
সোনার কেল্লা শুটিংয়ের আগে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে মেকআপ টেস্ট। সৌমিত্র (ফেলুদা) চট্ট্যোপাধ্যায়ের পরচুলা ঠিক করে দিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।
সাতাশ বছরের এক চির তরুণ, উচ্চতা ছয় ফুট দুই ইঞ্চি, ঠোঁটে চারমিনার। মার্শাল আর্টে দক্ষ, পয়েন্ট ৩২ কোল্ট রিভলবার ভয়ানক সব অপরাধীর সঙ্গে লড়াইয়ে বাড়তি সুবিধা দেয়, তবে তার মূল অস্ত্র ধারালো মগজ। দুর্দান্ত পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ব্যবহার করে জটিল সব রহস্য সমাধান করেন অবলীলায়।
শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন গল্পটা প্রিয় ফেলুদা বা প্রদোষচন্দ্র মিত্রের।
তো হঠাৎ ফেলুদার গল্প কেন? ফেলুদাকে নিয়ে লিখতে, বলতে সময় লাগে নাকি? তবে এবার সত্যি একটি উপলক্ষ আছে। ২৩ এপ্রিল ছিল ফেলুদার জনক প্রিয় সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের এই দিনে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি। তাই সত্যজিৎকে স্মরণ করতে গিয়ে ফেলুদাকেই স্মরণ করছি।
১. ফেলুদা চরিত্রটির জন্ম অনেকটা হঠাৎ করেই হয়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের একটি লাল খেরো খাতা ছিল। ওখানে নিজের গল্পগুলোর খসড়া লিখতেন। খসড়া লেখার জন্য আরো বেশ কয়েকটি খাতাও ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! ১৯৬৫ সালের আগে কোথাও ফেলুদা চরিত্রটি সম্পর্কে কিছুই ছিল না। ১৯৬৫ সালে লাল খেরো খাতার তৃতীয় পাতায় হঠাৎ করেই এই গোয়েন্দার দেখা মেলে। আর দার্জিলিংয়ের পটভূমিতে লেখা ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ ফেলুদার প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি। সন্দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় ডিসেম্বর ১৯৬৫ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ তক। তবে ফেলুদার প্রথম উপন্যাস বাদশাহী আংটি, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই আকারে যেটি বের হয় ১৯৬৯-এ।
২. ১৯৯২ সালে সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত প্রবল জনপ্রিয় এই গোয়েন্দাকে নিয়ে লেখেন ৩৫টি সম্পূর্ণ গল্প-উপন্যাস। এ ছাড়া শেষ হয়নি এমন কয়েকটি পাণ্ডুলিপিও ছিল। কিন্তু ফেলুদাকে নিয়ে হিন্দিসহ ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় সিনেমা-টেলিফিল্ম হয়নি বললেই চলে। এর কারণটা কী?
সত্যজিৎ রায়ের ছেলে এবং চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায় এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ফেলুদা ট্রান্সলেট (অন্য ভাষায়) করা খুব কঠিন। এই গল্পে যে বাঙালিয়ানা আছে সেটাকে অন্যভাষায় অনুবাদ করা যায় না।’
৩. প্রতিটি শুরুরই কোনো না কোনো অনুপ্রেরণা থাকে। ফেলুদার জন্মটা যে শার্লক হোমসে অনুপ্রাণিত, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। সত্যজিৎ ফেলুদার গুরু হিসেবে বারবারই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন হোমসকে। এমনকি ফেলুদাকে ঘুরিয়ে এনেছেন তার গুরু হোমসের বেকার স্ট্রিট থেকেও। শুধু তাই নয়, সত্যজিৎ রায় ফেলুদার আস্তানা হিসেবে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের আদলেই হয়তো দেখিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার ২১ রজনী সেন রোডকে। মজার ঘটনা, ২২১ বি নামে বাড়ির কোনো অস্তিত্ব যেমন নেই, তেমনি রজনী সেন রোড থাকলেও ২১ নম্বর বাড়ির খোঁজ মেলেনি সেখানে।
৪. প্রদোষচন্দ্র মিত্র একা নয়। আরো কত যে চরিত্র মিলে আশ্চর্য ও এক আকর্ষণীয় রূপ প্রাপ্তি। তোপসে, অর্থাৎ তপেশরঞ্জন মিত্রর কথা বলতে হবে সবার আগে। একেবারে শুরু থেকেই যে প্রিয় গোয়েন্দার সঙ্গে আছে তার খুড়তুতো ভাইটি। তার জবানিতেই ফেলুদার কাহিনিগুলো জানতে পারি। সোনার কেল্লায় ওই যে লালমোহন গাঙ্গুলির সঙ্গে পরিচয় হলো, তার পর থেকে ফেলুদার প্রতিটি বইয়ের আশ্চর্য এক চাটনি হয়ে উঠলেন রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যিক জটায়ু। টানটান উত্তেজনায় ভরা রহস্য কাহিনিগুলোতে জটায়ুর অদ্ভুত, হাস্যরসাত্মক কাণ্ডকীর্তি যেন আনন্দময় রিলিফ। ফেলুদা পড়তে পড়তে আরো কত চরিত্র যে আপন হয়ে গেল আমার! দুর্ধর্ষ মগনলাল মেঘরাজ, জীবন্ত জ্ঞানকোষ সিধু জ্যাঠা, ছিন্নমস্তার অভিশাপের দুর্ধর্ষ কারাণ্ডিকার, ধাঁধাপাগল মহেশ চৌধুরী, বাদশাহী আংটির বনবিহারী বাবু, সোনার কেল্লার মুকুলসহ কত কত চরিত্র লিখতে বসে চোখের সামনে চলে আসছে।
৫. মগনলাল মেঘরাজ ফেলুদার সবচেয়ে বড় শত্রু। জয় বাবা ফেলুনাথ, যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে ও গোলাপী মুক্তা রহস্য- এই তিনটি কাহিনিতে মগনলালের সঙ্গে টক্কর হয় ফেলুদার। সত্যি বলতে মগনলাল মেঘরাজ থাকা মানেই কাহিনি যেন জমে যেত। টক্কর হতো সেয়ানে-সেয়ানে।
৬. ফেলুদাকে নিয়ে হয়েছে বেশ কয়েকটি সিনেমা, হালফিল ওয়েব সিরিজও। বড় পর্দার প্রথম ফেলুদা কিন্তু সৌমিত্রই। ১৯৭৪ সালে, সোনার কেল্লা দিয়ে তার আবির্ভাব। সত্যজিৎ রায় তার অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ছাড়া ফেলুদা চরিত্রে তিনি অন্য কাউকে ভাবতেই পারেননি। বড় পর্দা ও ছোট পর্দায় সৌমিত্র-পরবর্তী সময়ে সব্যসাচী চক্রবর্তীকে আমরা দেখি ফেলুদার ভূমিকায়।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার ইচ্ছা জাগে সব্যসাচীর। টেলিফিল্ম বাক্স রহস্য তার প্রথম ফেলুদা। এটি প্রচার হয় ১৯৯৬ সালে। আর বড় পর্দায় তার অভিনীত প্রথম ফেলুদা বোম্বাইয়ের বোম্বেটে। মুক্তি পায় ২০০৩ সালে।
আবীর চ্যাটার্জী, পরমব্রত চ্যাটার্জী ও টোটা রায় চৌধুরীর মতো জনপ্রিয় অভিনেতাকেও আমরা দেখেছি হালফিল ফেলুদার ভূমিকায়।
৭. রহস্য সমাধান করতে গিয়ে ভারতের জঙ্গল-পাহাড়-সৈকত-গ্রাম-কলকাতায় ইচ্ছামতো চষে বেড়ান প্রদোষ চন্দ্র মিত্র তার বইগুলোতে। কখনো গ্যাংটক, বারাণসী কিংবা কেদারনাথ, কখনো দার্জিলিং বা জয়সলমির। আবার নেপালের কাঠমাণ্ডু কিংবা যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও আমরা যেতে দেখি ফেলুদাকে। তার মানে পাঠকের রহস্য-রোমাঞ্চের পাশাপাশি চমৎকার ভ্রমণও হয়ে যায় ফেলুদার মাধ্যমে।
৮. সত্যজিৎ রায় ফেলুদার বইগুলোর প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভেতরের অলংকরণ করতেন নিজেই। তার আঁকায় পাঠকের মনে ফেলুদাসহ বিভিন্ন চরিত্র যেন আরো বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে।
৯. আনন্দবাজারে এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায়ের কাছে জানতে চেয়েছিল ফেলুদার মতো কোনো মানুষকে সত্যজিৎ রায় কি চিনতেন?
সন্দীপের উত্তর, বাবাই ছিলেন ফেলুদা। ফেলুদার অনেস্টি, ডেডিকেশন, বুদ্ধি, জ্ঞান, সবই তো বাবার মতো দেখেছি। এমনকি ফেলুদা যা খেতে ভালোবাসত বাবাও তাই খেতে ভালোবাসত। যত সময় যাচ্ছে ফেলুদা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে বাবাকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছি...
১০. ফেলুদার বইয়ে মোবাইল, ইন্টারনেটসহ আধুনিক কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। সত্যজিৎ যখন ফেলুদার কাহিনিগুলো লেখেন, তখন আধুনিক প্রযুক্তির ওই সব অনুষঙ্গের সে অর্থে চল শুরু হয়নি। এসবের সাহায্য ছাড়া দিব্বি জটিল সব রহস্য সমাধান করে গেছেন ফেলুদা। কিন্তু তিনি আজকের দিনে ‘মিসফিট’ নয় মোটেই। তেমনি ফেলুদার গল্প কিংবা উপন্যাসে মেয়েদের উপস্থিতি খুব কম হলেও ফেলুদার পাঠক হিসেবে মোটেই পিছিয়ে নেই মেয়েরা। ফেলুদাকে নিয়ে অনেকক্ষণ বক বক করলাম। শেষ করার আগে বলছি, ফেলুদার গল্প-উপন্যাস খুব একটা পড়েননি যারা, তারা ফেলুদা সমগ্র না কিনে আলাদা বই কিনলেই পড়ে আনন্দ পাবেন বেশি। আর তার সঙ্গে হারিয়ে যাবেন রহস্য-রোমাঞ্চের এক আশ্চর্য ভুবনে।
সূত্র : ফেলুদার বিভিন্ন বই, আনন্দবাজার, বিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া