
প্রতীকী ছবি
রাত্রি শেষ প্রহর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। মোবাইলে তখন সময় রাত প্রায় সাড়ে ৩টা। ইদানীং যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ি, তারপর শেষ রাতের দিকে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় বয়স হয়েছে, এটাই শরীর জানান দিচ্ছে। এতদিনে মোবাইলে লিখতেই আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রায়ই মোবাইল নিয়ে, হাতে একটি বই নিয়ে পড়ার ঘরের বিছানায় গিয়ে বসি, কিছুটা সময় পড়ব বা রাত জেগে লিখব, এমন ভাবনা মাথায় থাকে।
কিসের লেখা!
কিসের পড়া!
দুই চোখে ভর করে আসে ঘুম।
টেরই পাই না, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, খালি গা, শরীরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে। খুব ঠান্ডার মধ্যেও প্রায়ই আমি ঘুমের ঘোরে কম্বলের নিচ থেকে কাইকুই করে বাইরে বেরিয়ে আসি। হাতের সামনে একটা কম্বল ঠিকই থাকে, এর পরও আমি খালি গায়ে শীতে যবুথবু হয়ে কুঁকড়ে থাকি, ঠকঠক করে কাঁপি, তবুও কম্বলটা কখনো নিজ হাতে খুলে গায়ে দেই না। অয়ন্তর আম্মুর অপেক্ষায় থাকি, ও এসে কখন কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে দেবে। ঘুমের ঘোরে প্রায়ই টের পাই, ঝর্ণা মশা মারছে, রক্ত চুষে গায়ে লেগে থাকা টসটসে মশা, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছে।
ঝর্ণা খেয়াল না করলে আমার গায়ে কম্বলও ওঠে না, ঠান্ডায় একেবারে কুঁকড়ে থাকি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায় ও ঠান্ডার প্রকোপ অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে শেষ রাতে এসে ঘুমটা ভেঙে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেস হয়ে বিছানায় চুপচাপ চোখ বুজে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। রাজ্যের কতশত ভাবনা মনের ভেতর উঁকি মারতে থাকে। সময় আপন গতিতে বয়ে চলে। প্রকৃতিতে শিশির ভেজা ভোরের মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ার আয়োজন চলতে থাকে। এলাকার বিভিন্ন মসজিদে মুয়াজ্জিন ফজরের আজানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হঠাৎ ডান কানের ভেতরটা কেমন পিলপিল করতে থাকে, চুলকাতে থাকে। কানের ভেতর কিছু একটা নড়াচড়া করছে এমন মনে হতে থাকে।
কান চুলকানো আমার একটা বাজে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ম্যাচের কাঠি, বউয়ের মাথার চুল আটকানোর ছোট ক্লিপ হাতের কাছেই রাখি, যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি। কানের ভেতর নড়াচড়া, চুলকানি দ্রুত বাড়তে থাকে। বেশি চুলকালে এমনটা মনে হতে থাকে যে সত্যি সত্যি কানের ভেতর কিছু একটা হাঁটছে। তবে কাঠি দিয়ে একটু চুলকালে বা ক্লিপ দিয়ে কানের ময়লা পরিষ্কার করলেই সব ঠিক হয়ে যায়।
একটা ম্যাচের শক্ত কাঠি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কানের ভেতরটা চুলকানোর পরও চুলকানি বা ভেতরের নড়াচড়া কিছুই কমছে না। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম, সত্যি সত্যি কানের ভেতর কিছু একটা নড়ছে, না এটা আমার মনের ভুল।
চোখ বুজে এসব ভাবতে লাগলাম। খুব অস্বস্তি হতে লাগল।
হঠাৎ মনে হলো একটা কিছু কানের ভেতর থেকে ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্যে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, আমি ভীষণ ভয় পেতে লাগলাম। আমার শরীর শিরশির করে ওঠে। কেমন এক স্নায়ুবিক বৈকল্য আমাকে পেয়ে বসে। আমি প্রায় দিশাহারা হয়ে পড়ি। ভয়ে ভয়ে আমি ডান পাশের কানের ওপর হাত রাখলাম। একটা প্রাণীর অস্তিত্ব আমি টের পেলাম। আমার হাতের স্পর্শে প্রাণীটার নড়াচড়া বুঝতে অসুবিধা হলো না।
আমি ভয়ে শিহরে উঠি, ঝাটকা মেরে হাত সরাতে চাই, কিন্তু হাত সরাতে পারি না। হাতটা যেন কানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। ভয়ে আমার সব শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে আসে।
আমি যেন দেখতে পাচ্ছি, একটা চ্যালাজাতীয় প্রাণী কানের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে আমার হাতের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে আসছে। চ্যালার মাথার সামনে দুটি বড় শুঁড়, শুঁড়ের অবিরাম নড়াচড়া, হাতের ত্বকের ওপর চ্যালার অনেক পায়ের অস্তিত্ব আমাকে বিমোহিত করে ফেলে।
মুহূর্তের মধ্যেই আমার শরীরের ভেতর এক অবাক করা অভিনব রূপান্তর ঘটতে থাকে।
আমার হাত, কান, মুখ, মাথা, শরীর, শরীরের বিভিন্ন অংশ এক মস্ত বড় চ্যালায় রূপান্তরিত হতে থাকে। একসময় আমার দেহ পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়ে আমি একটা ধূসর কালো রঙের চ্যালায় পরিণত হয়ে যাই। আমি বিছানায় কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকি।
দুই.
আমার আজ বিকেলের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। আমি ওয়াশ রুমে বেসিনের কলটা ছেড়ে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে টাওয়ালটা নিতে মাত্র হাত বাড়িয়েছি, অমনি ওয়াশ রুমের মেঝেতে চোখ পড়ে আমি আঁতকে উঠি। একটা মস্ত বড় ধূসর কালো রঙের চ্যালা মেঝের এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছে। এটা দেখামাত্র আমার মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি মুহূর্তে পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে পিটিয়ে ওটাকে আধমরা করে ফেলি। তারপর পা দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ওর শরীর, মাথা জোরে জোরে পিষতে থাকি। আমার পায়ের ঘষায় চ্যালাটা দুই টুকরো হয়ে কোমর থেকে দুই দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। টুকরো দুটো সমানতালে ছটফট করতে থাকে। আমি এক বন্য আনন্দে ওর মাথাটা পায়ের তলায় পিষতে থাকি।
ঠিক এমন সময় আমার মনে হয়, এই হিমশীতল ভোরে আমার বিছানার ওপর শত পা বিশিষ্ট ধূসর কালো রঙের একটা মস্ত বড় চ্যালার নিথর নির্জীব দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ওর দেহ ছিন্নভিন্ন, কোমর থেকে দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন। মাথাটা থেঁতলে বিছানার সঙ্গে লেপ্টে আছে। একটা বড় পুলিশ ভ্যানে বোঝাই অসংখ্য ছাত্রদের মৃতপ্রায় নির্জীব বিক্ষত দেহ। আমি যেন সব দেহের নিচে উপুড় হয়ে পড়ে আছি। পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট হয়ে আমার মনে হতে থাকে কোমর থেকে আমার শরীরটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একজন পুলিশ সদস্য আমার মাথা তার বুটের তলায় পিষতে থাকে। ভ্যানের পুলিশগুলো বুটের তলায় আমাদের দেহগুলো পিষতে পিষতে এক বন্য আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনের রক্তাক্ত গৌরবময় ইতিহাস আমার মস্তিষ্কে এভাবেই কিলবিল করতে থাকে। ছাত্রদের ওপর স্বৈরাচারী নির্যাতনের এ এক কালো অধ্যায় যা এখনো আমি দেখতে পাই।