয়েছে, তাকে তিনি গানে অকপটে উপস্থাপন করেছেন। একজন আধুনিক কবির যে দায়িত্ব সময়কে ব্যবচ্ছেদ করা, তা তিনি এড়াতে পারেননি। ‘অসময়’ কবিতায় তাকে বলতেই হয়েছে-
‘ক্রসফায়ারের এক দুর্নাম শিকার হয়ে ফজর বয়াতি
চিৎপাত পড়ে আছে ডোবার জঙ্গলে- শুধু তার
বাম পা’টা ঝোপে বেঁধে ঊর্ধ্বমুখী ঔদ্ধ্যতের লাথি
হয়ে আছে কারো দিকে, এপার- ওপার ছিদ্র মগজে সাঁতার
দিচ্ছে না এখন তার তর্জন কিংবা বিচারগানের কোনো ধারা-’
আমি প্রায়ই বলি, সাহসের শিল্পীত রূপ কবিতা অর্থাৎ যতটুকু সাহস ততটুকু শিল্প ততটুকুই কবিতা। সেটি সব অর্থেই; অর্থাৎ প্রচলিত কথার বিরোধিতা, নতুন আঙ্গিকে তৈরির ঝুঁকি নেয়া এবং সময়ের নৈরাজ্যকে রাষ্ট্রের বৈষম্যকে তুলে ধরা। এ কবিতায় কবি সেই শর্ত পালনে কুণ্ঠাবোধ করেননি। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান আমাদের ঘড়ির কাঁটায় একজন সত্যবান কবি। তাঁর কাব্যশক্তি আজীবন অক্ষুণ্ণই থাকুক- এই প্রত্যাশা করি।