
প্রতীকী ছবি
গ্রাম, মফস্বল এসবের কোনোটাই রেমির ভালো লাগে না। কিন্তু তার বাবা খলিল সাহেব এত বড় ডাক্তার হয়ে শেষ বয়সে মফস্বলের একটা মহিলাকে বিয়ে করে বসবে, সে ভাবতে পারেনি। বাবার বিয়ে নিয়ে রেমির যতটা বিরাগ দেখানোর কথা ছিল ততটা সে দেখায়নি। মায়ের কোনো স্মৃতি তার নেই। বাবাকে আজীবন দেখেছে অতি খুশি মনে তাকে লালন-পালন করতে। কষ্ট হয় এমন কোনো সিদ্ধান্তই কখনো নেয়নি। সারা জীবন মোটামুটি নিঃসঙ্গই পার করে দিতে বসেছিল। হঠাৎ এই ৬০-এর কোঠায় এসে তার যদি অন্য কিছু মনে হয় তাহলে তাতে খুব চট করে রাগ দেখানো যায় না। আগে বুঝতে হয় ঘটনাটা কি!
তবে ঘটনা কি বোঝার ব্যাপারে রেমি খুব একটা মাথা ব্যয়ও করেনি। যেদিন সে জানতে পারল তার নতুন মা এ বাড়িতে এসে থাকবে না, থাকবে তার নিজের যশোরের বাড়িতে, বাবা শুধু সপ্তাহে দুই-তিন দিনের জন্য সেখানে যাবেন তখন সে ব্যাপারটা নিয়ে আর রাগ-বিরাগের বাড়াবাড়ির প্রয়োজন দেখলো না। বিপত্তি হলো তখন থেকে যখন থেকে বাবা যশোরে আসার সময় তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চাইল।
রেমি আপত্তি তুলল প্রবল, তবু বাবার কখনো রাগী, কখনো করুণ মুখটার কাছে প্রায়ই হারতে শুরু করল। এবারের আগমনের ঝঞ্জাটাও তেমনই এক হারের ফল। ঢাকা থেকে এত দূরে প্রায় অচেনা এই ভদ্রমহিলার বাড়িতে দুই দিন পর পর উপদ্রব হয়ে আসা শাস্তি ছাড়া আর কি!
অবশ্য রেমি নিজে উপদ্রব হতে যাবে কেন? উপদ্রব তো এ বাড়ির মহিলা নিজে কিংবা এই বাড়িটা কিংবা এই শহরটা। আর সবচেয়ে বড় উপদ্রব হলো বাড়িতে থাকা ভদ্রমহিলার ভাগ্নে সৌরেন।
এই ছেলের চালচলন, কথাবার্তা, কাজকর্ম সবই রেমির অপছন্দ। রেমির বদ্ধমূল ধারণা, সে যেখানেই যায় এ ছেলে তার পিছু পিছু যায় আর আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথম দিন থেকেই রেমি ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। সে যখনই ছাদে আসে, সৌরেন তার কিছুক্ষণ পর সিঁড়িঘরে ঘুরঘুর করতে থাকে। সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে একটু সামনেই কোথাও হাঁটতে যায়। ওই ছেলেটাকেও ৫ মিনিটের মধ্যে রাস্তায় দেখা যায়। অবশ্য বাড়ির মধ্যে তাকে কখনো রেমির আশপাশে দেখা যায়নি! না যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। সবার সামনে ঘুরঘুর করার সাহস সে পায়ই বা কোত্থেকে!
এই যে রেমি চায়ের কাপ হাতে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে ঠিক জানে, আগামী ১০ মিনিটের মধ্যে সৌরেনকে সিঁড়িঘরে দেখা যাবে। রেমি ঠিক করেছে আজ যে করেই হোক ব্যাপারটার মুখোমুখি সে হবেই। খুব অস্পষ্টভাবে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সৌরেনই আসছে।
রেমি সিঁড়িঘরের দিকে এগিয়ে গেল, যা ভেবেছিল তা-ই। ছেলেটা কয়েক ধাপ নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য সে ছাদের দিকে তাকিয়ে নেই। তাকিয়ে আছে পাশের খোলা জানালার দিকে। সূর্য ডুবতে আর কিছুক্ষণ বাকি। দিনের সবচেয়ে সুন্দর রোদটুকু জানালা গলে ছেলেটার মুখে পড়ছে। রেমি কিছু বলল না। কয়েক সেকেন্ড থমকে রইল। তার মাঝেই সৌরেন পূর্ণ দৃষ্টিতে রেমির দিকে তাকাল।
-আপা! কিছু বলবেন?
রেমি কিছুটা চমকে উঠল।
-আপা কিছু বলবেন মানে? তুমি এখানে কী করছ?
-জি?
-কী জি? আমি লক্ষ করেছি যে এ বাড়ির বাইরে যখনই যেখানে যাই তার একটু পরই তুমিও সেখানে গিয়ে হাজির হও। ব্যাপারটা কি! তুমি কী ভেবেছিলে? আমি টের পাব না? সৌরেন রেমির দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাতের লুকিয়ে রাখা সিগারেট সিঁড়িঘরের দেওয়ালে লেগে নিভে নিভে যাচ্ছে।
-কী? চুপ করে আছ কেন? কথার উত্তর নেই?
-আপা, আপনার লক্ষ না করার মতো কিছু তো আমি করিনি! আমাকে তো খালুজান বলেই রেখেছেন আপনি বাসার বাইরে গেলে আমি যেন আশেপাশে থাকি। কারণ আপনি এই এলাকায় নতুন। মানে আপনি মফস্বলেই নতুন।
রেমি কয়েক মুহূর্ত কিছু বলার মতো ভেবেও পেল না। ছেলেটা অস্বাভাবিক কিছু বলছে না। বাবা এই নির্দেশ ওকে দিতেই পারে। আর সত্যিই তো। ছেলেটা আশেপাশে থাকলেও চোরের মতো লুকিয়ে তো থাকত না। রেমি এতদিন এইসব কি ভেবেছে! কেন ভেবেছে! রেমির হাত-পায়ের আঙুলগুলো জ্বলছে। ইচ্ছা করছে সৌরেনকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিতে। সঙ্গে বারবার মনে হচ্ছে তার নিজের শরীর যেন নীল হয়ে যাচ্ছে। রেমি কোনো সময়ক্ষেপণ না করে ধীর পায়ে নিচে চলে এলো।
রুমে এসে দরজা বন্ধ করার পর রেমির মনে হলো সে হয়তো মানসিকভাবে অসুস্থ। তার এত ভয়ংকর রাগ কেন হচ্ছে? সৌরেন কি বলল এগুলো? কেন বলল? এসব কি রেমি শুনতে চেয়েছিল ওর থেকে? তাহলে কোন সাহসে বলল সে? দরজায় কে যেন হালকা কড়া নাড়ছে। ওপাশ থেকে রাবেয়ার কোমল গলা শোনা যাচ্ছে। রেমি মুখভঙ্গি যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে উঠে গিয়ে দরজা খুলল।
-মা! ছাদে গিয়েছিলে বুঝি?
-জি
-চোখ-মুখ এমন লাগছে কেন?
-খুব মাথা ধরেছে।
-বিকেলে তোমার চা খাওয়ার স্বভাব। না খেয়ে ছাদে ঘুরঘুর করছিলে মাথা তো ধরবেই।
-ঠিক হয়ে যাবে।
-হতেই হবে! তুমি যখন ছাদে তখন আমি সৌরেনকে বলেছিলাম ছোট ফ্লাক্সটাতে দুই কাপ চা করে তোমার রুমে রেখে আসতে। একটু দেখ তো সৌরেন কোথাও ফ্লাক্স আর কাপ রেখে গেছে কি না?
রেমি পাশে তাকিয়ে দেখল ওয়ার্ডরোবের পাশের ছোট গোলটেবিলটায় একটা ফ্লাস্ক আর একটা কাপ। কাপের ওপর পিরিচটা উলটো করে রাখা।
রেমি রাবেয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল
-জি, রেখে গেছে।
-আচ্ছা। তাহলে তুমি চা খেয়ে একটু রেস্ট করো। মাথা ব্যথা সেরে যাবে।
-আচ্ছা।
ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর রেমি দরজাটা বন্ধ করে দিল। গোল টেবিলটার পাশে এসে দাঁড়াল। ফ্লাস্ক আর কাপ ছাড়াও টেবিলে একটা মিনি বাসে দুটি টকটকে লাল গোলাপ রাখা। এটা আগে ছিল না। কোত্থেকে এলো এই জিনিস? কে রেখে গেল? কেন রাখল?
সামান্য একটা ঘটনা। তবু রেমি কোনোভাবেই স্থির থাকতে পারছে না। তার খুব ইচ্ছা করছে রাবেয়া বেগমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে যে তার টেবিলে গোলাপ কে রেখেছে। প্রশ্নটাও সামান্য ও প্রাসঙ্গিক। চাইলেই সে পাশের রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসতেই পারে।
রেমি গেল না। তার খুব ভয় হলো। রাবেয়া বেগমও যদি এমন কিছু বলেন যা রেমি শুনতে চাচ্ছে না!