
সাকিল মোহাম্মদ দীপন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
বাংলা গানের সূচনা হয়েছিল প্রায় হাজার বছর আগে সেই খ্রিস্টীয় দশম শতকে। সাধারণত বাংলা অঞ্চল মানে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষায় রচিত বিভিন্ন সুরে সমৃদ্ধ বাংলা গানের ধারাটি এই সমগ্র অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় সমাদৃত। এর প্রথম নিদর্শন ছিল চর্যাগীতি যা ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তবাংলা গানের প্রধানধারা হিসেবে বিবেচিত। চর্যাগীতির মূল বিষয়বস্তু হলো বৌদ্ধ সাধুদের জীবনাচার। চর্যাগীতির মাধ্যমে তারা ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের নৈতিক তত্ত্ব প্রচার করতেন। ছন্দে সুরে রাগের নাম এবং পদের শেষে পদকর্তা নাম থাকত। বাংলার প্রাচীন সঙ্গীতকলা সংস্কৃত স্তোত্রসঙ্গীত প্রভাবিত। এই সময়কার বৈষ্ণব ভাবাশ্রিত কিছু ধর্মসঙ্গীতিগুলো আজও পূর্ব ভারতীয় মন্দিরগুলোতে গীত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব বিরচিত গীতগোবিন্দম্ এই জাতীয় সঙ্গীতের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ।
মধ্যযুগের প্রথমপাদে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস ও বলরামদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাগণ রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমচেতনার একটি পার্থক্য দর্শিয়েছেন। বাংলা সংগীত ধারায় এরপরে এলো গীতগোবিন্দ, গীতগোবিন্দ মূলত সংস্কৃতে লিখিত, শ্রীকৃষ্ণের জীবনের নাটকীয় ঘটনায় ছিল গীতগোবিন্দের বিষয়বস্তু। গীতগোবিন্দ রচনা করেন রাজা লক্ষণ সেনের সভাপতি জয়দেব। গান পরিবেশন করতেন জয়দেব এবং নৃত্যে সহযোগিতা করতেন তার স্ত্রী পদ্মাবতী। এরপরের ধারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি মূলত রাধাকৃষ্ণের জীবনলীলা। শ্রীকৃষ্ণের জীবননির্ভর ছোট ছোট নাট্য দৃশ্যে ভাগ করা এটি। মূলত চণ্ডীদাস ছদ্মনামে বিভিন্ন সাধক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। এরপরে বৈষ্ণব পদাবলী এটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতই একটি ধারাবাহিক প্রকরণ। তবে বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য এর কাব্যিক ভাষা। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধারার গীত বৈষ্ণব পদাবলী ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহীর নরোত্তম দাসের নেতৃত্বে পাঁচটি ধারায় বিভক্ত হয়। মূলত নামকীর্তন বা পদাবলীর বিভিন্ন গল্পভিত্তিক গান নাম ছন্দে সুরে গাওয়ার মাধ্যমে বাংলা কীর্তন গানে গীতবিস্তারের সূচনা করে। ১২ শতকের এক অসামান্য বাঙালি কবি লেখা একটি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ আজও দক্ষিণ ভারতের কলাকেন্দ্রসমূহকে আলোকিত করে রেখেছে। কেবল দক্ষিণ ভারতেই নয়- জয়দেবের সংগীতপ্রতিভার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতবর্ষে। এমন কী ‘১৬ শতক রচিত শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে জয়দেবের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে।’ (পরেশচন্দ্র মন্ডল: বাংলাপিডিয়া)। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, “রাধাকৃষ্ণের ধ্যান-কল্পনাও বোধ হয় এই পর্বের বাঙলাদেশেরই সৃষ্টি এবং কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ- গ্রন্থেই বোধ হয় প্রথম এই ধ্যান-কল্পনার সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রচলিত রুপ আমরা দেখিতেছি।” (বাঙালীর ইতিহাস। পৃষ্ঠা; ৫৪৮) তার মানে দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের লেখাতেই প্রথম রূপ পেলেন শ্রীরাধিকা। শ্রীরাধিকা কল্পনা প্রথম করলেন জয়দেব। জয়দেবরচিত অন্যতম কাব্যগ্রন্থ হলো গীতগোবিন্দ। বিষয়: রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা গীতগোবিন্দের মূল বিষয়। কাব্যটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা। সংস্কৃত কেন? সেকালের রীতি। সময়টা সেন আমল। সেন রাজারা হিন্দু। সংস্কৃত দেবভাষা। এ জন্যই। করুণাময় গোস্বামী ‘বাংলা গানের বিবর্তন’ বইতে লিখেছেন: ‘বাংলা গানের ইতিহাসে, এবং বলতে গেলে ভারতবর্ষের সংগীত ও নৃত্যকলার ইতিহাসে এক অতুলনীয় স্থান অধিকার করে আছে গীতগোবিন্দ গ্রন্থটি।’ (পৃষ্ঠা, ২৩।
অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘রাধাকৃষ্ণের বিরহ-মিলন কাহিনি অবলম্বনে রচিত জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যটি সমধিক পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই কাব্যটির ওপর ৪০টিরও অধিক টীকা রচিত হয়েছে। তা থেকে এর সর্বভারতীয় খ্যাতির পরিমাপ করা যায়।’ (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। ২য় খণ্ড; পৃষ্ঠা, ৩৫৫) জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দের গানগুলো বলা যায় মানুষের গান। এর অন্তর্গত গানগুলো অষ্টপদী বা আট লাইনের। গীতগোবিন্দ বারোটি সর্গে ও চব্বিশটি গানে বিভক্ত। প্রতিটি গানের ওপরে রাগ ও তালের নাম লেখা আছে। চর্যাপদের শীর্ষেও তেমন রাগের নাম উল্লেখিত আছে। তবে তালের নাম উল্লেখ নেই। গীতগোবিন্দের কয়েকটি তালের নাম: রূপক, নিঃসার, যতি, একতালী, অষ্টতাল। রাগের নাম: মালবগৌড়, গুজ্জরী,কর্ণাট, দেশাখ, ভৈরবী, বিভাস, বসন্ত। গীতগোবিন্দ সংস্কৃত ভাষায় লেখা বলে সংস্কৃত সাহিত্যের অন্তর্গত। তবে সংস্কৃতকাব্যের সঙ্গে পার্থক্যও রয়েছে। যেমন অন্তমিল। গীতগোবিন্দের অন্তমিল বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আবার মধ্যযুগের শেষ পাদে রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্তপদাবলিকারগণ তাদের গানে ঈশ্বরকে শুদ্ধ মাতৃরূপে বন্দনার কথা বলেছেন। বৈষ্ণব ও শাক্তপদাবলি (শ্যামাসংগীত ও উমাসঙ্গীত) উভয়েরই মূল উপজীব্য হিন্দু ভক্তিবাদ বা ভক্তিবাদী দর্শন। বৈষ্ণব সঙ্গীতে যখন জীবাত্মা-পরমাত্মাকেন্দ্রিক প্রেমভক্তির তত্ত্বপ্রচারিত হয়, তখনই শাক্তগানে তন্ত্র ও শুদ্ধা মাতৃবন্দনার এক সম্মিলন গড়ে ওঠে। তবে বাংলা গানের সূচনা হয়েছিল প্রায় হাজার বছর আগে সেই খ্রিস্টীয় দশম শতকে। সাধারণত বাংলা অঞ্চল মানে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন সুরে সমৃদ্ধ বাংলা গানের ধারাটি এই সমগ্র অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় সমাদৃত। এরপরের ধারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি মূলত রাধাকৃষ্ণের জীবনলীলা। শ্রীকৃষ্ণের জীবন নির্ভর ছোট ছোট নাট্য দৃশ্যে ভাগ করা এটি। মূলত চণ্ডীদাস ছদ্মনামে বিভিন্ন সাধক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। বৈষ্ণব পদাবলীও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতই একটি ধারাবাহিক প্রকরণ। তবে বৈষ্ণব পদাবলীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর কাব্যিক ভাষা। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধারার গীত বৈষ্ণব পদাবলী ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজশাহীর নরোত্তম দাসের নেতৃত্বে পাঁচটি ধারায় বিভক্ত হয়। মূলত নামকীর্তন বা পদাবলীর বিভিন্ন গল্পভিত্তিক গান নাম ছন্দে সুরে গাওয়ার মাধ্যমে বাংলা কীর্তন গানে গীতবিস্তারের সূচনা করে। যা বর্তমান আমলের সিনেমার গান ও ব্যান্ড সংগীতকে প্রভাবিত করে। ১২ শতকের এক অসামান্য বাঙালি কবি লেখা একটি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ আজও দক্ষিণ ভারতের কলাকেন্দ্রসমূহকে আলোকিত করে রেখেছে। কেবল দক্ষিণ ভারতেই নয়- জয়দেবের সংগীতপ্রতিভার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতবর্ষে। এমন কী ‘১৬ শতক রচিত শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে জয়দেবের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে।’ (পরেশচন্দ্র মন্ডল: বাংলাপিডিয়া) ।
বাংলা গানের আরেকটি প্রাচীন ধারা হলো মঙ্গল গান মঙ্গল মানে শুভ যেকোনো শুভ অনুষ্ঠান বিবাহ বা লোকায়ত দেবদেবীর কাহিনী এই গানের বিষয়বস্তু। উল্লেখযোগ্য মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে এসে বাংলা গান একটি স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। সর্পদেবী মনসাকে কেন্দ্র করেই মনসামঙ্গল কাব্যের উদ্ভব। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর মতো কয়েকটি আধুনিক উপপুরাণ গ্রন্থে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়। লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিষ্ঠিত হয়। মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য। এই ধারার অপর দুই প্রধান কাব্য চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্যের তুলনায় মনসামঙ্গল প্রাচীনতর। এই কাব্যের আদি কবি কানাহরি দত্ত সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান ছিলেন। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অথবা বিহার অঞ্চলে। পরে পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গেও এই কাব্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
গবেষক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "বাংলা দেশের নানা অঞ্চলে বহু মনসামঙ্গল কাব্য পাওয়া গিয়েছে, তন্মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কাব্যগুলি ‘মনসামঙ্গল’ ও পূর্ববঙ্গে প্রায়শই ‘পদ্মাপুরাণ’ নামে পরিচিত। মনসামঙ্গল একটি আখ্যানকাব্য। এই কাব্যের প্রধান আখ্যানটিও আবর্তিত হয়েছে মনসার পূজা প্রচারের অভিপ্রায়ে। মনসামঙ্গল কাব্যের মূল চরিত্র চাঁদ সদাগর । যিনি মনসার পূজা না করলে তার পূজা পরিচিত হবে না। চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা করতে রাজি না হওয়ায় তার উপর মনসার দেবীর অত্যাচার, চাঁদের পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূ বেহুলার আত্মত্যাগের উপাখ্যান। এই কাব্যে সেযুগের হিন্দু বাঙালি সমাজের সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অনুপূঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি হরিদত্ত। বিজয় গুপ্ত এই কাব্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য এবং নারায়ণ দেব এই কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। অন্যান্য কবিদের মধ্যে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপলাই প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মনসামঙ্গল অখ্যানধর্মী পালা হিসাবে বিভিন্ন ধারা শাক্ত গীতি ও টপ্পা।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর মতো কয়েকটি আধুনিক উপপুরাণ গ্রন্থে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায় ।
লৌকিক দেবী হলেও কালক্রমে মনসা ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক হিন্দুসমাজেও প্রতিষ্ঠিত হয়। মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য। এই ধারার অপর দুই প্রধান কাব্য চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্যের তুলনায় মনসামঙ্গল প্রাচীনতর। এই কাব্যের আদি কবি কানাহরি দত্ত সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ বা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান ছিলেন। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অথবা বিহার অঞ্চলে। পরে পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গেও এই কাব্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
গান রচয়িতা রাই গুণাকরের হাতেই শাক্ত পদাবলীর সূত্রপাত। এই রূপটি মূলত পরবর্তীতে উৎকর্ষিত হয়েছে রামপ্রসাদ সেনের হাতে।বাংলার প্রাচীন সঙ্গীতকলা সংস্কৃত স্তোত্রসঙ্গীত প্রভাবিত। এই সময়কার বৈষ্ণব ভাবাশ্রিত কিছু ধর্মসঙ্গীতিগুলি আজও পূর্ব ভারতীয় মন্দিরগুলিতে গীত হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব বিরচিত গীতগোবিন্দম্ এই জাতীয় সঙ্গীতের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ। মধ্যযুগে নবাব ও বারো ভূঁইয়া নামে খ্যাত শক্তিশালী ভূস্বামীবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিপালিত সঙ্গীতধারায় আবার হিন্দু ও মুসলমান সাংগীতিক রীতির এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গানগুলোর অধিকাংশই ছিল ধর্মীয় সঙ্গীত। মধ্যযুগের প্রথম পাদে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস ও বলরামদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাগণ রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমচেতনার একটি পার্থক্য দর্শিয়েছেন। আবার মধ্যযুগের শেষ পাদে রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্তপদাবলিকারগণ তাদের গানে ঈশ্বরকে শুদ্ধ মাতৃরূপে বন্দনার কথা বলেছেন। বৈষ্ণব ও শাক্তপদাবলী (শ্যামাসংগীত ও উমাসঙ্গীত) উভয়েরই মূল উপজীব্য হিন্দু ভক্তিবাদ। ভক্তিবাদী দর্শন। বৈষ্ণব সঙ্গীতে যখন জীবাত্মা-পরমাত্মাকেন্দ্রিক প্রেমভক্তির তত্ত্ব প্রচারিত হয়, তখনই শাক্তগানে তন্ত্র ও শুদ্ধা মাতৃবন্দনার এক সম্মিলন গড়ে ওঠে।
অষ্টাদশ শতকের শেষে টপ্পা গানের মাধ্যমে নিধু বাবু (রামনিধি গুপ্ত) শুধুমাত্র নতুন গান অবতারণা করেননি বরং বাংলা গানে আনেন একটি মানবীয় অনুভূতির প্রকাশ। কারণ পূর্ববর্তী বাংলা গানগুলোতে ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয়। কিন্তু নিধু বাবুর টপ্পা সেদিক থেকে নরনারীর প্রেমানুভূতির প্রকাশ করেন। নিধু বাবা ৬ শত টপা সুরের মাধ্যমে প্রেমসংগীত রচনা করেন। টপ্পার সুর কবিগান পাঁচালীযাত্রা আখড়ায় ইত্যাদিকে প্রভাবিত করেছিল। বাংলায় টপ্পা গানে নিধু বাবু ছাড়াও কালিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেনউল্লেখযোগ্য। উনিশ শতকের অন্যান্য গীতধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচালী, কবিগান, যাত্রা ইত্যাদি। পাঁচালী মূলত পৌরাণিক গল্প বা লৌকিক উপকথাকে কেন্দ্র করে একটি পরিবেশনা। যেখানে থাকেন যন্ত্রী এবং দোহার। দোহার বা অভিনেতারা গানের কথোপকথন, গান, সংলাপ ও অভিনয় এর মাধ্যমে গল্পের চরিত্র-চিত্রনে সহযোগিতা করেন।
মঙ্গল গান রচয়িতা রাই গুনাকরের হাতেই শাক্ত পদাবলীর সূত্রপাত। এই রূপটি মূলত পরবর্তীতে উৎকর্ষিত হয়েছে রামপ্রসাদ সেনের হাতে। বাংলা শক্তিতত্ত্বের উদ্ভব ও বিস্তার ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তন্ত্রপুরাণের যুগে। এই তত্ত্বে শাক্তশক্তির পরিচায়ক হয়ে উঠেছিল দুর্গা। শাক্তরা দেবীকে নানা বিশেষণে অভিহিত করেছেন। বাংলায় শক্তি সাধনার ইতিহাস প্রাচীন হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর একবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) শাক্তসঙ্গীতের নবতর ধারার শুভ সূচনা করেন। রামপ্রসাদ সেন ছিলেন মূলত কালীসাধক। তিনি অধিকাংশ সময় কালী সাধনায় মগ্ন থাকতেন। কালীকে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন, তারই প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে। দৈবশক্তির কাছে নিজেকে সেবক রূপে নিবেদিত করার প্রথাগত ভক্তিবাদের সনাতন রীতিকে ভেঙে দিয়ে, দেবী মাতৃরূপ কখনো কন্যারূপে উপস্থাপন করেছেন। তাই তাঁর শাক্তসঙ্গীতে ফুটে উঠেছে মাতা-সন্তানের গভীর ভালোবাসা। নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে সভাকবির মর্যাদা দেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগের সুরবিন্যসের সূত্রে রামপ্রসাদী সুর ভিন্নতর সুরশৈলী তৈরি করেছিল। তাঁর গানে যে সব রাগরূপ পাওয়া যায় সেগুলো হলো- ইমনন, ইমন কল্যাণ, কালাংড়া, খাম্বাজ, গৌড় মল্লার, ছায়ানট, জয়জয়ন্তী, ঝিঁঝিট, পিলু, বসন্তবাহার, বাহার, বিভাস, বেহাগ, ভৈরবী, মালশ্রী, মুলতান, ললিত, সোহিনী ইত্যাদি। রামপ্রসাদ সেনেরর পরে অনেকে শাক্তসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। এঁদের ভেতরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২-১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনিও বহু শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেন। তিনি রামপ্রসাদী সুরের সাথে টপ্পার চলন মিশিয়ে নতুন ধারার সুরের প্রবর্তন করেছিলেন। দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত ‘বাঙালির গান’ গ্রন্থে তাঁর ৭৯টি গানের নমুনা পাওয়া যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রাহ্মধর্মের প্রসার এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বঙ্গদেশে সনাতন হিন্দু ধর্মের দেবদেবী-ভিত্তিক ধর্মে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মধর্মের সূত্রপাত ঘটেছিল 'আত্মীয় সভা'র মাধ্যমে। রামমোহন রায়ের পর, ব্রাহ্মধর্মের হাল ধরেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই ধর্মে সেকালের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ আকৃষ্ট হয়েছিল। এই সূত্রে বিকশিত হয়েছিল ব্রাহ্মসঙ্গীত। এছাড়া ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রসার ঘটে কোলকাতাকেন্দ্রিক সঙ্গীতাঙ্গনে। বিশেষ করে টপ্পা, ঠুমরি জাতীয় আধা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, নব্য থিয়েটার-ভিত্তিক গান, কলের গান ইত্যাদির প্রভাবে শাক্তসঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালী সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসের মাধ্যমে শাক্ত ধর্ম নব শক্তি লাভ করে। তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা রামকৃষ্ণ পরমহংসের সর্বধর্মের সত্য উপস্থাপিত হলেও, রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে শাক্ত ধর্ম শক্তিশালী রূপে প্রচারিত হতে থাকে। এই সূত্রে সে সময়ের বহু গীতিকার শাক্ত সঙ্গীত রচনা করতেন। উনিশ শতকের অন্যান্য ধারার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচালী, কবিগান, যাত্রা ইত্যাদি। পাঁচালী মূলত পৌরাণিক গল্প বা লৌকিক উপকথাকে কেন্দ্র করে চালু হয় একটি ভিন্ন ধারার পরিবেশনা। যেখানে থাকেন যন্ত্রী এবং দোহার। দোহার বা অভিনেতারা গানের কথোপকথন, গান, সংলাপ ও অভিনয় এর মাধ্যমে গল্পের চরিত্র চিত্রণে সহযোগিতা করেন। কবিগান মূলত দুইজন স্বভাব কবির গান ও কাব্যের লড়াই। কবির লড়াইয়ের একেক দলে প্রধান গায়কের সাথে যন্ত্রী দল এবং কাব্য রচনা সহায়ক একজন থাকেন। একজন কবি আল কাব্যে গানে প্রশ্ন করেন যাকে বলা চাপান এবং অপর কবি উত্তর দেন। সাধারণত রাতব্যাপী চলে এই কবিগান। উনিশ শতকের উল্লেখযোগ্য কবিয়ালদের অন্যতম ভোলা ময়রা, হরি ঠাকুর গোজলা এবং এন্টনি ফিরিঙ্গি। পলাশী যুদ্ধের পরে কলকাতার সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। ইউরোপীয় ক্লাব প্রেক্ষাগৃহে পরিবেশিত হতে থাকে অপেরা। ক্রমে ক্রমেই অপেরা থিয়েটার প্রভাবিত করে বাংলা সংগীতকে। দুটি নতুনধারা নাট্যগীতি ও গীতিনাট্য সৃষ্টি হয়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিনোদবিহারী দত্ত অতুল কৃষ্ণ ইত্যাদিরা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
উনিশ শতকের প্রারম্ভে দেশপ্রেমের গান বা স্বাদেশিক সংগীত বিকশিত হয়। এর পরবর্তী সময়কে বলে পঞ্চকবির যুগ। বাংলা গানের ইতিহাসে পঞ্চকবির গান। আধুনিক গানের এক বর্ণাঢ্য সংযোজন। বলা যায়, চর্যাপদ থেকে পদাবলী, চপ্পা, কবিগানের পথ পেরিয়ে আমরা আধুনিক সঙ্গীতের যে ধারায় পৌঁছেছি-তার শুরুটা করেছেন পঞ্চকবির গান। বাংলা গানের এই পঞ্চকবি হলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ আর নজরুল ইসলাম।
এঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম সবার আগে। মানে ১৮৬১ সালে। ১৮৬৩ সালে জন্ম দ্বিজেন্দ্রলালের, ১৮৬৫ সালে রজনীকান্তের, ১৮৭১ সালে অতুলপ্রসাদের আর সবশেষে ১৮৯৯ সালে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্ম। এঁরা সবাই কবি এবং তাঁদের গানগুলো তাঁরা নিজেরাই রচনা করেন। সুরও দেন তাঁরা। অবশ্য নজরুল তাঁর দু-তিন শো গানে নিজে সুর দেওয়ার সময় পাননি। অন্যদের বলেছিলেন সুর দেওয়ার জন্যে।এই পাঁচজনই গায়ক। বাংলা গানের জগতে পঞ্চকবির সবাই সমান অবদান রাখেননি বা রাখতে পারেননি। কেবল গানের সংখ্যা দিয়ে গানের ইতিহাসে একজনের অবদান বিচার করা যায় না। যাঁরা গানের ইতিহাসে নতুন আঙ্গিক প্রবর্তন করেছেন অথবা সুর-ধারার মোড় ফিরিয়েছেন, তাঁর আগে ছিল না, এমন পথ দেখিয়েছেন, সেই নতুন পথে মাইলফলক তৈরি করেছেন, তেমন ব্যক্তিই গানের ইতিহাসে জায়গা পেতে পারেন। পঞ্চকবির পরে বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় সমৃদ্ধ শাখা লোকসংগীত সৃষ্টি হয়। বাঙালি সংগীত প্রিয় জাতি। সাধারণ অর্থে জনশ্রুতিমূলক গানকে লোক সংগীত বলা হয়।
বাংলাদেশের লোক সংগীতের ধারাগুলো হলো চটকা গান, গম্ভীরা, ভাদু, আলকাপ বিয়ের গান ইত্যাদি। বাংলাদেশের সংগীত জগতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন লালন শাহ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, হাছন রাজা, ওস্তাদ আব্দুল করিম খা, সারাদেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা অজস্র গায়ক। সংগীতের এই বিবর্তনের পথে সঙ্গীত তার আধুনিকতার রূপ নেয়। সৃষ্টি হয় আধুনিক গান, ব্যান্ড সংগীত। ক্রমে ক্রমে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা সংগীতজগত একটি সমৃদ্ধ অবস্থায় পৌঁছে যায়। যার ফলে বর্তমানে আমরা বিভিন্ন ধরনের সংগীত এর সাহচর্য পাই।
লেখক : মিউজিশিয়ান