
১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমির গ্রন্ত প্রদর্শনী।
বইমেলা মানেই জ্ঞানের মেলা, সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনস্থল। এটি শুধু বই কেনাবেচার স্থান নয়; সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জ্ঞানের আদান-প্রদানেরও অন্যতম মাধ্যম। বইমেলার উৎপত্তি বেশ পুরোনো। তবে সময়ের বিবর্তনে বইমেলার ধারণা এবং গুরুত্ব অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ সংরক্ষণ এবং বিতরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় মানবসমাজে। প্রাচীনকালে গ্রন্থাগারই ছিল বই আদান-প্রদানের প্রধান কেন্দ্র। মধ্যযুগে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি বিনিময় হতো, কিন্তু ছাপাখানা আবিষ্কারের পর বই প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটে।
প্রথম দিকের বইমেলাগুলো ইউরোপে অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে প্রকাশকরা নতুন প্রকাশিত বই প্রদর্শন করতেন। ১৪৫০ সালে জার্মানির মেইনজ শহরে জোহানেস গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের পর বই ছাপানোর কাজ সহজ হয় এবং বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ষোলো শ ও সতেরো শ শতকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লিপজিগ শহরে বইমেলার প্রচলন দেখা যায়। ইউরোপ ছাড়াও চীনের প্রাচীন সভ্যতায় বই আদান-প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও মেলা বসত। মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত শহর বাগদাদ ও দামেস্কেও বিভিন্ন সময় বই বিক্রির জন্য বড় আকারের সমাবেশ হতো। পরবর্তীকালে বইমেলার ধারণা ইউরোপ থেকে এশিয়া, আমেরিকা এবং অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলা ভাষায় বইমেলার সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে কলকাতায়। এ সময় কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এবং অন্যান্য সাহিত্যকেন্দ্রিক এলাকায় বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা বই প্রদর্শনের উদ্যোগ নিত। বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি)। এটি ছিল মূলত শিশু গ্রন্থমেলা, যার আয়োজন করেছিলেন কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদদীন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন তিনি।
এরপর ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এভাবেই বইমেলা চলতে থাকে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলা নিয়মিত আয়োজনের উদ্যোগ নেয় এবং ১৯৮৪ সাল থেকে এটাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে বইমেলা আরো বৃহৎ পরিসরে আয়োজন করা হতে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে বইমেলার প্রসার ঘটে এবং এতে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং এক মাসব্যাপী চলে। এ মেলা শুধু বই কেনাবেচার জন্য নয়, লেখক, প্রকাশক, পাঠক এবং সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বইমেলার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস রয়েছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা বিশ্বের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম বইমেলা, যা প্রথম শুরু হয় ১৪৫৪ সালে। এখানে বিভিন্ন ভাষার বই প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হয়। লন্ডন বইমেলা মূলত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ থাকে। নিউইয়র্ক বইমেলা প্রযুক্তিনির্ভর এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, যেখানে বাংলা ভাষার বইয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রকাশনাও স্থান পায়।
বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলার পরিধি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমদিকে বইমেলায় সাহিত্যকেন্দ্রিক বই প্রকাশিত হতো, তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যায়- গবেষণা, ইতিহাস, আত্মজীবনী, শিশুতোষ, কমিকস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বইমেলা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হচ্ছে। বিদেশি প্রকাশকরা অংশ নিচ্ছেন এবং বাংলাদেশি প্রকাশকরাও আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশ নিচ্ছেন।
পরিশেষে বলা যায়, বইমেলা আমাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ইতিহাসের ধারক ও বাহক। এটি শুধু একটি বাণিজ্যিক স্থান নয়, এটি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, যা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের একত্রিত করে। ভবিষ্যতে আরো আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে বইমেলা তার গুরুত্ব ও আবেদন বৃদ্ধি করবে।