
প্রতীকী ছবি
মাঠ ভরা ধানে সোনালি ছোঁয়া লাগলেই গ্রাম-বাংলায় নবান্নে গন্ধ বাতাসে সুবাস ছড়ায়। কথায় আছে বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাংলাদেশের মানুষ উৎসবে-আনন্দে মেতে থাকতে পছন্দ করে। বাংলাদেশে প্রচলিত উৎসবের মধ্যে নবান্ন উৎসব অন্যতম। নবান্ন মানে নব বা নতুন অন্ন।
আমাদের দেশে নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষকরা এই উৎসব পালন করে থাকে। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে যখন আমন ধান কাটা হয় তখন নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। এই নতুন ধানের চাল দিয়ে রান্না উপলক্ষে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। নবান্ন হচ্ছে ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, একসময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। সমাজ ও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষের খাদ্য সংগ্রহ ও খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যকে কেন্দ্র করে উদ্ভব ঘটেছে নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানের। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় মানবসভ্যতার যখন খাদ্য আহরণ যুগ থেকে কৃষি অর্থনীতির যুগে উত্তরণ ঘটে তখন ফসল উৎপাদনের পেছনে কোনো না কোনো অদৃশ্য দৈব শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে নানা বিশ্বাস ও সংস্কার। বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের দৈবশক্তির সাহায্য প্রার্থনা করে নানা আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা যুক্ত হয়েছে এসব উৎসবে। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে নতুন চালের তৈরি পায়েস-পোলাও, পিঠা-পুলিসহ রকমারি খাদ্যসামগ্রী পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। পাশাপাশি পালন করা হয় সামাজিকভাবে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নানা আচার-অনুষ্ঠান। ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী এসব আচার-আনুষ্ঠানিকতায় বৈচিত্র্য রয়েছে।
মুসলিম কৃষক সমাজে নতুন ফসল ঘরে ওঠার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্য বাড়ি বাড়ি কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, মসজিদ ও দরগায় শিরনির আয়োজন করা হয়। সনাতন তথা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী অন্ন লক্ষ্মীতুল্য। তাই তারা এ দেবীর উদ্দেশ্য পূজা-অর্চনার আয়োজন করে। এ ছাড়া নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা নবান্নের অঙ্গ একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলে ‘কাকবলী’। একটি কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। কাকবলির আগে আরো তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হতো- লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ ও বীরবাশ। বরিশাল অঞ্চলে প্রচলিত আছে বীরবাশ প্রথা। বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করে তার চারপাশে পিটুলী দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। সেই বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাধতে হয়। এটাকে বীরবাশ বলে।
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাসব্যাপী উৎসব হতো আগেকার দিনে। এ উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালিদের বহুদিনের প্রথা ও বিশ্বাস।