Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

৭৩ বছর আগের গল্প ‘অব্যয়’

Icon

সাইদা খানম

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:০৫

৭৩ বছর আগের গল্প ‘অব্যয়’

সাইদা খানম। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পথিকৃৎ নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম [২৯ ডিসেম্বর ১৯৩৭-১৮ আগস্ট ২০২০] আলোকচিত্র চর্চার পাশাপাশি গল্পও লিখতেন। তার প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা শতাধিক। গল্পগুলোর বেশিরভাগই ছাপা হয় বেগম পত্রিকায়। বেগম ছাড়াও মাসিক দিলরুবা, সাপ্তাহিক ললনা ও পাক্ষিক অনন্যায় ছাপা হয় তার আরও কয়েকটি গল্প। সাইদা খানম উপন্যাসও লিখেছেন চারটি। তার লেখা প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, ফিচার, গৃহীত সাক্ষাৎকার আর স্কেচ ছাপা হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। পুরোনো পত্রিকা ঘাটলে পাওয়া যায় সেসব।

মাত্র ১০ বছর বয়সে গল্প লিখতে শুরু করেন সাইদা খানম। আর ১২ বছর বয়সে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় তার তিনটি গল্প ও একটি ভ্রমণকাহিনী ছাপা হয়। বেগম তখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একমাত্র নারীবিষয়ক সাপ্তাহিক। সেই সময় সাইদা খানম থাকতেন পাবনায়। ওই বয়সে বেগম পত্রিকায় তার গল্প ছাপা হওয়া বিস্ময়কর ব্যাপার! তিনি গল্প লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন তার কবি খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার কাছে। তার এই খালা ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি।

সাইদা খানমের প্রথম গল্পের নাম ‘শ্যামলী’। গল্পটি ১৯৪৯ সালের ২১ আগস্ট বেগমের তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায় ছাপা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর ছাপা হয় দ্বিতীয় গল্প ‘ছিন্নতার’। তৃতীয় গল্প ‘বশীকরণ’ ছাপা হয় ১৪ নভেম্বর। ওই বছর ১৬ অক্টোবর ‘ডুয়ার্সের একপ্রান্তে’ শিরোনামে একটি ভ্রমণকাহিনীও ছাপা হয়। এরপর দীর্ঘ সাত দশক ধরে তিনি পাঠকদের অসংখ্য গল্প উপহার দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে ‘ধুলোমুঠি’ নামে তার একটি গল্পের বই ছাপা হয়। ধুলোমুঠি মূলত তার লেখা ১০টি গল্পের একটি সংকলন।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে সাইদা খানমের ৮২টি গল্প, চারটি উপন্যাস ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৪০টি লেখা উদ্ধার করতে সক্ষম হই। উদ্ধার করা গল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো গল্পটি ১৯৫১ সালের আগস্ট মাসে [ভাদ্র ১৩৫৮, ৩য় বর্ষ, ৫ম সংখ্যা] মাসিক দিলরুবায় প্রকাশিত হয়, যা আমার সংগ্রহে আছে। গল্পটির শিরোনাম ‘অব্যয়’। ৭৩ বছর আগে প্রকাশ হওয়া গল্পটি বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের জন্য নিবেদন করা হলো।

সন্ধ্যার আলো-আবছার মধ্যে রেবেকাকে দেখে প্রথমে একটু চমকিয়ে ওঠে কামাল। দরজায় হেলান দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে সে যে কতক্ষণ কামালের মুখের দিকে তাকিয়েছিল জানে না। হঠাৎ চুড়ির শব্দে ও ধরা পড়ে যেতেই একটু অপ্রস্তুতভাবে হেসে এগিয়ে আসে টেবিলের কাছে। বাতির শিখাটা কামাল আরও বাড়িয়ে দেয়। স্পষ্ট হয়ে উঠে রেবেকার মুখটা। ও যেন আরও সুন্দর হয়েছে, শুধু মন-পল্লবঘেরা যে চোখ দুটি ছিল শরতের উজ্জ্বল আকাশের মতো ঝলমল, তার মধ্য দিয়ে আজ যেন শ্রাবণের ধারা ঝরি ঝরি করছে। স্থির দৃষ্টিতে কামাল তাকিয়ে থাকে। অন্তরের প্রচণ্ড আবেগে বাইরে সে হয়ে পড়ে স্তব্ধ। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে রেবেকা বসে, অজস্র কথা তার বলবার ছিল; কিন্তু একটা কথাও সে বলতে পারে না। দুজনার মধ্য দিয়ে বয়ে চলে নীরবতার স্রোত।

দূর আকাশে কোথায় যেন খসে পড়ে একটা তারা। তারই একটুখানি আলোর আভাষ ঝিলিক দেয় ঘরের মধ্যে। হঠাৎ কামাল বলে উঠেজ্জ‘উল্কার মতোই আজ তুমি এলে আমার ঘরে। একটু অভ্যর্থনারও সুযোগ দিলে না।’

‘শুধু তোমার ঘরে নয় তোমার জীবনেও এসেছিলাম উল্কার মতো, অত তাড়াতাড়ি মুছে ফেলতে পারলে আমাকে’জ্জভিজে গলায় রেবেকা বলে। কামাল একটু হাসে। সে হাসির মধ্যে ফুটে ওঠে বেদনার ছায়া। ‘কিন্তু জানো রেবেকা যেখানে উল্কাপাত হয়, সেখানে সব কিছু পুড়ে ধুসর হয়ে যায়।’

‘তা জানি; কিন্তু সে ধূসরতাকে মুছে ফেলতে সময়ও লাগে না, যদি পাওয়া যায় সবুজের পরশজ্জযেমন তোমার বেলায় হলো।’

অবাক হয় কামাল।জ্জ‘এ কথা কেন বলছো?’

অতদিনের রুদ্ধা অভিমান রেবেকার বুকের মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়ে কামালের প্রশ্নতে। গলার কাছটাতে কান্নার ঝড় যেন পাক খেয়ে উঠে। মুখটা নীরব করে ফেলে রেবেকা। মুহূর্তের জন্য একবার বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনে কামাল রেবেকার নত মুখের ওপর। ‘রেবেকা’জ্জস্পষ্ট অথচ কোমল সুরে কামাল ডাকে, ‘একটি বার আমার দিকে চেয়ে দেখো; সত্যি আমার মধ্যে কোনো ফাঁকি নেই। তুমি যা ভেবেছো রেবেকা তা ভুল, নাজমাকে আমি ভালোবাসি সত্যি; কিন্তু...’

‘থাক কামাল আমার সঙ্গে আর নাই বা ফ্লার্ট করলে।’ নিজেকে সামলে নিয়ে রেবেকা বলে, ‘তোমার ওই মুহূর্তের আবেগ দিয়ে বানানো কথার ফানুস শুনতে সত্যি আমার কষ্ট লাগে কামাল; যা সত্যি নয় তার ওপরে রং দিয়ে কেন আমাকে আবার ভুলতে চাও, বলতো?’

‘ভুলতে চাই’জ্জঅস্পষ্টভাবে কামাল বলে। ব্যথায় মুখটা কালো হয়ে যায়। একটু চুপ করে থেকে আবার বলে, ‘এ কথা বলতে একটুও কি তোমার বাঁধলো না রেবেকা?’

প্রত্যুত্তরে রেবেকা কিছু বলে না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সত্য-মিথ্যা বিচার করার জন্য সে অন্তরের মধ্যে হাতড়ে বেড়ায়। চাপা দীর্ঘ-শ্বাসের সঙ্গে রেবেকা মুখ ফিরায়। কামালের কপালের ওপরে রুক্ষ্ম চুলগুলো বাতাসে একটু একটু কাঁপছে। সমস্ত অন্তরের নিংড়ানো ভালোবাসার আবেশ দিয়ে রেবেকা তাকিয়ে থাকে নীরবে। হঠাৎ ওর মনে হয় কামাল যেন বড্ড রোগা হয়ে গেছে। 

‘কামাল’জ্জকি যেন রেবেকা বলতে চায়; কিন্তু বাইরে পদশব্দ শুনে চুপ করে যায়। দরজার পরদাটা একটু নড়ে উঠে! নিঃশব্দে নাজমা ঘরের মধ্যে ঢুকেই রেবেকাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে থমকে দাঁড়ায়।

‘এদিকে এসো নাজমাজ্জলজ্জা কি?’ সহজভাবে কামাল ডাকে। রেবেকাকে লক্ষ্য করে কামাল বলে, ‘একে চিনতে পারো নাজমা?’ নীরবে ঘাড় নাড়ে নাজমা। একদিনই সে রেবেকাকে দেখেছিল মিটিংয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য। তবু সে ভুলতে পারেনি। সে দিন রেবেকাকে দেখে একটা কথাই তার মনে হয়েছিল কালীদাশের কাব্যের শ্যামলা মেয়ে পথ ভুলে যেন ফিরে এসেছে আধুনিক যুগে। 

চিরদিনই রেবেকা একটা স্বাভাবিক ও শান্ত গাম্ভীর্যের দ্বারা ব্যবধান রেখে চলত। আজ কিন্তু তার ব্যতিক্রম হলো। সহজভাবেই সে নাজমার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলে। রেবেকার কণ্ঠস্বরের স্নিগ্ধ কোমলতায় নাজমার মধ্যে যে দ্বিধাটুকু ছিল কেটে যায়। মুখর হয়ে ওঠে নাজমা। অনেক কথা সে বলে চলে। তার মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে কামাল ভাইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।

গালের নিচে হাত রেখে খুব মনোযোগের সঙ্গে কামাল শুনছিল নাজমার কথা। হঠাৎ ভীষণভাবে হেসে ওঠে কামাল। 

‘রেবেকা ওর একটা কথাও তুমি বিশ্বাস করো না। আমার সম্বন্ধে সব বাড়িয়ে বলছে।’

‘বাড়িয়ে বলছিজ্জআমি?’ মুখটা গম্ভীর করে ফেলে নাজমা। ‘সেবার তবে গানের প্রতিযোগিতার সময় আমার পেছনে তবে কেন অত সময় নষ্ট করলে? আর এবার চ্যারিশোর অভিনয়ের জন্য।’

‘ও তুমি কি তবে রিহারসেল দিতে এসেছিলে?’

বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে রেবেকা জিজ্ঞাসা করে।

‘না কামাল ভাই, বাড়িতে গিয়ে শিখিয়ে আসেন।’

‘আর আমি শিষ্যের কাছ থেকে কি দক্ষিণা নেই জানো? রোজ শুনি একটা করে ওর গান।’ কথাটা বলে কামাল হাসতে থাকে। হঠাৎ কামাল ও নাজমার মুখের দিকে রেবেকা একবার চায়, নিজের অন্তরের মধ্যে অনুভব করে একটা প্রচ্ছন্ন ঈর্ষার ভাব।

‘আজ তবে উঠি।’ হাতের ঘড়ির ওপর চোখ রেখে রেবেকা বলে।

‘এখুনি চলে যাবে?’ কামালে স্বরে ব্যকুলতার আভাষ পেয়ে নাজমা মুখ তুলে তাকায়।

‘হ্যাঁ’ একটু কঠোরভাবে উত্তরটা দিয়েই রেবেকা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

ভারাক্রান্ত মনে কামাল তাকিয়ে থাকে রেবেকার চলে যাওয়া পথের দিকে।

‘কামাল ভাই’জ্জনাজমার ডাকে কামাল চমকিয়ে উঠে।

‘আমিও তবে আসি।’

‘আচ্ছা।’ একটু আনমনা উত্তর দেয় কামাল।

দরজার কাছে গিয়ে নাজমা ফিরে তাকায় কামালের দিকে। অন্ধকারের দিকে কামাল চেয়ে রয়েছে। তন্ময় হয়ে কামাল ভাই যে রেবেকার কথা ভাবছে, বেশ বুঝতে পারে নাজমা।

রাতের গভীরতা ক্রমে বেড়ে উঠে। বাতাস নেই। গাছের পাতার শিরশিরাণি পর্যন্ত শোনা যায় না। নাজমার চোখে ঘুম আসে না। শিক ধরে ও দাঁড়িয়ে থাকে জানালার কাছে। গাছগুলোর পুঞ্জীভূত কালিমার মধ্য দিয়ে নাজমা দেখে কামালে ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। পাশের বাড়িতেই কামাল থাকে। আকাশের উজ্জ্বল তারাটার দিকে নাজমা একবার চায়। চোখ দুটি ব্যথায় কালো হয়ে উঠেছে। কামালের প্রতি যে অনুভূতিটা অতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল, আজকে রেবেকাকে দেখার পর হঠাৎ যেন তার মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে; কিন্তু এ যে অন্যায়। মনের দ্বন্দ্বের ছাপ পড়ে নাজমার শুভ্র কোমল মুখের ওপর। ক্লান্তিতে মাথাটা সে এলিয়ে দেয় শিকের ওপর; কিন্তু সমস্ত যুক্তি-তর্ক ভেদ করে আর অন্তরের মধ্যে ধ্বনিত হয় একটি মাত্র কথাজ্জ‘ভালোবাসি’।

ঠিক সেই সময়ে ডায়েরি লিখতে লিখতে রেবেকাও হয়ে পড়ে একটু উদাসীন। ওর মনের মধ্যে একসঙ্গে ঝাপটা মারে অনেক কথা। রেবেকা তাকিয়ে থাকে ফুলদানির আধ ফোটা সাদা গোলাপগুলোর দিকে। ওর চোখের দৃষ্টি আরও ঘণ, আরও স্বপ্নালু হয়ে উঠে। এলোমেলোভাবে রেবেকা ভাবে ফেলে আসা বছরগুলোকে। হোস্টেল জীবনে একলা ঘরে বসে মনে মনে এত পুনরাবৃত্তি করেছে, এই স্মৃতিগুলো যেন মনে হয় কালকের ঘটনা। তবু রেবেকা নতুনভাবে অনুভব করে হোস্টেলে চলে যাওয়ার বিদায়ের ক্ষণটুকুকে। ট্রেন ছাড়বার আগমুহূর্তে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে মনোহর ভঙ্গীতে কামাল চেয়েছিল ওর দিকে। সে দৃষ্টিতে ছিল স্নিগ্ধতা, ছিল বিচ্ছেদের অসহ্য বেদনা। মৃদুভাবে, হ্যাঁ খুব মৃদুভাবেই কামাল বলেছিল ‘আমি শুধু তোমার’। সেই সামান্য কথাকে ভিত্তি করে রেবেকা তার সমস্ত জীবন কামালকে কেন্দ্রীভূত করে ফেলে।

রেবেকার বুকের ভেতরটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে ওঠে। সেই কামাল কত যেন বদলে গেছে। অন্যবারের মতো এবার বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতেও এলো না। ওর অভাবটা নাজমাই আজ পূরণ করে দিয়েছে, তাই আজ অবহেলা করতে পেরেছেজ্জআশ্চর্য! কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের মধ্যে ঈর্ষা আর সাপের ফনার মতো ফোঁস ফোঁস করে হঠাৎ ওর মনে হয়। নাজমা আর তার নিজের হৃদয়ের একটি জায়গা যেন একই রশিতে গিট পাকানো। হয়তো নাজমাও তার মতো কামালকে ভালোবাসে। আর কামাল? রেবেকা কিছু ভাবতে পারে না; ওর চোখ দুটি জ্বালা করে। মুহূর্তের মধ্যে দুহাত দিয়ে রেবেকা মুখটা ঢেকে ফেলে।

বিবর্ণ ম্লান দিন। মেঘলা আকাশের ধূসর ছায়া নেমেছে মাটির ওপর। নির্লিপ্তভাবে নাজমা তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। হঠাৎ শোনে কে যেন চাপা গলায় ওকে ডাকছে। মুখ ফিরাতেই দেখে সিঁড়ির ওপর রেবেকা দাঁড়িয়ে রয়েছেজ্জএ কি সম্ভব? নাজমার বুকের ভেতরটা একটু কেঁপে উঠে। এমনিধারা এক দিনে কামাল এসেছিল তার কাছে ছায়াভরা ক্লান্ত চেহারা নিয়ে। তার আগে কামালের সঙ্গে নাজমার পরিচয় ছিল সামান্য। মানুষের মনের মধ্যে যখন শারীরিক বা মানসিক দুঃখের দহন শিখা জ্বলতে থাকে, তখন সে চায় একটু দরদ, একটু সহানুভূতি। হয়তো সেই দুর্বল মুহূর্তে নাজমাকে একান্ত আপন মানুষ ভেবে দ্বিধাহীনভাবে কামাল বলেছিলজ্জ‘জানো নাজমা, রেবেকা আমাকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য অন্যের কাছে ধরা দিয়েছে।’

নাজমা সে কথা বিশ্বাস করে না। ‘এ তোমার বোঝবার ভুল কামাল ভাই। বিশেষ করে রেবেকা তোমাকে স্কুলজীবন থেকেই ভালোবাসে। তুমিই বলেছজ্জআমি যখন ওর সঙ্গে গল্প করতাম, দেখতাম সোনার কাঠির প্রথম পরশ পাওয়া রাজকন্যার মতো বিস্ময় দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। কয়েক দিনের জন্য অন্য জায়গায় গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, সেই চোখ দুটি ভরে উঠেছে প্রেমের স্নিগ্ধতায়।’

নাজমার কথা শুনে কামাল একটু ম্লান হেসে পকেট থেকে বের করে রেবেকার চিঠিটাজ্জ‘এতে যা লেখা আছে, তাও কি মিথ্যা?’

কোনো কথা খুঁজে পায় না নাজমা। শুধু অবাক হয়ে ভাবেজ্জ‘রেবেকা একথা কি করে লিখলো’ অনেক কষ্টে নিজকে বাঁচিয়ে চালাতে চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু শেষকালে এক জনার ভালোবাসার কাছে ধরা দিতে হলো। ‘তুমিই বলো নদীর কি দুটি মুখ থাকতে নেই?’

এ সব তো বেশি দিনের নয়, তবু নাজমার মনে হয় যেন কত দিনের যুগান্তরের ইতিহাস। নাজমা কথা বলার আগেই রেবেকা বলে, ‘তোমার কাছে একটু দরকারে এলাম নাজমা।’ রেবেকার কণ্ঠস্বরে নাজমা একটু চমকিয়ে ওঠে। বিশ্বের শ্রান্তি যেন নেমে এসেছে ওর স্বরে।

দুজনে এসে বসে ড্রয়িং রুমে। ফুলের মৃদু গন্ধ বাঁধা পড়েছে ঘরের বন্ধ হাওয়ায়। জানালা দিয়ে তাকাতেই রেবেকা দেখতে পায় কামালের ঘরটা। বুকের ভেতরটা ওর ব্যথিয়ে ওঠে। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে নাজমার মুখের ওপর; একটু অন্য মনস্কভাবে ওই দিকে চেয়ে রয়েছে নাজমা।

‘নাজমা’জ্জআন্তরিকতার সুরে রেবেকা ডাকে। ‘তুমি কামালকে খুব ভালোবাসো, তাই না?’

অকস্মাৎ এ প্রশ্ন শুনে নাজমা নির্বাক হয়ে যায়। হৃদয়ের ক্ষতের জায়গায় পড়ে আঘাত। প্রত্যুত্তরে নাজমা কিছু বলতে পারে না। শুধু ওর চোখ দুটি কোমল হয়ে আসে। কিছুক্ষণ নীরবতার মধ্য দিয়ে কেটে যায়। হঠাৎ রেবেকা বলে, ‘থাক উত্তর আর শুনতে চাই না নাজমা! পেয়ে গেছি আমার উত্তর।’ এক টুকরো মলিন হাসি কেঁপে মিলিয়ে যায় রেবেকার ঠোঁটের কোণে।

‘আজ আমি চলে যাচ্ছি নাজমা। ভেবে দেখলাম যে ভালোবাসা কামালের অন্তরে মরে গেছে, তাকে নতুন করে জাগিয়ে তোমার মধ্যে ব্যবধানের সৃষ্টি না করাই ভালো।’

‘এসব কি বলছো রেবেকা?’ কাতরভাবে নাজমা বলে।

নিজের দুর্বলতাকে ঢাকবার জন্য রেবেকা হাসতে চেষ্টা করে; কিন্তু পারে না।

‘ঠিকই বলছি নাজমা। কামাল আর আমার মধ্যে ভুল বোঝার জন্য যে বেদনার ঘূর্ণি-হাওয়া সৃষ্টি হয়েছে, তার ঝাপটায় দূরে ছিটকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয় জেনেই আমি চেয়েছিলাম বন্ধন; কিন্তু এখন দেখছি সেই বন্ধনের লগ্ন আর আমার জীবনে আসবে না।’

একটু চুপ করে থেকে রেবেকা বলে উঠে, ‘কালো নিথর দীঘির ওপর ঢিল ফেললে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, সেইটুকুই কামাল শুধু জানলো, আমার ডুব দেবার প্রয়োজনও বোধ করলো না। আমার ওপর সে প্রতিশোধই নিল; কিন্তু একবার ভেবে দেখলো না সে চিঠির ভিত্তি সত্য কি না!’

‘তুমি কি তবে মিথ্যা লিখেছিলে?’

‘হ্যাঁ’, ধরা গলায় রেবেকা বলে। ‘তোমাকে আর কামালকে কেন্দ্র করে অনেক কথাই ভেসে আসে আমার কানে। মন তখন অভিমানে একেবারে অন্ধ। সত্য-মিথ্যা বিচার করার সময়ও পেলাম না। ওকে আঘাত দেবার জন্য বানিয়ে লিখলাম মিথ্যা কথা।’ কথাটা বলেই নীরব হয়ে যায় রেবেকা। দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দেয় দূরের দিকে। কপালের ওপর আলগোছে হাতটা একবার বুলায় নিজে। অস্ফুটভাবে নাজমা হঠাৎ বলে ফেলে, ‘অত নিষ্ঠুর কামাল ভাই।’ কথাটা কানে যেতেই রেবেকা তার অশ্রুভরা চোখ দুটি মেলে নাজমার পানে চায়, ‘নিষ্ঠুর ও সত্যি নয়। শুধু বড্ড বেশি খেয়ালি; তুমিই ওকে পারবে সামলাতে। সেই ভরসায় তো চলে যাচ্ছি।’ কথার ইঙ্গিতটা বুঝে আস্তে আস্তে ওর বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠে। এত বড় আশাকে ক্ষীণ ভিত্তির ওপর নাজমা আঁকড়ে ধরতে পারে না। বহু কষ্টে হৃদয়কে সংযত করে যখন নাজমা বলতে যায়জ্জ‘কামাল ভাইকে ভুল বুঝে সে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য এ দায়িত্ব আমার ওপর দিয়ে যেও না।’ কিন্তু তাকিয়ে দেখে রেবেকা নেই। নিঃশব্দে কখন সে চলে গেছে।

‘কামাল ভাই আজকের মতো খুশি হতে তোমাকে কোন দিন দেখিনি। মনে হচ্ছে সমস্ত আনন্দ যেন তোমার চোখের তারায় এসে কাঁপছে।’ কামালের উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে নাজমা বলে।

‘মনের মানুষ ফিরে আসাতে কার না খুশি লাগে নাজমা? এ খুশি হয়তো কোনোদিনই আমার জীবনে ফিরে আসতো না, যদি তুমি আমার আর রেবেকার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে দিয়ে সত্যের সেতু না গড়তে।’ নাজমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে নিজের তন্ময়তার মধ্যে জেগে ওঠে কামাল মুখ তুলে তাকায়। গভীর দৃষ্টিতে নাজমা চেয়ে রয়েছে রিক্ত 

কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মতো নাজমা যেন শান্ত। অযত্নে বাধা চুল শ্লথ বন্ধনে নেমে পড়েছে কাঁধের দিকে। সূর্যাস্তের লাল রং সমস্ত আকাশের দিকে মাখিয়ে দিয়েছে আবীর। তারই আভা এসে পড়েছে নাজমার মুখে। যে মুখে ফুটে উঠেছে হৃদয়ের দুর্দান্ত ভালোবাসাকে রোধ করবার একটা ব্যর্থ বেদনার ছাপ। হঠাৎ কামালের মনে হয় এক দিনের মধ্যে নাজমা যেন অনেক বদলে গেছে; কিন্তু কেন? বুঝতে পারে না কামাল, তবুও কিসের যেন ছোঁয়া লাগে তার মনে।

‘নাজমা’ দরদের সঙ্গে কামাল ডাকে।

ডাক শুনে চমকে উঠে নিজেকে সামলে নেয় নাজমা। সহজ হওয়ার জন্য একটু হেসে নাজমা বলে, ‘কামাল ভাই বেশ মানুষ তো। রেবেকাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে বললে, অথচ এদিকে যে সন্ধ্যা হয়ে এলো।’

‘ও তাই তো!’ রেবেকার কথায় কামাল একটু আনমনা হয়ে পড়ে, ‘তুমিও চল আমাদের সঙ্গে।’ কী যেন ভেবে কামাল বলে।

ভূমিকা ও সংগ্রহ : সাহাদাত পারভেজ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫