
প্রতীকী ছবি
যে জীবন মানুষ যাপন করে সেই জীবন মানুষ যাপন করতে চায় না। মানুষ চায় তার আকাঙ্ক্ষার জগতের জীবনকে যাপন করতে। এই দ্বন্দ্বে পড়েই মেসমার মানুষ, সংসার ও হৃদয়ঘটিত জীবন। বলা চলে, মানুষ আজ ক্লান্ত আর বিষণ্ণ। মানুষ আজ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ একা। এই যদি হয় মানুষের যাত্রাপথ, তাহলে মানুষ বেঁচে থাকে কেন? যাপিতজীবনে মানুষ আসলে বেঁচে থাকে না। মানুষ বেঁচে থাকে তার আকাঙ্ক্ষার জগতে। এই আকাঙ্ক্ষার জগৎ মানুষের সৌন্দর্যবোধ দিয়ে তৈরি। সুন্দরের প্রতি তৃষ্ণা আছে বলেই মানুষ শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। নানাজন নানাভাবে এ তৃষ্ণা মেটায়। কেউ প্রেমিকার ঠোঁটে থরোথরো গোলাপের পাপড়ি দেখে। কেউ কবিতা লেখে। কেউ তা পড়ে। কেউ ছবি আঁকে। এর সবই শিল্প। কুৎসিত জীবনকে সুন্দর করে রাঙিয়ে তোলার চমৎকার এক মাধ্যম।
যেকোনো সাধারণ মানুষ নাভিশ্বাস তুলে ছুটছে জীবিকার প্রয়োজনে। এ জন্য হেন কোনো অসৎ উপায় নেই যা সে গ্রহণ করছে না। অথচ সে জানে, সে যা করছে তা কুৎসিত। যে জীবন সে যাপন করছে, তাও কুৎসিত। এই মানুষটিই যখন সংসারে ফিরে আসে, তার ভালো লাগে। স্ত্রী ও সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে কুৎসিত জীবন তার কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে। এটাই শিল্পের প্রক্রিয়া। যাপিতজীবনের যন্ত্রণাময় বলয় থেকে কিছু সময়ের জন্যে বের হয়ে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফ্যালে, সেই জায়গাটির নাম শিল্প।
সেই আদিম সময় থেকে মানুষ এভাবেই কুৎসিত জীবনকে শৈল্পিক জীবনে উত্তরণ ঘটানোর কৌশল শিখে এসেছে। যে যত নিখুঁত ও সুন্দর উপায়ে এই কৌশল আয়ত্ত করেছে, সে তত মহৎ শিল্পী। জগতে অসংখ্য মহৎ শিল্পীর নাম আমরা জানি। জগতের সুখ-আনন্দ তাদের খুব একটা প্রলোভিত করতে পারেনি। কেননা শিল্প সৃষ্টির আনন্দের কাছে পার্থিব ভোগের আনন্দ তাদের কাছে খুবই তুচ্ছ ছিল। অবশ্যি সে একটা সময় গেছে পৃথিবীর, যখন পৃথিবীর যৌবন ছিল। এখন পৃথিবীর বয়েস বেড়ে গেছে। প্রৌঢ়ত্বে পৃথিবী এখন ন্যুব্জ। মানুষ এখন শিল্প সৃষ্টি করে কুৎসিত জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে নয়, পার্থিব জীবনের খুবই তুচ্ছ সুযোগ-সুবিধে পেতে। আজকের বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের বেলায় এই সত্য দিনের আলোর মতো প্রকাশিত। পুঁজিপতিদের পায়ের ছায়ায় বসে পুঁজির দালাল হয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। দিনশেষে ঘরে যখন ফিরছেন তখন শিল্প বের হচ্ছে পশ্চাৎদেশ দিয়ে। রাষ্ট্রের আনুকূল্য নিয়ে কোনো কোনো কবি বেঁচে আছেন মাছে-ভাতে। ফলে শিল্প তাদের জীবনে কোনো ছাপ রাখতে পারছে না। কুৎসিত যে জীবনকে সুন্দর করে তুলতে শিল্পের সাধনা, এসব কবির জীবনে তা আর হয়ে ওঠে না। তাদের জীবন কুৎসিতই থেকে যায়। সারা জীবন ভাতে মরা নির্জনতম কবি জীবনানন্দ দাশ এ কারণেই হয়তো বলেছিলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।
শিল্প মানে হচ্ছে নির্মাণের বা রচনার কলাকৌশল ও নৈপুণ্য। কলাকৌশল ও নৈপুণ্যের সঙ্গে যা নির্মাণ করা হয় তা-ই শিল্প। মানুষ যা-কিছুই তৈরি করুক না কেন, তৈরীকৃত সৃষ্টিকর্ম যত নিখুঁত ও গোছানো হবে সেই সৃষ্টিকর্ম তত বেশি শৈল্পিক। নানা মাধ্যমে মানুষ চিন্তা ও কল্পনার যে প্রকাশ ঘটায়, তার সবই আসলে শিল্প। যেমনÑছবি আঁকা ও কবিতা লেখা। আভিধানিক সংজ্ঞা ছাড়িয়ে শিল্পের মানে কিন্তু আরো বিস্তৃত। সেই বিবেচনা থেকে মানুষ যখন কথা বলে সেই কথাও শিল্প। যে যত বেশি সুন্দর উচ্চারণে গুছিয়ে কথা বলতে পারে তার কথার প্রভাব শ্রোতার ওপর বেশি আছর করে। তরকারি রান্নায় সব উপাদান ঠিকঠাকমতো না-দিলে তরকারি খেতে স্বাদ হয় না। খাদ্যে স্বাদ পেতে হলে খাদ্য প্রস্তুত করতে নৈপুণ্য প্রয়োগ করতে হয়। দেখা যাচ্ছে, শিল্পের সঙ্গে সৌন্দর্যের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। যা পরিপাটি, সুশৃঙ্খল ও গোছানো, তার সবই শিল্প, যা বিশৃঙ্খল ও অসুন্দর তা শিল্প হয়ে ওঠে না। কারণ শিল্প হচ্ছে নিরন্তর সৌন্দর্য। আর তাই কবিতাকে শিল্প হয়ে ওঠার জন্য কিছু অলঙ্কার দিয়ে নিজের শরীরকে সাজাতে হয়। এসব অলঙ্কার কবিতাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার পাশাপাশি নিখুঁত অবয়বে রূপদান করে। ধরা যাক, চিত্রশিল্পী তার অন্তর্জগতে প্রতিভাত একটি দৃশ্য আঁকছেন। রঙের বিন্যাস যদি নিখুঁত না-হয় তাহলে দৃশ্যটিও নিখুঁত হবে না। কোন অংশে কী রং, কতটুকু রং লাগাতে হবে, সেই নৈপুণ্য তার ভেতর না-থাকলে ছবিটি সুন্দর হয়ে উঠবে না। আর তার সৃষ্টিকর্ম সুন্দর না হলে শিল্পমণ্ডিত হবে না। কবিতার বেলাতেও একই কথা। তবে তফাৎ এই যে, ছবি আঁকতে কেবল ক্যানভাস ও রং হলেই চলে। কিন্তু কবিতা লিখতে গেলে দরকার কবিতার অলঙ্কার। ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ভাষাশৈলী- এসব হচ্ছে কবিতার অলংকার। সবার ওপরে কবির কল্পচিত্র তো রয়েছেই। মহাজাগতিক বোধ যেকোনো কবির বড় সম্পদ। জীবন ও জগৎকে পর্যবেক্ষণ খুব সূক্ষ্মভাবে করতে না পারলে কবির কবিতা হয়ে ওঠে মোমবাতির আলোর মতো। পাঠকের অন্তর্জগতের খুবই অল্প একটু জায়গাই ওই কবিতা দ্বারা আলোকিত হয়। কিন্তু আমরা জানি, মানুষের বোধের জগতের বিস্তৃতি মহাবিশ্বের মতো। অন্তর্বোধের কত যে বিচিত্র রং প্রতিমুহূর্তে রাঙিয়ে যাচ্ছে মানুষের হৃদ-আয়নায়, সেসব চিত্র-বৈচিত্র্য দেখার অন্তর্চোখ সাধারণ মানুষের নেই। আছে প্রকৃতির কবির। প্রকৃত কবির কবিতার কলকব্জা এ কারণেই ভেঙে-ভেঙে আত্মস্থ করার দরকার আছে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে উন্মোচিত হয় জীবনের প্রতিরূপ কবিতার সৌন্দর্য-রহস্য। রহস্য এ জন্য যে, কবিতার ভাব ও বিষয় মহাশূন্যের মতোই অন্তহীন। অনন্তের সেই ইশারা কিছুটা আভাসে, কিছুটা সৌন্দর্যের রঙে রাঙিয়ে আমাদের ভেতর অনুভূতির শৈল্পিক চিত্র তৈরি করে দ্যায়। আর পাঠক হিসেবে আমরা তাড়িত হই জীবন-উপলব্ধির গভীর ও সূক্ষ্ম অনুভূতি দ্বারা। এ ক্ষেত্রে ভাষার চিত্ররূপই শৈল্পিক-ব্যঞ্জনায় সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে।