Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সমরেশ বসু: যার সাহিত্য ও জীবন ছিল একসূত্রে গাঁথা

Icon

এস ডি সুব্রত

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০৪

সমরেশ বসু: যার সাহিত্য ও জীবন ছিল একসূত্রে গাঁথা

সমরেশ বসু। ছবি: সংগৃহীত

অনিবার্য ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে নিজেকেই নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছিলেন একজন লেখক, যিনি সাহিত্যকে জীবন থেকে আলাদা করেননি,  তিনি সমরেশ বসু। সমরেশ বসু ছিলেন একজন প্রখ্যাত ও জীবনধর্মী বাঙালি লেখক। আসল নাম সুরথনাথ বসু। কিন্তু সমরেশ বসু নামেই লেখক পরিচিতি সমধিক। তিনি কালকূট ও ভ্রমর ছদ্মনামে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার বিক্রমপুরে জন্ম। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে ভারতের কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বাবার নাম মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবলিনী বসু। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। যেমন- একসময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন তিনি। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইছাপুর বন্দুক কারখানায় চাকরি করেছেন সমরেশ বসু। এই সময়পর্বের মধ্যেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

সমরেশ বসু শুধু কল্পনাবিলাস আর খালি হাতে সাহিত্যচর্চা করতে আসেননি। জীবনে ও যাপনে তার সাহস তো ছিলই, তার সঙ্গেই ছিল প্রবল কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য এবং বহন করারক্ষক্ষমতা। লেখক হওয়ার জন্য আর যা কিছু বোধ, উপলব্ধির সঙ্গেই উল্লিখিত গুণ, তাকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিল প্রথম থেকে। অনেক রচনাকারের ক্ষেত্রেই তাদের মফস্বলি অথবা শহুরে অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপনের সুখী কিংবা ম্লান পৌনঃপুনিকতায় যে একঘেয়েমির সুর ধ্বনিত হয় লেখায়, সমরেশ বসু সেখানে মূর্তিমান ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন এবং তার জন্য শুধু নিন্দা বা প্রশংসা নয়, লেখক জীবনে খেসারতও কম দিতে হয়নি তাকে। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া, ভাঙা ও ভাঙতে ভাঙতেই তার সাহিত্যসৃষ্টির কারিগর হয়ে উঠে আসা। ভাষায়, অনুভবের গভীরতায়, প্রকাশভঙ্গি ও বিষয়বৈচিত্র্যে চল্লিশের দশকের এই লেখকের বিষয়ে ভাবতে বসলে মনে হয়, কেবল তার সাহিত্যসম্ভার বা সৃষ্টিধারা নয়, তার যাপিত জীবন, জীবনবোধ, অভিজ্ঞতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধ-বিশ্বাস, বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আমাদের অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি। চার দশকের সামান্য বেশি নিরবচ্ছিন্ন রচনাপ্রবাহের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বিশেষত উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রায় দশকে-দশকে তিনি দিক বদল করেছেন। আবার নিজস্ব সৃষ্টির শ্রোতধারার মধ্যেই অন্য আবর্ত সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু একই জায়গায় থেমে থাকেননি। তার প্রথম জীবনের কয়েকটি রচনায়ই গঙ্গার উভয় পারের মানুষের কূল ভাঙার ইতিহাস আর মাটির মানুষের কলের মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছিল। একই সঙ্গে শ্রমজীবী ও নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে উঠেই বাংলা সাহিত্যের আসরে আসন পেতে দিয়েছিলেন।

তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলি : উত্তরঙ্গ, গঙ্গা, প্রজাপতি, দেখি নাই ফিরে, সওদাগর, কোথায় পাবো তারে, নয়নপুরের মাটি, বাঘিনী, চলো মন রূপনগরে, পাতক, মুক্তবেণীর উজানে, টানাপোড়েন, স্বীকারোক্তি, অপদার্থ, শাম্ব, তিন পুরুষ, দাহ, নাটের গুরু, নিঠুর দরদী, পথিক ও প্রাণ প্রতিমা। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার ও আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ মারা যান তিনি। মৃত্যুকালেও তার লেখার টেবিলে ছিল ১০ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস দেখি নাই ফিরে। 

সমরেশ বসুকে প্রতিনিয়ত  উৎকণ্ঠিত করে তুলত ব্যক্তির বিপন্নতা। নিজের জীবনের সংকটের মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করতেন সেই বিপন্নতা। সৃষ্টিকর্মের আবহে-আবেগে-বিতর্কে প্রাণবন্ত করে রাখা বাংলা সাহিত্যের জগতে কম কথা নয়। খুব কৃতী লেখক হলেই তা হয় না, তার জন্য গভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। এমন একজন লেখক হতে হয় যিনি নিজের লেখা দিয়েই পাঠকের প্রত্যাশা সমানে নতুনভাবে তৈরি করে নিতে পারেন। সমরেশ বসু সেটা করতে পেরেছিলেন নিজের যোগ্যতায়, কলমের শক্তি আর বোধের গভীরতায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫