জাতীয় কবির স্বীকৃতি পেতে ৫২ বছরের অপেক্ষা!

আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কে, একজন শিশুকেও এই প্রশ্ন করলে সে জবাব দেবে, কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু নজরুল যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। অবশেষে খুলছে সেই জটিলতা। কাজী নজরুলকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
ইতিহাস বলছে, ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে কাজী নজরুলের একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, এস ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ। সর্বভারতীয় বাঙালিদের পক্ষ থেকে দেওয়া সেই সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেন স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ব্যারিস্টার ওয়াজেদ আলী এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ বিশিষ্টজনরা। সেই অনুষ্ঠানেই কবি নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই থেকে নজরুল মুখে মুখে হয়ে যান জাতীয় কবি।
নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ সরকার কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ২৫ মে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় উদযাপন করা হয় তার ৭৩তম জন্মদিন। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি দেয়। ১৯৭৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবিকে ডিগ্রিপত্রটি প্রদান করা হয়। ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সেখানে লেখা হয় : ‘যেহেতু বাংলাদেশ সরকার এই মর্মে সন্তুষ্ট হইয়াছেন যে, জনাব কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের উপযুক্ত ব্যক্তি, সেহেতু ১৯৭২ ইংরেজি বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) আদেশের ৪ নং অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করিয়াছেন যে জনাব কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব বাংলাদেশের নাগরিক বলিয়া গণ্য হইবেন এবং তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন মোতাবেক যাবতীয় অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা উপভোগের অধিকারী হইবেন এবং প্রচলিত আইন কর্তৃক আরোপিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করিতে বাধ্য থাকিবেন।’ সরকারের পক্ষে ওই নাগরিকত্বের প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মনসুর উল করীম।
কিন্তু এই প্রত্যয়নপত্রেও নজরুলকে জাতীয় কবি উল্লেখ করা হয়নি। নজরুল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য ১৯৮৪ সালে জারি করা হয় নজরুল ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশ। সেখানেও ‘কবি’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অর্থাৎ তিনি যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি সেটি উল্লেখ নেই। তবে ২০১৮ সালে এই অধ্যাদেশ বাতিল করে যখন ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন করা হয়, সেখানে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর আগে ২০০৬ সালে তার নামে ময়মনসিংহের ত্রিশালে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হয়, সেই আইনে ‘জাতীয় কবি’ ব্যবহার করে সংসদে একটি আইন পাস হয়। আইনটি হলো ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৬।’ এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতেও তাকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি সেটি কখনো গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি।
প্রশ্ন হলো, ১৯৭২ সালে যখন তাকে বাংলাদেশে আনা হলো তখনই কেন গেজেট করা হলো না? ২০২২ সালের ২২ জুন কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী। পরে এ বিষয়ে একটি রুলও জারি করেন উচ্চ আদালত। কিন্তু এর আগে ওই বছরের ২৫ মে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছিলেন, ‘জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের স্বীকৃতির জন্য নতুন করে কোনো গেজেটের প্রয়োজন নেই। কেননা তিনি যে জাতীয় কবি, তা বাংলাদেশের একাধিক আইনের মধ্যেই রয়েছে। গেজেটের চেয়ে আইনই বড়।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তাকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু তা নিয়ে কোনো গেজেট প্রকাশ করেননি। এখন নতুন করে আবার গেজেট প্রকাশ হবে কবির প্রতি অবমাননাস্বরূপ।’
তবে মৃত্যুর পর হলেও নজরুলকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছিলেন তার পরিবারের সদস্য এবং নজরুলপ্রেমীরা। অবশেষে সেই উদ্যোগ নিল অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে যখন নজরুলকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় তখন তিনি ভীষণ অসুস্থ, বাকরুদ্ধ, কাউকে চেনেন না। ফলে ওই সময়ে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার অনুভূতি যেমন তাকে স্পর্শ করেনি, তেমনি মৃত্যুর ৪৮ বছর পরে যদি তাকে এখন জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়, তাতেও তার কিছু যাবে আসবে না। তবে এর একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব আছে। কেননা যে মানুষটিকে যুগের পর যুগ ধরে সবাই জাতীয় কবি হিসেবে জানে, বইপত্র এবং পত্র-পত্রিকায়ও যাকে জাতীয় কবি উল্লেখ করা হয়, সেই মানুষটি যে আসলেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি, তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকাটাই বরং লজ্জার। ৫২ বছর পর হলেও সেই লজ্জা নিবারণের যে উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। কবির উত্তরাধিকার তো বটেই, বাংলাদেশের মানুষের জন্যও এটি আনন্দের।