
প্রতীকী ছবি
যেহেতু বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে আমার তারুণ্য অতিবাহিত হয়েছে, অতএব মানব ইতিহাসের পূর্ব-বাঙালি পর্বে তারুণ্যের কী দাপট, কী স্পর্ধা, দীপ্ত-দৃপ্ত তারুণ্য গ্রীবার কী যে অপার বিদ্রোহী কারুকাজ, তা অবলোকন এবং অংশগ্রহণের সুযোগ এই বাংলা-বান্দার হয়েছে। জীবনের পড়ন্ত বেলার ঝিমুনি শারীরিক আবর্তে সেই তরুণ আমাকে প্রায়শ করুণ দশায় পতিত করেছে।
করোনার লিঙ্গ-পরিচয় কী আমি জানি না, এই পৃথিবীতে কেহই জানে কিনা তা-ও জানি না, তাই করোনা ভাইরাস কী ভাইজাত না বোনজাত-তাও নিশ্চিত নই। অতএব করোনাকে ইনি-উনি বলে সম্মান জানিয়ে বলি, তিনি আমার ফুসফুসকে শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ গ্রাস করেছিলেন। এই শতাব্দীর প্যান্ডেমিক থেকে দেশের অতি বড় একাডেমিকও রেহাই পাননি; এই অধম কোন ছার! মুক্তিযুদ্ধে (একাত্তরের) সচেতনভাবে জানের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের একটা মিহি গর্ববোধ মনের ভেতরে বিরাজ করছে আজও। তবুও স্বীকার করি হে পৃথিবী, করোনাকালে অকস্মাৎ জীবন-প্রপাত জলশূন্য হয়ে যাক, সে ‘মহান প্রয়াণ’ চাইনি। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হলেও তখন রাষ্ট্রের শেষ বিউগল-সম্মান জুটতো কি জুটতো না তা জানি না। রাষ্ট্র আমাকে সম্মান দেবে কিনা, সেটা ‘মৃত’ আমার কাছে গুরুত্বের নয়, সেটা রাষ্ট্র, ইতিহাস, সংগ্রাম-সাথি কিংবা আমার কষ্ট-পীড়িত পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কাছে সাময়িক আহ-উহ-ইহ ব্যাকরণের ব্যাপার হলে হোক।
জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো, আমার কবর (ভদ্রভাষায় সমাধি) পাশে গিয়ে যতই পুষ্প-অর্ঘ্য বা অঞ্জলি দেওয়া হোক না কেন, আমার তো আর তার সুখ কিছুই পাওয়া হলো না। ধর্মীয় হুজুরদের মতে ততক্ষণে কবর-আজাব যে শুরু হয়ে যাবার কথা। তবে করোনা-পীড়িত অবস্থায় মৃত্যু প্রায়-নিশ্চিত পরিস্থিতিতে মৃত্যুদূতের সঙ্গে অঘোরে কিঞ্চিৎ অনুরোধ-বচন (উদ্গিরণ) করেছিলাম মনে পড়ে। মৃত্যুদূতেরও লৈঙ্গিক পরিচয় কী তা জানি না। তবে অঘোরে বেঘোরে তাকে অনুরোধ করেছিলাম মনে পড়ে, ওহে মহাদূত, আবার ফাইলটা একটু ফিরিয়ে নিন না, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে বলুন না, আরও ক’টা বছর। আরও ক’টা বছর।
এই জগতে ‘তারুণ্যগিরি’ করতে গিয়ে ‘ক্যারিয়ারগিরি’ করতে পারিনি। আমার শত শত বঙ্গদেশি ‘বুয়েট’ পরিচিতির সাথিদের অধিকাংশকে শতকোটি বৈধ-অবৈধ রজতের মধ্যে বসবাস করে এখনকার প্রযুক্তি-বাহারে ঝলকিত হয়ে মূল্যবান বচন উদ্গিরণের ক্রীড়া উৎসব উপভোগ করতে দেখছি। ঐ সব বন্ধু ‘অ্যালামনাই ব্যাচ’ গড়ে, বছরে কয়েকবার আনন্দ-সম্মিলনীতে সাফল্য-গীতি ও সমালোচনার শিল্প-কারুকার্য করে। অনেকে শেষ বয়সের ধর্মীয় আচার-ভারে ন্যুব্জ। অনেকে বুয়েট-পরিচিতির গর্ব ও গৌরবে পুলকিত-ঝলসিত; জগৎকে উপেক্ষা করার নাসিকা-কুঞ্চিত। তাদের অ্যালামনাই জগতের কূপকে সমুদ্র-জলে বড়ই পাদাপি-লাফালাফি করে।
হে মৃত্যুদূত, না, তাদের মাঝে ফেরত যাওয়ার জন্য আমার আয়ু-প্রার্থনা নহে, দেশে প্রথিতযশা হবার মতো প্রতিভা সর্বশক্তিমান আমাকে দেন নাই, তবুও মরণ রে তুমি আমার শ্যাম সমান, এই রবীন্দ্রবাণী আমি এতটুকু পছন্দ করি না। বরং আরেকটি রবীন্দ্রবাণী ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’-মৃত্যুদূতকে শেষোক্ত চরণের মর্মবাণী শ্রবণ করাতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে গেলাম। কেননা ততক্ষণে আমি জীবনের এক ভিন্ন স্বাদ পেয়ে গেছি।
কাহিনিটি বলেই ফেলি,
করোনা-কোভিড পর্বের প্রথম বছরে মৃত্যু -প্রতিরোধক অনেক ওষুধই বাজারে নামেনি। তখন করোনা-শিকারদের সমাহিত করার সাহসী লোকের বড়ই অভাব। কতিপয় চিকিৎসক মুখ ঘুরিয়ে আমার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করত প্যান্ডেমিকের দ্বিতীয় বছরে। এক এক চিকিৎসকের ভয়ার্ত বদন দেখে সত্যি সত্যিই কষ্টে রোদন আসতো। জানেন, আমার গৃহে দু দুজন চিকিৎসক। দুজনই নারী, একজন আমার সঙ্গে জীবন-বন্ধন চুক্তিতে, তবে কাবিননামা নিখোঁজ। ১৯৭৯ সালে ৩০ হাজার টাকার কাঞ্চনমূল্যে আমার চুক্তিনামা। দ্বিতীয়জন আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে জীবন চুক্তিনামায় আবদ্ধ। এই সব বন্দনারও কিঞ্চিৎ কারণ রয়েছে। আমার পুত্রবধূ পরিস্থিতির শাসনদণ্ড স্বীয় হস্তে ধারণ করেছেন। শাশুড়ি-মাতা তথা সিনিয়র ম্যাডামকে আমার ধারে কাছে ভিড়তে দেননি। কড়া হুকুম, একজন ভিক্টিমকে সামলাই, আপনি ঘরে থাকুন, হাসপাতালে স্বামীজীর পাশে ক্রন্দন-সার্কাসের প্রয়োজন নেই, আমরা আছি।
এই ‘আমরা আছি’ শব্দ দুটির বাক্যই হলো মরণ-দূতের কাছে আমার বেঁচে থাকার আরজ-আবেদনটি ফাইলে ঢুকিয়ে সেবারের মতো ফিরে যাবার অতিশয় করুণ-মিনতির মর্মভেদী নিঃশব্দ আর্তনাদের সার কথা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বেঁচে যাওয়া অনেক সাথি মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান আজও পাইনি, তারা দেশে-বিদেশে নীরবে সাধারণ জীবিকার প্রবাহে মিশে গেছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকাতেই অতিশয় বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম, অনেক জাঁদরেল পেশিবহুল মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু প্রথম সুযোগেই অন্যের সম্পত্তি দখলের ‘মহাখলনায়কে’ পরিণত হয়ে গেছে। কারও গালে দখলঝুঁকির দাগ ঢাকার শ্মশ্রু গজাতে দেখা যাচ্ছে। কারও নামের আগে ‘হাইজ্যাকার’ উপাধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জুটে গেছে।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ। স্নেহভাজন পেশানিষ্ঠ সৎ সাংবাদিক শাহ আলমগীর একদিন বললেন, তিনি একটি ব্রডকাস্টিং টেলি-চ্যানেলের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন।
বললাম, ওহে ছোট ভ্রাতঃ, অধমের জ্ঞান-গম্যি নেই, সুযোগ থাকলে মিষ্টি নহে, দু-একটি টকশোতে ডেকো। জ্ঞানপুষ্ট নই। অতএব টকাটোকি ঠোকাঠুকি করে যদি ঘণ্টাখানেক ব্যয় করে হাজার খানেক টংক-অঙ্ক মেলে, মন্দ কী! বহু বামপন্থিই এই লাইনে বামাপন্থি হয়ে গেছে। তারা অনেক জানেন, অনেক বোঝেন। সব কথাকেই এদেশের মহান ‘শ্রেণিসংগ্রামী’ প্রবীণ একাডেমিক-এর
মতো ‘শ্রেণিসংগ্রামের গহ্বরে’ পতিত করে বক্তব্য সাঙ্গ করেন। বাম নেতৃবৃন্দ তাদের সার্বক্ষণিকদের যে মাসোহারা দিতেন, এক টকশোতে তার চেয়েও কয়েকগুণ কামাতে থাকলেন। তবে দেখেন দেশে এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মহাসমালোচনাকারী তাত্ত্বিক ভ্রাতা-ভগিনীবৃন্দ ঐ ‘চতুর্থ’ থেকেই চতুরভাবে ‘আমসত্ত্ব’ সংগ্রহ করে চলেছেন। অনেক বাম একেবারে গণভবন-সংশ্লিষ্ট হতে সবিশেষ সাফল্য অর্জন করেছেন।
ঘরে মুখ দেখাতে পারি না।
ইঁহারা-উঁহারা যদি পারে, তুমি কী
হর্স-আন্ডা পারো, এমন কথা মুখে বলে না, ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই গজরান। এতসব পটভূমি শাহ আলমগীরকে বলি নাই বটে। তবে বললাম, বন্ধু, তুমি তো আরেক বন্ধু বুলবুল আহসানের মতো ‘বুদ্ধিমান-চৌকস’ নও, আমাদের নবজাগ্রত পুঁজিবাদের স্থূলতার মুগুর-ডাম্বেলের আঘাতে চুরমার হয়ে যাবে। শাহ আলমগীরের ধরনের একজন সিনিয়র সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু সাংবাদিকতার ‘পদক’ পাবার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছেন কিনা জানি না। তবে তার লেখার গভীরতা, তার ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, তৈলং-শুষ্কতা-কোনো দিক দিয়েই সদ্য প্রস্ফুটিত পুঁজিবাদী মিডিয়ার সঙ্গে যায় না। শাহ আলমগীরকে বললাম, যেখানে যাচ্ছো ভায়া, বাহাত্তরের পর সেই পরিচিত বন্ধুটির কাছে যাইনি, তবে হাজার কোটি টাকার বেশুমার মালিক বন্ধুটি যে কথায় কথায় তার প্রতিষ্ঠানের চাকুরেদের পশ্চাদ্দেশে ‘পাদুকা আবিষ্কার’-এর মাহাত্ম্য বুঝিয়ে থাকেন, তা জানো তো! শাহ আলমগীর বললেন, জানেন না, বাইরে থেকে অনেক কথাই বেশি বেশি শোনা যায়। ভায়ার সঙ্গে আমার দীর্ঘ কথা হয়েছে। বলেছেন, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি এনে আমার চ্যানেল সাজানো। আমার সম্পত্তি আর মালের জোর কত তার সামান্য হিসাব নিন। এই অঞ্চলের আশেপাশেই বারোশ কোটি টাকার বেশি। শুধু এই চ্যানেলের জন্যই তা আমি দিতে পারি। লেটেস্ট যন্ত্রপাতি দিয়ে চমক লাগিয়ে দিন।
সরল-সহজ শাহ আলম-মঞ্জু সাহেবরা প্রাথমিক পুঁজিবাদে চমকিত। ওরা এত ভালো, বাইরে থেকে আমরা খারাপ বলি ঈর্ষায়। এই দুজন সাংবাদিকই মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন সুধায় সদা আপ্লুত। শুধু বোঝেননি পূর্ব বঙ্গীয় মুসলিম পুঁজিবাদের লুকানো হিংস্র নখর। শাহ আলমগীরের বিষয়ে বিশদ জানি না, তবে মঞ্জু ভাইকে জানি সরল-সহজ-নিষ্ঠাবান বৈয়াকরণিক হিসাবে। জীবনে তার একটিমাত্র বড় শখ-‘সম্পাদক’ হওয়া। ‘অধিনায়ক’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বছরখানেক অপেক্ষা করছিলেন। সেই ‘অধি’ আজ অবধি ‘নায়ক’ হতে পারেনি।
ওদিকে জীবনের অতি পড়ন্ত অবস্থায় একটি পত্রিকায় কয়েক মাসের জন্য সম্পাদক হতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন বটে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতার অহেতুক বন্দনায় সংযত থাকায় সংহত হতে পারেননি। অতিশয় ভদ্রভাবে পশ্চাদ্দেশে সম্পাদকচ্যুতির সিল বসে গেল তার।
এতসব প্যাঁচাল পাড়ছি একটি ‘অর্ডারি মাল’-এর জন্য। তবু বলি জীবনের এক মহান প্রাপ্তি। এদেশে স্বীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে সামান্য শ্রদ্ধা জানাবার শিষ্টাচার কিংবা মূল্যবোধ যার নেই, তিনি হন ‘নোবেল লরিয়েট’। কেননা বিশ্বের ‘উন্নত পুঁজিবাদের’ জন্য অর্ডারি মাল জোগান দেন তিনি। অতিশয় অধম এই ‘অসহায় বান্দা’র উপরও একজন তরুণের ‘অর্ডারি মাল’ তৈরির অনুরোধ গিলতে হলো। শুরুতেই বলেছিলাম, ষাটের দশকের তারুণ্যের ভেতর পাঠকক্ষের চেয়ে রাজপথে সময় কাটানো প্রজন্মের একজন বান্দা আমি। তরুণ এবং তারুণ্যকে ভালোবাসি। একজন তরুণের অনুরোধে একটি ওষুধ-উৎপাদক কোম্পানির সাহিত্য পত্রিকার রম্য অংশের জন্য আমাকে কিছু পণ্য উৎপাদন করে দিতে হবে। ওই উৎপাদকরা আবার রম্য লেখা এতই সাধারণ সহজ যে, তাতে টংক-বরাদ্দ খুবই কম রাখেন। অনেকটা ভিটামিন সি ট্যাবলেটের মতোই। লিখতে ইচ্ছে করেনি। তরুণের অনুরোধে শিলা হয়ে গেল সূর্যতাপের শৈল। তবুও বলি ‘রম্য’ আমি জানি না। ‘রম্য’ জানতে হলে পত্রিকা প্রযোজকেরা যেন ‘সৈয়দ মুজতবা আলি’র একটি বইও পাঠ করে নেন।
তবে যে কথাটি বলতে নিশপিশ করছি, তা হলো পরিবার- বন্দনা। শাহ আলমগীর বেশিদিন ওই চ্যানেলে থাকতে পারেননি। পশ্চাদ্দেশে সুচিহ্ন মুদ্রণের আগেই চম্পট দিতে পেরেছেন প্রথমত ওই চ্যানেল থেকে। এবং অকালে পৃথিবী থেকে।
চ্যানেল-পাখা-মহামল-জমিজিরাত-প্রাসাদ ব্যবসার একজন অগ্রণী টাইকুন যখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনার দখলে চলে গেলেন, তখন পৃথিবীর খ্যাতনামা এক ডজন চিকিৎসক আনা হলো। শুনেছি তার জীবনের যবনিকাপাতের সময় পরিবারের একজনও পাশে ছিলেন না। ‘আপন পরান বাঁচা’ সিনেমার শুটিং-এর জন্য উপাস্থিত ছিলেন বিশ্বস্ত তিন সাধারণ কর্মচারী। লাথি ভক্ষণ করেও যারা প্রভুকে ভালোবাসতেন।
এই অধম ‘রম্য উৎপাদক’-এর পাশে দিনের চব্বিশঘণ্টা ধরেই পরিচর্যা করেছেন তার বড় পুত্র, পুত্রবধূ এবং অত্যন্ত মানবিক একজন চালক। দীন হীন-ব্যাংক অ্যাকাউন্টবিহীন রম্য উৎপাদকের জীবনে এটাই ‘নোবেল পুরস্কার’। অর্ডারি মালের আজ এখানেই যবনিকা পতন।