
কাজী আনোয়ার হোসেনকাজী আনোয়ার হোসেন। ফাইল ছবি
কাজী আনোয়ার হোসেনকে মাসুদ রানার জনক এবং সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই চেনেন সবাই। তবে এর বাইরেও তার নানা পরিচয় আছে। আগামী ১৯ জানুয়ারি তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তার জীবনের নানা দিক এবং ঘটনা নিয়েই এ আয়োজন। তথ্যগুলোর বেশির ভাগ তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার থেকে জানা।
টানা ১০ বছর ধানমন্ডি লেকে নিয়মিত মাছ শিকার করেছেন তিনি। তার ধরা সবচেয়ে বড় মাছটির ওজন ছিল আধমণের মতো। এই নেশা এতটাই বেশি ছিল যে, কোনো কোনো দিন ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত লেকে ব্যস্ত থাকতেন মাছ শিকারে।
দলের বেশির ভাগই ছিলাম আমরা ধানমন্ডি লেকের মৎস্যশিকারি। আমাদের মধ্যে পাখি শিকারের পাগল ছিলেন লুডু খান। আমি ষাটের দশকেই পাখির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আশির দশকে রব ভাই, কালা ভাই আর আমি ছিলাম জেনুইন মৎস্যশিকারি...লুডু খানের পাল্লায় পড়ে আমরা সবাই জোট বেঁধেছিলাম পাখি শিকারে। লুডু ভাইয়ের এক নিপাট ভদ্রলোক বন্ধু শারফুদ্দীন টিপুও জুটে গিয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। রব ভাই তো উৎসাহের আতিশয্যে বন্দুক-রাইফেল-পিস্তল কিনে রীতিমতো বন্দুকবাজই বনে গিয়েছিলেন…’
সেগুনবাগিচায় নিজের বাড়িতে দোতলায় বসে লিখছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সকাল সোয়া ১০টার মতো বাজে তখন। হঠাৎ একটা পিস্তলের আওয়াজ ও হইচই শব্দ। রাস্তার তেমাথায় গণ্ডগোল হচ্ছে। চিৎকার বেড়ে গেলে বারান্দায় এসে রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে তারা বলল, দুজন ডাকাত ধরা পড়েছে। ক্যামেরা নিয়ে ছুটলেন। গিয়ে দেখলেন কয়েকজন লোক মারছে এক যুবককে। লোকজন বলাবলি করছে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ব্যাংক লুট করে পালাচ্ছিল তিনজন হাইজ্যাক করা গাড়ি নিয়ে, ব্যাংকে একজনকে গুলি করে মেরে রেখে এসেছে, বাধা দেওয়ায় এক ট্রাফিক পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। পুলিশ পিছু ধাওয়া করলে পালাতে গিয়ে রাস্তায় গাড়িচাপা দিয়ে মেরেছে দুজনকে। পরে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পালানোর সময় গুলি ছুড়েছে রিভলবারের। একজন পালিয়ে গেছে। বাকি দুজন ধরা পড়েছে। লোকজন মারছে ওদের। ঠেলাঠেলির মধ্যে আরেকটু এগিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেন। সবাই মারছে। ডাল ভেঙে নিয়েছে কেউ। এরই মধ্যে মোটা একটা মুগুর সংগ্রহ করে ফেলেছে একজন কোথা থেকে। কিল, ঘুষি, লাথি, কনুই চলেছে। মারের চোটে রাস্তায় শুয়ে পড়ল সিদ্দিক নামের একজন। পরে কাগজ দেখে নামটা জানতে পারেন কাজী আনোয়ার হোসেন। মেরেই চলেছে সবাই নেশাগ্রস্তের মতো।
ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল ধাক্কাধাক্কিতে। ওদিকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পাঁচিল টপকে মহিলা পরিষদের অঙ্গনে লাফিয়ে পড়েছে অপর ছেলেটা, যার নাম ফারুক। ৩০-৪০ জন ঢুকে পড়ল পিছু পিছু। শিলাবৃষ্টির মতো পড়ছে কিলঘুষি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফারুকের পুরো শরীর। হঠাৎ দেওয়ালের পাশে কয়েকটা ১০ ইঞ্চি ইটের সন্ধান পেল জনতা। তাই দিয়ে মারতে শুরু করল দমাদম। ক্যামেরা হাতে কাজীদাকে দেখে ফারুক ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে।
‘বাঁচান, ভাই। আমারে বাঁচান।’ শেষ পর্যন্ত ফারুককে বাঁচানো যায়নি। মব লিঞ্চিংয়ের নির্মম উদাহরণ হিসেবে রক্তাক্ত ফারুকের ছবি কাজীদা ঠিকই তুলে ফেলেন, তবে তাকে বাঁচাতে না পারার যে অপরাধবোধ তার কথা উল্লেখ করেছেন লেখায়।
পরে জানা গেল, ব্যাংক লুট করেনি ওরা, গাড়িটা হাইজ্যাক করা কি না তাতে সন্দেহ আছে, ব্যাংকের কাউকে গুলি করে খুন করেনি ওরা, ট্রাফিক পুলিশ নিহত হয়নি ওদের গুলিতে।
১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবার দেওয়া ১০ হাজার টাকা সম্বল করে শুরু হলো নতুন এক যাত্রার, যেটা পরে বাংলাদেশে পাঠকদের ভাবনার জগৎকেই পাল্টে দেয়। জন্ম নিল ‘সেগুনবাগান প্রকাশনী’র। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে কুয়াশা-১ সিরিজের মধ্য দিয়ে বের হয় প্রথম বই। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই নাম পাল্টে নতুন নাম রেখেছিলেন ‘সেবা প্রকাশনী’।
‘অতএব ওদের পাঁচ বোনের সবচেয়ে ছোটটার জন্য বন্ধু জিয়া হায়দারের লেখা একটা গানে সুর আরোপ করে ওদের শান্তিবাগের বাসায় শেখাতে গেলাম- ‘খোকন মণি সোনা, তোর দুটো রসগোল্লা থেকে একটা আমায় দে না, একটা আমায় দে না। আমি যে তখন কোন রসগোল্লার মোহে পড়ে ওই মহল্লায় ঘুর ঘুর করি নিজেও জানি না।’