Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

হেলাল হাফিজের কবিতা জলে জ্বলা ব্যাপ্ত আগুন

Icon

এমরান কবির

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:০৭

হেলাল হাফিজের কবিতা জলে জ্বলা ব্যাপ্ত আগুন

কবি হেলাল হাফিজ। ছবি: সংগৃহীত

নেত্রকোনা জেলার বড়তলী গ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়া এক তরুণ একটি কবিতা লিখে অগ্রজ আহমদ ছফাকে দেখালেন। তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না। আরেক কবি হুমায়ুন কবিরকে সঙ্গে নিয়ে সোজা চলে গেলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার দপ্তরে। পেছনে পেছনে দুরু দুরু বক্ষে সেই তরুণ।

অগ্রজ সেই কবি কবিতায় চোখ বুলাতে লাগলেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ মিছিলের সব হাত/ কণ্ঠ/ পা/ এক নয় .../ কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়/ যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান/ তাই হয়ে যান/উৎকৃষ্ট সময়, কিন্তু আজ বয়ে যায়।’ সফেদ চুলের সেই কবি, আহসান হাবীব, যিনি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন, যিনি জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী, তিনি মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘এই কবিতাটি ছাপা যাবে না। ছাপলে আমার চাকরিটা চলে যাবে। পত্রিকা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তবে একটা কথা বলি, হেলালের আর কোনো কবিতা না লিখলেও চলবে।’

নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় নামীয় সেই কবিতা কবি আহসান হাবীব দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য পাতার জন্য নিষিদ্ধ করলেও বাংলা কবিতার পাঠক এই কবিতাকে এবং কবিকে নিষিদ্ধ করেনি। টিএসসির দেওয়ালে লিখিত (চিকা মারা) হওয়ার পর স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ছাপা হয়ে গিয়েছিল সেই কবিতা। হয়ে উঠেছিল এক অভিনব অস্ত্র- যার নাম দেওয়া যেতে পারে দেয়ালাস্ত্র (দেওয়াল-অস্ত্র)।

একটি কবিতা বা তার কিছু লাইন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম সারথী হয়ে ওঠা কিংবা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণাদায়ী হয়ে ওঠা সত্যিই গর্বের। কবি হেলাল হাফিজ সেই বিস্মিত-গর্বের জন্মদাতা।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ¦লে’ আজও সমান জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তা আবার যেনতেন সরল-তরল-লঘু নয়। এ যাবৎ পঞ্চাশটির অধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এই কাব্যের। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত ও মোহিত হচ্ছে। বাংলা কবিতার ইতিহাসে কোনো কবিতার বই এত বিক্রি হয়নি।

এরপর তার দীর্ঘ শীতনিদ্রা। কবিতা থেকে, দৃশ্য থেকে, প্রকাশ্য থেকে। কিন্তু পাঠকের স্মৃতি থেকে তিনি নিষ্ক্রান্তি পাননি কখনোই। তার স্বেচ্ছা আত্মগোপন এতটাই গোপনীয় ছিল যে অনেকেই ভেবেছিল তিনি মারা গেছেন। দীর্ঘ ২৬ বছর পর ২০১২ সালে তিনি জনসমক্ষে আসেন। বের হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের কবিতাসমগ্র ‘এক জীবনের জন্মজখম’। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এরপর শোনা যায় তিনি আত্মজীবনী লিখছেন। সেই স্মৃতিকথার তাও এখন জানা যায় না।

হেলাল হাফিজের কবিতার সঙ্গে লীন হয়ে আছে এই বাংলার স্পন্দন, আমাদের বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ঘটনা একাত্তরের প্রতিটি দিনের ঝাঁঝালো যৌবন, বাঙালি নারীর রহস্য-রূপ,  প্রেমাষ্পদের নিদারুণ নিবেদন, হৃদয়ের কোমল আর্তি, প্রেমিকের সরল আকুতি, বিরল আত্মত্যাগ, আত্মদহনের করুণ ব্যাপ্ত আগুন, মানুষে মানুষে দ্বিধাবিভক্তির তির্যক আমূল বিদ্ধ তীর। তাইতো একটি কবিতার কয়েকটি লাইন হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতাকামীদের স্লোগান। হয়ে উঠেছিল অভ্যুত্থানের তরঙ্গ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার শৈল্পিক লিফলেট। কবিতার কথাগুলো ফিরেছিল সবার মুখে মুখে, হৃদয়ে হৃদয়ে। দিনে দিনে অর্থশত বছর পেরিয়েও যার যৌবন শেষ হলো না। বরং দীপ্তমান এর পূর্ণাঙ্গ অভিব্যক্তি নিয়ে নিয়ত প্রেরণ করে প্রেরণা। এখনো সংকটে তার কবিতার লাইন আমাদের নিজস্ব ভাষা হয়ে ওঠে। এমনকি কবির নাম না জানলেও কবিতার এই চরণ ধারণ করেছে অনেকেই। যেন জীবন্ত প্রবাদ। রচনাকারীর পরিচয় এখানে মুখ্য নয়। মুখ্য হলো বক্তব্যের গুরুত্ব। কবির জীবৎকালে তারই রচিত পঙক্তি এ রকম প্রবাদের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়াতে তিনি নিশ্চয়ই সুখী হয়েছিলেন!

নদী কি নারীর মতো/ নারী কি পুতুল/ নারী নীড়ের নাম/ টবে ভুল ফুল?’ নারী মানেই তো অন্তহীন রহস্য। কবিও সেই প্রশ্নের ভেতরে রহস্য গেঁথে দেন। মায়ের মৃত্যু, প্রেমাষ্পদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নারীকে নিয়ে দ্বিধান্বিত কবি। ঘর করলেন না। আড়ালের জীবনে নিজেকে জড়িয়েছেন অপ্রচলিতভাবে। রহস্যজনকভাবে। আত্মজীবনী বের হলে হয়তো বা সেই আলো-আঁধারির জীবন নিয়ে জানা যাবে অনেক কিছু। তার পরও খুব সহজ করে যদি বলি দুঃখের আরেক নাম নয়, মিথ ও মিথ্যার আরেক নাম নয়- আসলে কবিতার আরেক নাম হেলাল হাফিজ। যার কবিতায় জলও জ্বলেছে, আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন শারীরিকভাবে। কিন্তু যা দিয়ে গেলেন তা জ্বলতে থাকবে আরো ব্যাপ্ত হয়ে, সব সময়। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫