
প্রতীকী ছবি
পথ ফুরায় না। হেঁটে হেঁটে অনেকদূর এগিয়েও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না বলে পথ আরো দীর্ঘ মনে হয়। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি আলিমনকে ভেঙেচুরে মাটিতে ফেলে দেয়। মাটি থেকে টেনে তুলতে কোনো হাত এগিয়ে আসে না, একটা ধারালো কণ্ঠ আঘাত করে শুধু, ‘এহনই হাল ছাইড়া দিলি! মেলা দূর যাওন বাকি।’ তা কী আর জানে না আলিমন! জানে বলেই মাটি খামচে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। পারে কী পারে না তা দেখার সময় ধারালো কণ্ঠধারী মানুষটার থাকে না, সে এগিয়ে যেতে যেতে চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে যায় আলিমনের। গুলিমনেরও ঘুম ভাঙে।
ওই দিন ঘুম ভেঙে উঠে মায়ের ডাক উপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল গুলিমন। সিঁথিটানা চুলের সারি করে রঙিন ক্লিপ পরেছিল। কমলা ফ্রক আর হলুদ হাফপ্যান্ট পরে গুলির মতো ছুটে গিয়েছিল মাঠে। মাঠে গিয়ে একেবারে বোকা বনে গিয়েছিল মেয়েটা, আসবে বলেও সময়মতো খেলতে আসেনি ভানু, টিকলি আর আতু। শুধু ভোদল কাকা সাঁতার কাটা বন্ধ করে ভোঁদড়ের মতো পায়ের আঙুল ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাকার নাকের ডগার কাঁটা কাঁটা গোঁফ দেখে প্রথমে ভয়ই পাচ্ছিল গুলিমন। কাকা আশ্বস্ত করেছিল, ভয় নেই। ওর সঙ্গে কাকাই খেলবে। শুনে একেবারে লাফিয়ে উঠে মাটিতে গোল্লা আঁকতে ছুটেছিল গুলিমন। তখনই কাকা পেছন থেকে এসে কোলে তুলে বলেছিল, ‘চল তোরে বিন্নাগড়ের রাজার বাড়ি দেহাই।’ গুলিমনের কত্তদিনের শখ ও বিন্নাগড়ের রাজার বাড়ি দেখবে! কিন্তু শখ পূরণের উপায় কী! রাজার বাড়িতে লম্বা লম্বা নখওয়ালা অতিকায় সব দত্যিদানো থাকে, গুলিমন জানে। মা যা বলে সব মিছে নয়। তাই তো ভানু আর টিকলি শত লোভ দেখালেও গুলিমন ওই পথে যায়নি। কিন্তু ভোদল কাকার যেই শরীর! ইয়া লম্বা গাট্টাগোট্টা, ভূত তাড়িয়ে দিবে লহমায়...তাই কাকার কোল থেকে নামেনি গুলিমন। একেবারে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে যেভাবে রাজারকুমার রাজকন্যাকে নিয়ে যায় সেভাবেই কাকার কাঁধে চেপে বসেছে। আর কাকা সাঁই করে উড়ে চলে গেছে রাজার বাড়ি।
দিন ফুরিয়ে রাত নামলেও মা খুঁজে পায়নি দস্যি মেয়েকে। রাজার বাড়ির কোন সে এক গুপ্ত ঘরে মেয়ে লুকিয়েছিল।
গুলিমন এখনো স্বপ্নে স্বপ্নে বিন্নাগড় যায়। রাজার বাড়ির অন্দরমহল, আয়নাঘর, রাণী সাগরের তেতলা ঘাট দেখতে দেখতে এখনো ঘুমের ভেতরে গোঙায়, কাঁদে। দুই পা ভাঁজ করে ব্যাঙসদৃশ শুয়ে থেকে তিরতিরিয়ে কাঁপে। বিছানাও ভেজায়। মেয়ের শরীরের বর্জ্য বহনকারী তরলের উৎকট গন্ধ অভ্যস্ত আলিমনকে যারপরনাই কাতর করে, সে হাত বাড়িয়ে মেয়ের কোমরের নিচের কাঁথা পাল্টে দেয়। মাথার কাছে রাখা বাসনা পাউডারের ডিব্বা নিয়ে মেয়ের ঘাড়ে, গালে বাসনা ছড়ায়। পরের কাঁথাটাও ভিজে যায় দ্রুত। অয়েলক্লথ থাকায় তোশকটা অক্ষত থাকে। তবিক্ষত হয় শুধু গুলিমনের মা আলিমন, তোলপাড় করা কণ্ঠ জাগিয়ে কাঁদে, ‘ও আল্লাহ, এই মাইয়াকে পার করমু কী কইরা!’
আট বছর ধরে অবিকল একই সুরে কাঁদছে সে। একটা সময় অবশ্য ছিল তার কান্না ঘিরে অসংখ্য শ্রোতা ছিল। এমনকি স্থানীয় মন্ত্রী, এমপি, ডিসি, এসপি পর্যন্ত হাসপাতালে এসে আলিমনের কান্না শুনে গেছে। ফিরে যাওয়ার আগে মেয়ের চিকিৎসাবাবদ কিছু টাকাও গুঁজে দিয়ে গেছে হাতে। থরথর হাতের মুঠোতে টাকা খামচে ধরে জ¦রতপ্ত মেয়ের থরকাঁপুনি দেখেছে আলিমন। ওই সময়ে শুনেছিল গুলিমনকে নিয়ে পুরো দেশের মানুষ কথা বলেছে। রাস্তায় নেমে মিছিলও করেছে অগুনতি মানুষ। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। সহস্র কবিতা, গল্প, গানও লেখা হয়েছে গুলিমনকে নিয়ে। গুলিমন কিছুই দেখেনি, কিছুই পড়েনি এসবের। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মা মা করে কেঁদেছে। মেয়ের কান্নার নহরে অবগাহন করতে করতে আলিমন ওর যন্ত্রণা, কষ্ট সব শুষে নিতে চেয়েছে। পারেনি। আজও ব্যর্থ সে।
ব্যর্থতার গ্লাানিতে আপাদমস্তক ডোবা মানুষটা একদিন খবর পায়, আট বছর আগে বিন্নাগড়ের রাজার বাড়িতে গুলিমনের যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে চিরে নিজের শিশ্ন ঢুকিয়েছিল যে তাকে জামিনদারের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। এই তো মোক্ষম সুযোগ, তাই পুনরায় সচেতন নাগরিকরা তাদের বায়বীয় শরীর নিয়ে গুলিমনের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। ওকে নিয়ে গল্প, কবিতা, গান, দেওয়াল লিখন লিখতে শুরু করেছে সংবেদনশীল কলম। এবারও গুলিমন সেসবের কিছুই পড়তে পারছে না। ও এক অর্ধগলিত শরীর নিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। গুলিমন অবশ্য এখন একাই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে। আগের মতো সিঁথিটানা চুলে সুগন্ধি তেল দিয়ে খোলা উঠানে এসে দাঁড়াতেও পারে। কিন্তু পৃথিবীর সব সুধা, সব সুগন্ধি দিয়েও নিজের আখাস্তা নিন্মঞ্চলের দুর্গন্ধ ঠেকাতে পারে না।
বাপ মরা মেয়ের দুরবস্থা দেখে দেখে আলিমন আবার হাঁটতে শুরু করে, কার কাছে যায়, কী ফয়সালা পায় দিশা পায় না কোনো। খালি হাঁটে আর হাঁটে আর পথে পথে ঠোক্কর খায়। চলতি পথে তার এক জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এক বিঘত লম্বা চওড়া যন্ত্র টিপতে টিপতে সেই জ্ঞানী মানুষ জানায়, ঘটনার সময় যদি গুলিমনের মৃত্যু হতো তবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের বদলে ফাঁসির দণ্ড হতো ভোদলের। আফসোস! বিনবিনে পোকার বিস্তার ঘটে গুলিমনের নিন্মাঙ্গে পচন ধরলেও তখন ওর জান আজরাইল কবজ করতে আসেনি।
জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে আলিমনেরই এখন মরবার দশা। চৈত্রের দংশনের তাড়ায় সে পুনরায় হাঁটে আর হাঁটে।
তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যেতে চায়। তার শেষ বাসনায় যুক্ত হয় এক কলস বরফশীতল পানি। খরতাপ বিলানো আসমান শত্রুর মতো মাথার ওপরে জাঁকিয়ে বসে। তৃষ্ণা বাড়ে...তৃষ্ণা বাড়ে। শুষ্ক জিহ্বা দিয়ে দুই ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টারত আলিমন আঁতকা দেখতে পায়, স্তব্ধ আসমানে মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে একটা ক্লান্ত শকুন উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আলিমনের ধূসর চোখ জ্বালা করে। মেয়েটাকে বুকে ধরে শুয়ে থাকতে মন চায়। মেয়েরও মন চায় মায়ের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে আমৃত্যু ঘুমায়।
ঘুমে ঘুমে বিন্নাগড়ের রাজার বাড়িতে প্রবেশ করে গুলিমন। রাজার বাড়ির শোভা ওকে ফের বিভোর করে। ঢলোঢলো চোখে তাকিয়ে দেখে রাজকীয় ভঙ্গিতে বাড়ির প্রবেশদ্বারে পঙ্খীরাজ ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। এই বুঝি বা রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হলো, গুলিমন মরমে মরে।
ওদিকে ঘুমের ফয়সালা করতে বাড়ি না ফিরে মাইলখানেক দূরে মনোহরি দোকানে যায় আলিমন। আঁচলের গিঁট খুলে নগদ টাকা দিয়ে দুই শিশি ইঁদুর মারা বিষ কিনে যখন সে হাঁটতে শুরু করে তখন আর তার আসমানের দিকে নজর দেওয়ার সময় থাকে না। অথচ ঘাড় উঁচু করে একটিবার শূন্যে তাকালেই সে দেখতে পেত সতর্ক দৃষ্টি মেলেও শকুনের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা যাচ্ছে না।
মায়ের অপেক্ষায় থেকে থেকে গুলিমন অস্থির হয়ে উঠছে। মা আসছে না, মিহি সুরে ডাকছে না, বাসনা পাউডারের ছোঁয়া দিচ্ছে না শরীরে। কাঁহাতক আর অপেক্ষায় থাকা যায়! অবেলায় ঘুমিয়েই যায় গুলিমন। ঘুমভাঙা গুলিমন চোখ মেলে দেখতে চায় পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে কোনো রাজকুমার এসেছে। কিন্তু এ কী! এ তো রাজার কুমার না! তার বদলে একটা চেনা পুরুষদেহ দ্রুতগতিতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। এ যেন বিন্নাগড়ের রাজা! রাজা যত দর্পভরে ভারি ভারি পা ফেলছে পথ তত ছোট হয়ে আসছে। ছুটে পালাতে পারছে না গুলিমন, চিৎকারও করতে পারছে না, ওর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে শুধু নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দুর্গন্ধযুক্ত তরল গড়িয়ে পড়ছে।