
ওস্তাদ জাকির হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
জন্মের পর থেকেই তবলার তাল, লয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো তার। বাবা তবলার কিংবদন্তী ওস্তাদ আল্লারাখা খানের বাদন কানে নিয়েই তিনি গড়ে তুলে ছিলো জীবনের বলয়। তবলার তাল দিয়ে তার জীবনের সূচনা। তিন বছর বয়সেই তার প্রথম তবলা বাজানো শুরু; আর সাত বছর বয়সে গুণীদের আসরে ঘরানার আলোকে গড়া হাতে বাজিয়েছেন। তবলার বোলে প্রায় ছয় দশক ধরে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন ওস্তাদ জাকির হোসেন। খ্যাতিতে বাবাকেও অতিক্রম করেছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই পুরোধা। অবশেষে থেমে গেল সেই ভুবনমোহিনী তাল, সেই বাদন। তবলার এই বরপুত্র যেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের লহরীর মাঝেই লীন হয়ে গেলেন।
ওস্তাদ জাকির হোসেন (৭৩)
ছিলেন একাধারে তবলা বাদক, সুরকার, সংগীত প্রযোজক, চলচ্চিত্র সংগীতকার ও অভিনেতা। তিনি
ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে পশ্চিমের সঙ্গীতের এক মেলবন্ধন তৈরী করেছিলেন। তার শাস্ত্রীয়
সঙ্গীত ঘরানাকে ঠিক রেখে পশ্চিমের পপ, জ্যাজ আর আভঁগার্দ সংগীতকে তিনি গ্রহণ করে তাকে
নিয়ে সুর তৈরী করেছিলেন দক্ষতার সাথে। তবলা বাদক হিসেবে পেয়েছেন বিশ্ব খ্যাতির চূড়ায়
আরোহন করেছিলেন। ওস্তাদ জাকির হুসেন জীবনের সুর ছিল তবলার তালে বাঁধা। জাদুকরি হাতের
বাদনে রীতিমতো কথা বলে উঠত তবলা। তাঁর বাজানো মোহনীয় বোলে নেচে উঠত শ্রোতার হৃদয়। তবলা
সাধনে সুর তাল অক্ষুন্ন রেখে বাদনে চমক আনতেন, বাজাতেন ভিন্ন আঙ্গিকের রীতি ব্যবহার
করে । তিনি সূচনা করেছিলেন বিশ্ব সংগীতের এক নতুন দিকের।
একই সঙ্গে তিনি তবলাকে আলাদা করেছিলেন নিজস্ব বাদন রীতির মধ্য দিয়ে। তার তবলা কনসার্ট ছিল একদম প্রাতস্বিক। আবার একই সঙ্গে তিনি সঙ্গত করতেন, সঙ্গীত প্রযোজনা করতেন। সঙ্গীতের বহুমুখী পথে ছিলো তার নিত্য আসা-যাওয়া। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের ফর্মকে অক্ষুন্ন রেখে তিনি বাজিয়ে গেছেন তার মতো করে নিজস্ব, রীতি ও ধারায়। তাতে তার মূল ঘরানায় কোন আঁচ লাগেনি এটাই ছিলো বড় বিষয়। তিনি বিশ্ববরেণ্য সব শিল্পীদের সঙ্গে তবলা সঙ্গত করেছেন।

এদের মধ্যে রয়েছেন পণ্ডিত
রবি শংকর, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, শিব কুমার শর্মা বা কথক নৃত্য শিল্পী বিরজু মহারাজসহ
অনেকেই। ১৯৯২ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মোমেন্ট রেকর্ড’। এর মাধ্যমে তিনি সংগীতানুরাগিদের
উপহার দিয়েছেন ভারতের ধ্রুপদী সংগীতের খ্যাতিমান সেরা সংগীত শিল্পী সহ সমকালীন বিশ্বসংগীত।
২০০৬ সালে ‘মোমেন্ট রেকর্ড’ এর মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যালবাম ‘গোল্ডেন স্ট্রিং অফ দ্য সরোদ’
গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত রচনা করেছেন তিনি। ছায়াছবিতে
অভিনয়ও করেছেন ওস্তাদ জাকির হুসেন। তিনি তার বাদ্যশৈলির মধ্য দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের
সংগীত জগতকে খুব কাছাকাছি আনতে পেরেছিলেন। তার বাদন রীতিতে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বাদনের সময়ে একটা আবর্তন পূর্ণ করে পরবর্তী আবর্তনে
যেভাবে তিনি প্রবেশ করতেন তার প্রকাশ ছিলো যেমন নান্দনিক, তেমনই সম্মোহনী।
তবলা বাদ্যযন্ত্রটি আমাদের
উপমহাদেশের সঙ্গী শুরু থেকেই ব্যবহার হয় সাধারণত সঙ্গীতের সাথে সঙ্গত করতে। ভারতীয়
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদি কাল থেকে তবলার ব্যবহার সঙ্গীতে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের মতো
সঙ্গত করতে। সেভাবেই তবলার ব্যবহার হয়ে আসছিলো। কিন্তু সেই সঙ্গতকারী ধারা থেকে স্বাধীনভাবে
তবলা বাদ্যযন্ত্রকে মূল ধারায় এনে ফেলার রূপকার তিনি। শুধুমাত্র একজন তবলাবাদকের বাদন
শুনতে হাজার মানুষ টিকিট কেটে লাইন দিচ্ছে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন শিল্পী জাকির
হোসেন। তাঁর একক বাজনা শুনতে মানুষ টিকিট না পেয়ে শীতের রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা
করছেন এমন বাদক ক’জন আছে। জাকির হোসেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একচ্ছত্র প্রাণোচ্ছল
তালপুরুষ বলা হলে ভুল হবে না।

ইনা পুরীর লেখা ‘শিবকুমার
শর্মা: দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ মিউজিক’ বইতে জাকির হোসেনকে নিয়ে বলা হয়েছে, শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতের জগতে যা অনেক সময় দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে সেই ছক ভাঙতে চেয়েছিলেন
শিবকুমারও, জাকির হোসেনের বিশেষ সখ্যতা ছিলো
যার সঙ্গে। ইনা পুরীর বইতে রয়েছে, পুণের এক অনুষ্ঠানে প্রথম পোস্টার দিয়ে জানানো হয়
‘শিবকুমার শর্মা-জাকির হোসেন’-এর যুগলবন্দি হতে চলেছে। যেখানে শিবকুমারের সঙ্গে পোস্টারে
ছিল জাকির হোসেনের একই রকম ছবি। সাধারণত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানের পোস্টারে যা
সচরাচর দেখা যায় না। সেখানে মূল শিল্পী অধিক স্থান দখল করে থাকেন। সহযোগী শিল্পীর জন্য
বরাদ্দ থাকে তুলনামূলক কম স্থান। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো হয় শিবকুমারের।
শিবকুমার সেই ‘যুগলবন্দি’র তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। পরে বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে বহু জটিলতা
হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ‘ইগো’ বা ‘অহং’ হল আত্মবিশ্বাসের একমাত্র আধার। কিন্তু আমি
তেমন মনে করি না। সমর্পণ থেকে আসে আত্মবিশ্বাস। সেই সমর্পণ থেকেই আসে শক্তি। ‘অহং’
আসলে ‘আমিত্ব’-এর জন্ম দেয়। শিল্পীর কাজ সাধনা করা এবং ভাবা। তিনি নিজে একটি মাধ্যম
মাত্র।’
অর্থাৎ, সহযোগী শিল্পীও যে
আসলে মূল শিল্পীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি স্পষ্ট করেছিলেন চিরকাল। যে কারণেই হয়তো
তাঁর একাধিক বাজনায় জাকির হোসেন সঙ্গত করলে তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকত পৃথক সময়। উদাহরণ
স্বরূপ কিরবাণী রাগটি স্মর্তব্য। দু’জনেরই যুবক বয়সের বাজানো অনুষ্ঠান। সাধারণত কিরবাণীর
মতো রাগ ঘণ্টাখানেক ধরে বাজানো হয় না। কিন্তু শিবকুমার বাজিয়েছিলেন। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা নিয়েছিলেন জাকির হোসেন। বাজনাটি এখনও ইউটিউবে পাওয়া যায়। শুনলে বোঝা যায়, গুণী
শিল্পীকে কী ভাবে জায়গা করে দিচ্ছেন অন্য জন। সহশিল্পীর জন্য দরজা বন্ধ করে নয়, তাঁকে
অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়েই পৃথক এক শৈলী তৈরি করতে চেয়েছিলেন শিবকুমার। যে ধারার সওয়ারি
আর একজন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তিনিও সুযোগ দেন সহকারীকে তাঁর শিক্ষা-বিদ্যা তুলে ধরার।
এই জাকির হোসেনের কান তৈরী,
বাদনের পরে মোহ তৈরী জন্য জাকির হোসের পিতা তবলার কিংবদন্তী আল্লাহরাখা খানের প্রচেষ্টা
ছিলো সীমাহীন। আল্লাহরাখা খান প্রতিদিন ঘণ্টাখানেক শিশুপুত্র জাকির হোসেনের কানে তবলার
বোল বলতেন । এরপর বয়স তিন হলে যখোন সন্তান তবলায় হাত রাখতে পারলো তখন তবলা সামনে দিয়ে
বাবা আড়ালে চলে যেতেন। দেখতেন, সে তবলা নিয়ে কী সন্তান জাকির হোসেন কি করে। তিন থেকে
সাত বছর পর্যন্ত এই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন আল্লা রাখা। তত দিনে জাকির হোসেনের মনের
অন্দরে তাল প্রবেশ করেছে। অলক্ষেক্ষ থেকে বাবা দেখতেন, পুত্র চেষ্টা করছে। আল্লা রাখা
এরমধ্যে কিছু বিষয় জাকির হোসেনকে কিছু কিছু জিনিস দেখিয়ে দিতেন।
উস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ সাহেব
শুধু তার পিতা ছিলেন না, ছিলেন গুরুও। আল্লারাখা নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়েছিলেন
জাকির হোসেনকে। বহু ত্যাগ তিতিক্ষা ও সাধনার মধ্য দিয়ে জাকির হোসেন বিশ্বনাগরিক হতে
পেরেছিলেন। তবলাকে ভারত তথা উপমহাদেশের গণ্ডি পার করে বিশ্বজনীন করতে সমর্থ হয়েছিলেন
তিনি। সমস্ত অপূর্নতাকে পূর্ন করে তারপরে এই কিংবদন্তী বাদক মিলিয়ে গেলেন নিরন্তরের
পথে।
তবলা নামের উপমহাদেশীয় বাদ্যযন্ত্রটিকে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের বিশেষ এক ধারায় যুক্ত করা ছিলো তার একান্ত প্রচেষ্টা। তবলার বাদনের সৌকর্যের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ব চরাচরে তাতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর এর জন্য ছিলো তার কঠিন সাধনা। যে কারণে, সাধারণ কোনও বোলও ওঁর হাতে হয়ে উঠত অসাধারণ। তার মতো তবলার বোলে সৌকর্য নিখুঁতভাবে তোলা কোন সহজ কাজ নয়। জাকির হোসেনের বাদন দেখে যেটা বোঝা সবার সম্ভব না। খুব কম শিল্পী তবলা বাদনে এও ধরনের বিস্তার ব্যবহার করতে পারেন। জাকির হোসেন সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন- তিনি পেরেছিলেন।
যে কোনও শিল্পেই পরিবেশন খুব
গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে, যিনি ততটা ধ্রুপদী তবলা শুনতে স্বচ্ছন্দ নন, তাঁদের জন্য
থাকত নানা উপকরণ। ইরান-ইরাক যুদ্ধের আবহে সাদ্দাম হোসেনের তোপ কিংবা ঘোড়ার খুরের শব্দ
বা বিমান ওড়ার শব্দ কিংবা ডমরু -শঙ্খধ্বনি- বাঘের ডাক সবই তিনি তবলায় আনতে পারতেন।
কে শুনবে না তার বাদন? তার এই যাওয়া বড় কষ্টের বড় বেদনার। দীর্ঘদিন ধরে জাকির হোসেন
রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছিলেন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে হার্টের
ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে তাকে সান ফ্রান্সিসকোর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা
অত্যন্ত সংকটাপন্ন এবং চিকিৎসকরা খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। ৭৩ বছর বয়সী এই শিল্পী
বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। যে কারণে তার আসন্ন কয়েকটি অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়েছিল।
উপমহাদেশের তবলার এই কিংবদন্তি গত রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর
একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বিশ্বের কোটি কোটি ভক্তদের
শোকাহত করে অতঃপর তিনি চলে গেলেন অসীমের ঠিকানায়। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পদ্মশ্রী,
পদ্মভূষণ, গ্র্যামি ছাড়াও আরো বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বহুমুখী প্রতিভার
অধিকারী জাকির হোসেন মানেই বহুমুখী শিল্পের দশ দিক। তিনি ছিলেন তবলা শিল্পের সর্বোত্তম
শিল্পী একথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। এই মহান শিল্পীর মহাপ্রয়াণে তার জীবন ও কর্মের
প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
জাকির হোসেনের জন্ম ১৯৫১ সালে
ভারতের মুম্বাই শহরে। জাকির হোসেনের বাবা ওস্তাদ আল্লারাখা খানও প্রখ্যাত তবলাবাদক
ছিলেন। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের এই পুরোধা ১৯ বছর বয়সে মানে ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে
পাড়ি জমান। শুরু হয় তাঁর আন্তর্জাতিক সংগীতাঙ্গনে বিচরণ। তারপর থেকেই বহু খ্যাতিমান
সংগীত শিল্পী যেমন জন ম্যাকলাফলিন, মিকি হার্ট, বিল ল্যাসওয়েল, ভ্যান মরিসন, জো হেন্ডারসন
ও আরো অনেকের সাথে তবলা পরিবেশন করেন তিনি। তবলার এই কিংবদন্তী তার বাদনের স্বীকৃতি
হিসাবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, গ্র্যামি ছাড়াও আরও বহু পুরস্কার
ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জাকির হোসেন। জাকির হোসেন একটি
প্রতিষ্ঠানের নাম। তবলার দিকে তাকালে সবার তাকে মনে পড়বে-এ বিশ্বাস আমরা লালন করি।