Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

ফরাসি কবিতার সাম্প্রতিক ধারা

Icon

ওবায়েদ আকাশ

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৮

ফরাসি কবিতার সাম্প্রতিক ধারা

প্রতীকী ছবি

আজকের ফরাসি কবিতা, বিশেষ করে গত দেড়’শ বছরের ফরাসি কবিতা যে ধারায় তার কাব্যবিচ্ছুরণ ছড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব কবিতার বিস্তৃত আকাশে, ক্রমে তা নানা উপধারায় বিভক্ত হয়ে যেখানে অবস্থান নিয়েছে, তাতে একজন যে আর আরেকজনের মতো নন, তা স্পষ্ট।

প্রত্যেকেই গড়ে নিয়েছেন আপন আপন পৃথিবী- সে হতে পারে ভাষা, উপস্থাপনা ও চিত্রকল্প নির্মাণের ভিন্নতায়। তবে আজকের ফরাসি কবিরা যে একটি জায়গায় একই সূত্রে গ্রথিত, সে জায়গাটি নিঃসন্দেহে তাদের সাম্প্রতিক কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যও। তা হচ্ছে কবিতায় ইঙ্গিতময়তা কিংবা সংকেতময়তা। এ সময়ের কবিরা এমন ধারণা পোষণ করেন যে, যা বলার তার সবটা বলা যায় না, সবটা বলে উঠতে পারা যায় না। তাই কবিতায় কথা বলার জন্য কখনো ইঙ্গিত কিংবা কখনো সংকেতের আশ্রয় নিতে হয়। ‘স্নায়ুই হলো সবচেয়ে বড় কবি’ নিয়তিতাড়িত শব্দভাস্কর পল ভালেরির নিভৃত দিনপঞ্জির এই স্বগতোক্তি কিংবা ‘এক সুতোর ডগায় কাঁপছে মানুষ’ জ্যুল স্যুপেরভিয়েলের এমন মন্তব্যকে হার্দিক অনুভব করে সাম্প্রতিক ফরাসি কবিরা আবিষ্কার করেছেন কবিতার নবতর আকাশ।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে গত দেড়শ বছরের ফরাসি কবিতার ধারাবাহিক অবলোকনকে সামনে নিয়ে আসতে অগ্রজ ফরাসি অনুবাদক চিন্ময় গুহর একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার প্রয়োজন মনে করি : “উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভিক্তর য়্যুগো, লামারতিন, আলফ্রেদ দ্য ভিন্যি বা ম্যুসের রোমান্টিকতা যখন জীবনের সব অন্তর্চিহ্ন ছুঁতে পারল না, তখন বিস্তারে পৌঁছানোর জন্য সব প্রচলিত ‘দেখা’র ধরনকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কবিতা ও বাঁচাকে এক তরঙ্গ-দ্রাঘিমায় মিলিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল জেরার দ্য নেরভালের ঐন্দ্রজালিক কলমে, শার্ল বোদলেয়র এসে খুলে দিলেন সব কপাট। য়্যুগো বুঝতে পেরেছিলেন (জীবনানন্দের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যা পুরোপুরি ধরতে পারেননি) বোদলেয়র এনেছেন এক ‘নতুন শিহরণ’ (un frisson nouvea)। সেদিন থেকে ফরাসি কবিতা হয়ে উঠতে চাইল আধুনিক মানুষের জটিল পরস্পরবিরোধী মনের অন্তর্মানচিত্র। প্রতীকের সেই অরণ্যে ফরাসি কবিতার ভাষা জীবনের শিরা-উপশিরাকে স্পর্শ করার জন্য প্রস্তুত হলো। ‘প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, এক সত্যিকারের দেবতা’ (র‍‍্যাঁবোর বিখ্যাত উক্তি) বোদলেয়রের খুলে দেওয়া পথ দিয়ে শুরু হলো দুঃসাহসিক সব কবিতা-অভিযান। এরপর ‘র‍‍্যাঁবো ও লোত্রেয়ামের বোনা বীজ যেমন ভেতরে ভেতরে আমূল বদল আনছিল ফরাসি কবিতার মজ্জায়, তেমন বাইরেও মূলগত পরিবর্তন এলো বিংশ শতাব্দীর শুরুতে।’ আর এই পরিবর্তনের ধারায় যারা ফরাসি কবিতাকে গত শতাব্দীর আশির দশক অবধি মহিমান্বিত করেছেন তারা হলেন পল এল্যুয়ার, আঁরি মিশো, ফ্রাঁসিস পঁজ, জাক প্রেভের, পিয়ের র‌্যভেরদি, রনে শার, য়্যজেন গিলভিক প্রমুখ। যারা গত হয়েছেন গত শতাব্দীতেই। এরপর আশির দশকেই আরেক ধাপ পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয় ফরাসি কবিতায়। চলে লিরিকের পুনরাবিষ্কার। আগেকার চরমপন্থা ছেড়ে শুরু হয় নতুন পথের আবিষ্কার। এ প্রসঙ্গে ফরাসি সমালোচক লিওনেল রে মনে করেন : “ভাষার অন্তর্লীন অপরিহার্য গীতিময়তা আর একটি স্বরের অনন্যতাকে প্রকাশ করে জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত কবিতা প্রশ্ন করে তাৎক্ষণিক জীবনকে, প্রাত্যহিক বেঁচে থাকাকে। আমরা এখানে, এই নতুন লিরিকবাদের যুগে আর গীতিময়তার পুনরাবিষ্কারে।... আমাদের রয়ে যাবে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আবেগপ্রবণতা (স্যুররিয়ালিজমের শেষ শিখাগুলো নিভে যায় ১৯৬৬-তে অঁদ্রে বে্রঁতোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে), যদিও তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দাবির বিরুদ্ধে যায় ফরাসি কবিতা, ভাষার দূষণ রোধ করতে। আমাদের আরো রয়ে যাবে আঙ্গিকের প্রতি এই মনোযোগ যা নিঃসন্দেহে ভেরল্যেন, র্যাঁবো ও মালার্মের পরে এত বড় হয়ে আর দেখা দেয়নি, এক ‘সমালোচনাধর্মী গীতিময়তা’র বিস্তার যার পুরোধা হয়ে দেখা দিচ্ছেন জঁ মিশেল মপোয়া, জেরার নুয়ারে অথবা আরিয়ান দেফ্রুসের মতো সাম্প্রতিকতমেরা। রয়ে যায় সহাবস্থান : যারা ভাষাকে ভাঙছেন আর যারা তাঁকে খুঁজছেন কবিতায়, সম্ভাবনা আর উদ্ভাবনায়; কিন্তু আমি অস্বীকার করি না যে সর্বোত্তম কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে এ দুই-ই আদতে একই।” সাম্প্রতিকতম সময়ে ফরাসি ভাষার যে কয়েকজন কবিকে এখনো পর্যন্ত প্রথম কাতারে দাঁড় করিয়ে শনাক্ত করা যায় ফরাসি কবিতার এ সময়কে, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে সবার আগে উঠে আসে ঈভ বনফোয়া, ফিলিপ জকোতে, ক্লেয়ার মালরু, জাক দ্যুপ্যাঁ প্রমুখের নাম। যারা এখনো পর্যন্ত তাদের স্ব-স্ব মেধাদীপ্ত লেখনীতে বিশ্বকবিতার প্রেক্ষাপটে অনন্য অবস্থানে তুলে নিয়েছেন ফরাসি কবিতাকে।

সমসাময়িক বা একালের ফরাসি কবিতার প্রধান এই চার কবির প্রত্যেকের কাব্যবৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্রভাবেই অনন্য ও শনাক্তকারী। আধুনিক-উত্তর মন, বিশ্বায়ন যুগের মানুষের একের মধ্যে অগণ্য বিচ্ছিন্নতা, অতিবাস্তবতা বা পরাবাস্তবতা, অতিন্দ্রিয়তা, জাদুময়তা, মৃত্যুচেতনাবোধ, কখনো মরমীবোধ, আধুনিক মানবমনের বহুবর্ণিল বিষাদময়তা, অপ্রাপ্তি, গভীর হতাশাবোধ, একাকিত্ব বা নৈঃসঙ্গবোধ, ভয়াবহভাবে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, উচ্চাকাকাঙ্ক্ষা, অন্যতর ভাবনায় গড়ে ওঠা যুগচেতনার বিকেন্দ্রিকতা- এসবই নানা ইঙ্গিতময়তা, সঙ্কেতময়তা, প্রতীকায়নের মাধ্যমে অপার নির্জনতা-নৈঃশব্দ্যতায় আজকের কবিতার ভাষায় (কখনো তাকে বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের আশ্রয়ে) কাব্যরূপ দিয়েছেন এই চার শুদ্ধবাদী ফরাসি কবি।   

কবিতায় নতুন বাস্তবের খোঁজে কিংবা ভিন্ন বাস্তবের ডানায় ভর করে আজকের উল্লিখিত কবিরা কেবল ছন্দোবদ্ধ পদ্যের সীমানায় সীমাবদ্ধ নেই, পা বাড়িয়েছেন গদ্যের বিপজ্জনক এলাকায়ও।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫