
শিল্পী কামরুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত
সমাজ ও রাজনীতি সচেতন শিল্পীদের মধ্যে শিল্পী কামরুল হাসান ছিলেন অন্যতম। কলকাতা আর্ট কলেজে চারুকলা শিক্ষা নিলেও সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের সময় তিনি জন্মস্থান বর্ধমান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। যোগ দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে চারুকলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। পটুয়া কামরুল হাসান ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নকশা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি লোকশিল্পীদের প্রচুর কাজ দেখেন, দেখেন সাধারণ মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা, যা তার সৃষ্টিকর্মকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।
এ দেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়ার দানবীয় প্রতিমূর্তি অঙ্কন করে (এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে) তিনি আলোচনায় আসেন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকত তার উপস্থিতি। এ রকম রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রতিনিধিত্বশীল শিল্পী আর কেউ ছিল কি না আমার জানা নেই।
এ ছাড়া সারাজীবন বাংলা-বাঙালি ও বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসন্ধান এবং একটি দেশীয় স্বকীয় চিত্রভাষা নির্মাণের চেষ্টায় ব্রতী থেকেছেন। সংগঠক হিসেবেও তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে, তিনি মুকুল ফৌজ নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। এসবই তার দেশপ্রেমের প্রগাঢ় পরিচয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার আঁকা ‘দেশ আজ এক বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’ এঁকেও তিনি ব্যাপক আলোচনায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন পুরোপুরি আধুনিক পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত একজন চিত্রশিল্পী। তার কাজে দেশীয় বিষয়বস্তু ও উপাদানের উপস্থিতি থাকলেও তার অঙ্কনরীতিতে পিকাসো ও মাতিসের প্রভাব প্রবলভাবে লক্ষণীয়। তার শিল্পকর্মে রোমান্টিক চেতনার ব্যবহারও তার আধুনিক মনস্কতার পরিচয় দেয়। নারী ও বাংলার প্রাণ-প্রকৃতিকে তিনি বিশেষ ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। কৃৎ-কৌশলে তিনি পাশ্চাত্য রীতির সঙ্গে দেশীয় রূপরীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে একটি স্বকীয়তা দিয়েছেন। তার ছবিতে নারী ও প্রকৃতি সমান্তরালভাবে এসেছে। নারীর দৈহিক সৌন্দর্য ও প্রকৃতি এই দুইয়ের আকর্ষণ তাকে রোমান্টিকতায় আবিষ্ট করেছে বলা যায়। ফলে নারীকে বিশেষ ভঙ্গিমায় উপস্থাপিত হতে দেখি বেশির ভাগ সৃষ্টিতে। স্নানরতা রমণীর ছবিটি লক্ষ করলে আমরা দেখব শিল্পী নারীর শারীরিক সৌন্দর্যকে প্রকৃতির একটি নির্জন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধনে রূপ দিয়েছেন। তার এই নান্দনিক প্রয়াস অতুলনীয়। তেল রঙে করা এই ছবিটি চিত্ররীতির দিক থেকে ফরাসি চিত্রশিল্পী হেনরি মাতিসের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়।
রং ব্যবহারে লোকজ প্রভাব থাকলেও তার ব্যবহার পদ্ধতি তার নিজস্ব। তার ছবিতে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি কালার ব্যবহারের আধিক্য রয়েছে। রয়েছে লোক শিল্পীদের মতো কালো রেখায় অবয়বকে মূর্তায়ন করার কৌশল। তাই বলে তার চিত্রকর্মকে ফোক বলার অবকাশ নেই। কিছু কাজ আছে যেমন ‘উঁকি’। এই চিত্রকর্মটি দেখে মনেই হয় না এটি তার কাজ। গোয়াশে করা এই ছবিটি পুরোপুরি প্রাচ্যরীতিতে করা এক অপূর্ব সৃষ্টি।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকদের তথাকথিত ইসলামী জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনের ভেতর বাস করেও তিনি ছিলেন আধুনিক চিন্তা-চেতনায় পুষ্ট একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা। আজীবন সমাজ-সংস্কৃতি -রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে অনন্য করে তুলেছেন। চেষ্টা করেছেন শিল্পের একটি দেশীয় ঐতিহ্য বিনির্মাণের। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।