রুশ সাহিত্যের নীলকণ্ঠ লেখক
ম্যাক্সিম গোর্কি: এক নীলকণ্ঠ লেখক

শিল্পী নাজনীন
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৭

ম্যাক্সিম গোর্কি। ছবি: সংগৃহীত
রুশ সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির জন্ম ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ার নিজনি নোভগরোদ শহরে। বাবা জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করতেন এবং আস্তাখানে বসবাস করতেন। সেখানেই শৈশব কাটে গোর্কির।
গোর্কির বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন থেকেই গোর্কির জীবনে চরম অন্ধকার ও অনিশ্চয়তা নেমে আসে। তার নানার ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তিনি গোর্কির দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় গোর্কির স্কুল গমন, সেই বয়সেই রোজগারের ধান্দায় পথে নামতে হয় গোর্কিকে। প্রথম জীবনের এই বিপর্যস্ততা গোর্কিকে তার সময় ও পরিবেশের প্রতি করে তুলেছিল দারুণ ক্ষুব্ধ, হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ। সে কারণেই পরবর্তীকালে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় তিনি ‘গোর্কি’ নামটিকে বেছে নেন ছদ্মনাম হিসেবে। যার অর্থ হলো তপ্ত, ক্ষুব্ধ বা তেতো। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো এতটাই তিক্ত ছিল যে, গোর্কি সেই তিক্ততাকে নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। জীবনের সবটুকু গরল প্রতি চুমুকে পান করে অবশেষে হয়ে উঠেছিলেন রুশ সাহিত্যের ভীষণ জনপ্রিয় এক নীলকণ্ঠ লেখক।
গোর্কি তার পরবর্তী জীবনের সাহিত্য সাধনায় সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযুদ্ধ তথা সর্বহারাদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা আর জীবনযন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন নিবিড় মমতায়। রুশ বিপ্লব গোর্কিকেও স্পর্শ করে ভীষণভাবে। রুশ বিপ্লবের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি দ্বারা গোর্কি দারুণভাবে প্রাণিত হন এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন সংকটে লেখকদেরও যে সংকট উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখতে হয়, সেটা তিনি দেখেছিলেন তলস্তয়, আন্তন চেখভসহ অন্যান্য লেখকদের মধ্যে। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত গোর্কি শ্রমিক জীবনের পাশাপাশি কলম তুলে নেন হাতে, মন থেকে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াবার সংকল্পে দৃঢ় হন। আলেক্সেই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ম্যাক্সিম গোর্কি। ভলগা নদীতীরের মফস্বল শহরের কাগজে ছাপা হতে থাকা তার লেখাগুলো অল্পদিনের মধ্যেই রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত লেখকসহ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়।
এরপর থেকে অবিশ্রামভাবে লিখতে থাকেন গল্প, উপন্যাস, নাটক। ১৮৯৮ সালে তার প্রথম গল্প সংগ্রহ এবং ১৮৯৯ সালে উপন্যাস ‘ফোমা গার্দেয়েভ’ প্রকাশিত হলে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালে সরাসরি রুশ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন গোর্কি। তার অল্প কিছুদিন পরই লন্ডনে প্রথমবারের মদো তার সঙ্গে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সাক্ষাৎ হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। জীবনের বিভিন্ন সময়ে যেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন গোর্কি, যেসব বিচিত্র কাজ তাকে করতে হয়েছিল ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তার ফলে বহুবিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছিল, বহু
শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তিনি পেয়েছিলেন জীবনে। এসব অভিজ্ঞতাই তিনি তার অসংখ্য লেখায়, গল্প, উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা আর আত্মজীবনীতে তুলে এনেছেন নিপুণ শিল্পীর দক্ষতায়। ১৯০৭ সালে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘মাদার’ প্রকাশিত হয়, যা রাশিয়ায় ৫৪টি ভাষায় এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ৪৪টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য অসংখ্য রচনার মধ্যে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘পৃথিবীর পথে’ এবং ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’ বিশ্বনন্দিত, বাকিগুলোও তুমুল জনপ্রিয়। পরে ১৯৩৬ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান নোবেল সাহিত্যের জন্য পাঁচবার মনোনীত হওয়া এই বিশ^বিখ্যাত লেখক।