Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বাংলা কবিতা ও বিশ্ব কবিতা

Icon

ওবায়েদ আকাশ

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৪৮

বাংলা কবিতা ও বিশ্ব কবিতা

প্রতীকী ছবি

‘ইতিহাস বেলেল্লা মিছিল ছাড়া কিছু নয়, / চুন-কালি-সঙের মুখোশ ছাড়া কিছু নয়- /শুধু / ধ্রুব / অদহন দীপ্তির উদ্ভাসে / উদাসীন, স্বাধীন, অফেন / দেবতারা এখনো আছেন।’ [বুদ্ধদেব বসুর ‘মরচে-পড়া পেরেকের গান’ কাব্যগ্রন্থ থেকে, ‘হ্যেল্ডার্লিন’ কবিতার অংশ]

এত বিধ্বংসী হাওয়া, এত যে সস্তা জনপ্রিয়তার দৌড়, এত যে ক্লান্তি, ঝগড়া, ষড়যন্ত্র- সব কিছুর বিপরীতে ‘অদহন দীপ্তির উদ্ভাসে’ স্বাধীনতা আর স্থিরতার ডানায় ভর করে এখনো সমুজ্জ্বল আমাদের মহৎ সাহিত্য আর সাহিত্যিকগণ। ধ্রুব আমাদের কবিতা। জাজ্বল্য একটা নতুন প্রকাশনার ব্যাকুলতা। ব্যাকুলতা লেখকের, তার প্রিয়তর লেখাটি সারা বছরে কিছু প্রচার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের জন্য। চাঞ্চল্য কবিতার। চাঞ্চল্য শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার, অঙ্গীকার বিশুদ্ধতার। অভীপ্সা সৌন্দর্য নির্মাণ-বিনির্মাণের। তাকে কারো সঙ্গে তুলনা করা বা বাছবিচারের দায়িত্ব সময়ের ঘাড়ে বর্তায়। আমরা যে যতই উচ্চবাচ্য করি না কেন, প্রকৃতিদত্ত বিদ্যুতোজ্জ্বল দাঁতগুলো আড়াল করে কপালের উদার জমিনে দুশ্চিন্তা কিংবা গম্ভীরতার রেখা টেনে বলি না কেন, এই হচ্ছে আমাদের অনুসরণীয় সাহিত্যের রূপচিহ্ন কিংবা এই হচ্ছে আমাদের সাহিত্যের শাশ্বত যাত্রাপথ- প্রকৃতপক্ষে এমন দাবি তুলবার অধিকার যিনি স্বেচ্ছায় সংরক্ষণ করেন, তিনিও মূলত সময়ের অংশ ছাড়া কিছু নন। কবিরা সময়ের সন্তান, সময় থেকে পাওয়া রসদ নিয়ে বিস্তৃত হয় তাদের কবিতার ভুবন। এরই ভেতর থেকে কেউ কেউ হয়ে ওঠেন চিরসময়ের অংশ। চণ্ডীদাস, কালিদাস, বঙ্কিম, মাইকেল, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দরা আমাদের চিরদিনের স্বজন। আবার আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে চিরদিনের কিংবা ক্ষণকালের সখ্য গড়ে তুলতে প্রস্তুত হচ্ছেন আগামী দিনের কবি-লেখকরা। আবার শেকসপিয়র, ইয়েটস, এলিয়ট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বোদলেয়ার, লোরকা, এলুয়ার, পাজ, হিনি, ট্রান্সট্রোমার, দারবিশ ও আদোনিস প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষার চিরকালীন আত্মীয় এখন।   

যুগে যুগে কালে কালে পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় মহৎ সাহিত্য রচিত হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক-ভূ-রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভাষাগত কারণে অসংখ্য ভাষার মহৎ সাহিত্যের আজও আমরা যেমন কিছুই জানি না; তেমনই কিছু কিছু অনুন্নত গৌণ সাহিত্য নিয়েও ঘরে-বাইরে, চায়ের টেবিলে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে মুখে ফেনা তুলে আনি। 

পৃথিবীতে বাংলা নামে একটি ভাষা আছে- এ কথা সর্ববিদিত হলেও একমাত্র ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এ ভাষায় যে অজস্র উৎকৃষ্ট কবিতা বা সাহিত্য রচিত হতে পারে; এ কথা অন্য বিশ্ব জানে না। জানে না যে কখনো কখনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটি বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস-গল্পখানি এই বাংলা ভাষায়ই রচিত হয়েছে। এমনকি জানে না মাইকেল-জীবনানন্দের মতো এত গভীর ও সর্বোপ্লাবি কবিদ্বয় এই বাংলা ভাষায়ই ধারণ করেছিলেন তাদের অসামান্য সাহিত্য ভাণ্ডার। যতটুকুও বা কখনো-সখনো বিশ্বপরিমণ্ডলে আলোচনায় উচ্চারিত হয়েছেন; তা সমুদ্রপারের ক্ষুদ্রাতি বালুকণা ছাড়া বেশি নয়। কিন্তু ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ- এজাতীয় কিছু প্রভাবশালী ভাষার প্রসারতার কারণে এসব ভাষায় রচিত কত অলেখার ভেতরও আমরা প্রকৃত লেখার স্বাদ আস্বাদন করে নিতে চাই। মনে মনে ধারণা করি, এসব ভাষায় যা-ই রচিত হচ্ছে, সবই মহার্ঘ রচনা।

বাংলায় অনেক বড় পণ্ডিত, কবি, লেখক, অনুবাদক-গবেষক থাকার ফলেও শুধু প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক দৈন্যের কারণে বাংলার সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরা যায়নি, কিন্তু তাদের ধর্মীয় মৌলবাদিতার মতো গোঁড়ামি, দুর্নীতির মতো অপসংস্কৃতিকে ঠিকই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। 

এমনকি আমাদের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সোনালি ফসলের ঘ্রাণও কেন বিশ্বপাঠককুলকে মোহিত করতে প্রসারের ব্যবস্থা করা হয়নি; ভেবে অবাক হওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। এমন স্বর্ণালি শস্য ফলেছে এই আধুনিক এবং আধুনিক-উত্তর কালেও; কিন্তু অজস্র দুর্ভেদ্য প্রাচীর পেরিয়ে, অগণিত অজুহাত তুলে কোনোভাবেই তাকে বিশ্বের সমৃদ্ধ সাহিত্য পাঠের তালিকায় তুলে ধরা যাচ্ছে না। প্রতিবন্ধক কখনো ভাষা আবার কখনো অর্থনীতি। আর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা যে আমাদের সীমাবদ্ধ মানসিকতা কিংবা সদিচ্ছার তাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায়।

আমাদের সমসাময়িক বাংলা কবিতা ওই একই তিমিরে হাবুডুবু খেলেও আমরা কিন্তু বিশ্ব কবিতার রসাস্বাদন থেকে পিছিয়ে নেই। বাঙালি পাঠক এ ব্যাপারে কখনোই পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘দেবে আর নেবে, মিলিবে মিলাবে’ এই উক্তি আর কোনো দিন সত্যে প্রমাণিত হয়নি। শুধু দিয়ে গেছি, আর দিয়েই যাচ্ছি, নিতে পারছি না কিছুই। আমরা প্রভাবশালী ভাষার সাহিত্য পাঠ করে আপ্লুত হচ্ছি; তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তারই অনুসরণ-অনুকরণে বাংলায় সাহিত্য রচনা করছি। কিন্তু আমাদের সাহিত্যও যে তাদের পাঠের প্রয়োজন থাকতে পারে, আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-দেশ-মানুষকে তাদের ভেতরেও উপস্থাপন জরুরি- বাঙালি মানসে তা আজও যেন উপলব্ধিতে এলো না। সক্ষমতা এলো না আমাদের সাহিত্যকে তাদের ভাষায় অনুবাদ করে তাদের পাঠতালিকায় তুলে ধরার। কিন্তু প্রয়োজনে আমরা ঠিকই তাদের সাহিত্যকে অনুবাদ করে নিজের পাণ্ডিত্যকে জানান দেওয়ার জন্য তুলে দিচ্ছি বাংলা ভাষার পাঠককুলে। বিদেশি কবিতা পাঠের জন্য আমাদের কসরতের অন্ত নেই। যেহেতু সে সহজলভ্য একটি পথে উঠে এসেছে দু-তিনটি সহজলভ্য ভাষার মাধ্যমে। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাঙালি হয়ে জন্ম নেওয়াটা যেমন আমাদের এক ধরনের অপরাধ, তার চেয়েও বড় অপরাধ বাংলায় কবিতা রচনা? কারণ বাংলা কবিতা আজও পর্যন্ত পৃথিবীর মুখ দেখেনি। কোনো দিন দেখবে হয়তো; সেই আশাতেই আজও বাঙালির ঘরে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য কবি-লেখক-সাহিত্যিক। কিংবা কোনো দিন দেখবেই না- জন্ম নিচ্ছে সেই অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই। শুধু ভাবতে ভালো লাগে যে আমাদের কবিতাও বিশ্ব কবিতার অংশ। কিন্তু আমাদের কবিতা অন্য বিশ্বের পাঠকের পাঠ্য কি না সে প্রশ্নের উত্তর আজও ধোঁয়ায় মোড়ানো অন্ধকার। 

প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য নয়, আমরা সারা বিশ্বের কবি-লেখক-শিল্পী সবাই একই বিশ্বের, একই গ্রামের বাসিন্দা। আমাদের মধ্যে দেশ-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-ধনী-দরিদ্র যেন কোনো প্রাচীর বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে না পারে, সে লক্ষ্য নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। মানি আর না মানি তবু বিনিময় হবে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি কিংবা ভাবনারও। আর গ্রহণ করব যেটা উত্তম সেটাই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫