
পল্লীকবি জসীম উদদীন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
পল্লীকবি জসীম উদদীন বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। যিনি গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতিকে তার লেখনীতে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ‘পল্লী কবি’ নামে খ্যাত। তার রচনাগুলোতে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবন, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির এক জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, জসীম উদদীনের কবিতা গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। তার রচনায় পল্লী মেলার গান, পালাগান, গাজির গান এবং গ্রামীণ উৎসবের রঙিন চিত্রায়ন পাওয়া যায়। তার গীতিকবিতাগুলো বাংলার লোকসংগীতের সঙ্গে মিশে গিয়ে আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়।
জসীম উদদীনের সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয় ছাত্রজীবনেই। তার প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘কবর’। এটি তার ছাত্রজীবনে রচিত হলেও পরে ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। দাদির কবরের পাশে বসে নাতি তার শৈশবের স্মৃতি আর পরিবারের আন্তরিকতা স্মরণ করছে। এটি আজও বাংলা সাহিত্যের অনন্য একটি কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
জসীম উদদীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ফুটে উঠেছে। তার লেখা ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এবং ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ তার দুই গ্রন্থ। এখানে প্রেম, বিয়োগান্তক ঘটনা এবং গ্রামীণ জীবনের চিত্র এতটাই জীবন্তভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে আজও গ্রন্থগুলো পাঠকদের হৃদয়ে দাগ কাটে।
‘নকশী কাঁথার মাঠ’ একটি কাব্যনাট্য। এটি জসীম উদদীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলা যায়। যেখানে বাংলার গ্রামীণ জীবন, প্রেম, বিরহ এবং মৃত্যুর এক অনবদ্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। রূপাই ও সাজু নামের দুই চরিত্রের প্রেমকাহিনি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এটি গ্রামীণ জীবনের প্রকৃত রূপও তুলে ধরে। এই কাহিনিতে বাংলার মেঠোপথ, পুকুরপাড়, ধানক্ষেত এবং কাঁথার নকশার মতো ঐতিহ্য এতটাই জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে পাঠক যেন পুরো গ্রামীণ পরিবেশের অংশ হয়ে যান।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ আরেকটি বিখ্যাত রচনা, যা জসীম উদদীনের কবি-প্রতিভার উৎকর্ষকে প্রমাণ করে। এখানে গ্রামীণ প্রেমের সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-দুর্দশার এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। এই কবিতায় মানুষের অন্তর্দহন এবং প্রকৃতির মাধুর্যের সমান্তরালভাবে উপস্থিতি এক গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। এটি বাঙালি পাঠকদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। জসীম উদদীনের কবিতায় প্রকৃতি কখনো পটভূমি নয়, বরং তা একটি জীবন্ত চরিত্র। তার কবিতাগুলোতে নদী, মাঠ, ভোর- সবকিছু এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে যে পাঠক মনে করেন তিনি সরাসরি সেই পরিবেশে উপস্থিত।
১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া কবি ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তবে তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ।