Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বিশ্বসাহিত্যে ‘নিঃসঙ্গতা’ কামু থেকে কাফকা

Icon

পল্লব শাহরিয়ার

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩

বিশ্বসাহিত্যে ‘নিঃসঙ্গতা’ কামু থেকে কাফকা

কামু থেকে কাফকা। ছবি: সংগৃহীত

মানুষের গভীরতম অনুভবের মধ্যে সবচেয়ে নীরব ও নির্জন আবেগটি নিঃসঙ্গতা। সাহিত্যের ইতিহাসে এটি যেন এক অনুচ্চারিত সংগীত, যে সুরে গীত হয়েছে হাজার বছর ধরে মানুষের আত্মগ্লানি, অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা এবং জীবনের নিরর্থকতা। 

আধুনিক যুগের সূর্যোদয় মানেই এক রকমের অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া। সভ্যতা যত এগিয়েছে, মানুষ তত নিজের ভেতরে ডুবে গেছে। ফ্রাঁৎজ কাফকার “The Metamorphosis”-এ গ্রেগর সামসার রূপান্তর আসলে তার শারীরিক নয়, সামাজিক নিঃসঙ্গতার প্রতীক। সে মানুষের মতো আর কথা বলতে পারে না, তাকে কেউ বোঝে না, সে একঘরে হয়ে পড়ে। সে যেন আধুনিক শহরের প্রতিটি মানুষের প্রতিরূপ, যে নিজের পরিবারের ভেতরেই অচেনা হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে আলবেয়ার কামুর ‘The stranger’-এ মেরসো যেন এক অবিশ্বাস্য রকম শীতল চরিত্র, অথচ তার সেই শীতলতা আসলে এক গভীর অস্তিত্ববাদী জিজ্ঞাসার প্রতিচ্ছবি। জীবন কি অর্থহীন? মৃত্যুই কি একমাত্র নিশ্চিত সত্য? ঈশ্বরের নীরবতা, সমাজের বেহায়া মূল্যবোধ- সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ যখন অনুভব করে যে সে একা, সম্পূর্ণ একা, তখনই সে হয়তো সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে। নিঃসঙ্গতা এখানে শুধুই প্রেমহীনতা নয়, এটা অনেক বড় কিছু। এটা এক ধরনের দার্শনিক অবস্থা, যেখানে মানুষ তার নিজের ভেতর নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরে, আর চারপাশের সমাজ, ধর্ম, সম্পর্ক তার সেই যাত্রায় তাকে আরো একা করে তোলে। সার্ত্র বলেছিলেন, ‘Hell is other people.’ এই কথার ভেতরে লুকিয়ে আছে আধুনিক মানুষ ও নিঃসঙ্গতার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব।

বেকেটের ‘waiting for Godot’-এ দুই চরিত্র দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, অথচ কেউ আসে না। সেখানে ঈশ্বর অনুপস্থিত, সময় অর্থহীন, কথোপকথন নিরর্থক। তারা কীসের জন্য অপেক্ষা করছে? মুক্তির জন্য? বাঁচার জন্য? নাকি শুধুই সময় কাটানোর জন্য? সেখানে নিঃসঙ্গতা এক নীরব প্রহরীর মতো ঘুরে বেড়ায় মঞ্চজুড়ে।

এই নিঃসঙ্গতার সূত্রে আসে হারুকি মুরাকামি। তার গল্পগুলো যেন একেকটি আধুনিক দিবাস্বপ্ন- জেগে থাকা ঘুমের মতো। Norwegian wood–এর তোরু ওয়াতানাবে যেন তার চারপাশে ভিড় করেও নিঃসঙ্গতায় ডুবে যায়। সম্পর্ক থাকে, কিন্তু ছুঁতে পারে না। শব্দ থাকে, কিন্তু বোঝায় না।

নিঃসঙ্গতা সব সময় পুরুষের মনোজগতের অভিজ্ঞতা নয়। নারীর নিঃসঙ্গতা যেন একান্তভাবে ভিন্ন এক অভিজ্ঞান, সেখানকার বেদনা শুধু দার্শনিক নয়, শরীরী, সামাজিক ও আত্মিকও। virginia woolf তার উপন্যাসে, বিশেষত Mrs Dalloway বা To the Lighthouse-এ নিঃসঙ্গতা এঁকেছেন এক ধীর অথচ ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা হিসেবে। তার চরিত্ররা প্রায়ই জনাকীর্ণ সমাজজগতে থেকেও মানসিক নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকেন। কথা হয়, আতিথেয়তা চলে, চা খাওয়া হয়, কিন্তু ভেতরে খেলা করে মৌন অস্তিত্বের ক্রন্দন। এক ধরনের শব্দহীন আর্তি।

আবার আমরা যখন ফিরে আসি আলবেয়ার কামুর The myth of sisyphus–এ, সেখানে নিঃসঙ্গতা আর অস্তিত্বের নিরর্থকতার প্রশ্ন একেবারে দার্শনিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। সিজিফাস যে বারবার পাথর ঠেলে পাহাড়ে তোলে, আর সেটি গড়িয়ে পড়ে, সে প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় সেই মানুষটির, যে প্রতিদিন সকালে ওঠে, কাজে যায়, ফেরে, খায়, ঘুমায়, অথচ জানে, তার যাপনের কোনো চূড়ান্ত অর্থ নেই।

কামু বলেন, ‘one must imagine sisyphus happy.’ এই এক বাক্যে তিনি যেন আমাদের বলেন, অর্থহীনতাও যদি মেনে নেওয়া যায়, তবে তাতেই হয়তো কিছু অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভাবনা শুধু এক দার্শনিক উপলব্ধি নয়, বরং এক শৈল্পিক প্রকাশ- সাহিত্যের ভেতরে ঢুকে গিয়ে প্রশ্ন তোলে, মানুষ কেন বাঁচে? এবং যখন সে বুঝে ফেলে ঈশ্বর নেই, অর্থ নেই, তবুও কেন সে ভালোবাসে, লেখে, স্বপ্ন দেখে?

এখানে এসে নিঃসঙ্গতা আর অস্তিত্ব যেন মিলেমিশে যায়। একা থাকাটা আর শুধু হৃদয়ের ক্লান্তি নয়, হয়ে ওঠে জীবনের স্বরূপ সন্ধানের পথ।

সমকালীন সাহিত্যে আমরা এই নিঃসঙ্গতাকে দেখি আরো নরম অথচ কষ্টকর রূপে- Haruki murakami, paul Auster বা Elena Ferrante-এর সাহিত্যে, যেখানে সম্পর্ক আছে, শহর আছে, প্রযুক্তির আলোকচ্ছটা আছে, তবুও মানুষ একা। সে আর সমাজের অঙ্গ নয়, বরং এক ঘূর্ণিপাকের কেন্দ্র। কখনো প্রেমিকা পাশেই শুয়ে থাকে, অথচ তার চোখে কিছুই পড়ে না। ফোন বেজে ওঠে, কিন্তু কণ্ঠস্বর আসে না। মেসেজ আসে, তবু উত্তর নেই।

তার কবিতায় মানুষের নিঃসঙ্গতা কোনো সংকোচ নয়, বরং এক শুদ্ধ অনুভব, যেখানে ‘আমি’ আর ‘জগৎ’ একে অপরের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়।

তার ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় যেমন তিনি লিখেছিলেন-

অন্ধকারে একটি মুখ দেখেছিলেম- মনে পড়ে...

এই মনে পড়ে শব্দ দুটোতে জড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গতার চিরায়ত আবহ- এক অতীত, যাকে ছুঁতে পারা যায় না; এক স্পর্শ, যা আজ কেবল স্মৃতিতে। তবে জীবনানন্দের নিঃসঙ্গতা কেবল হতাশা নয়। তাঁর কবিতা এক অন্তর্জগতে প্রবেশের প্রক্রিয়া, যেখানে নিঃসঙ্গতা হয়ে ওঠে আত্মাবিষ্কারের পথ। তার কাছে ‘নির্জনতা’ যেন প্রকৃতির ভাষা, যেখানে মানুষ নিজের সঙ্গে কথা বলে।

নিঃসঙ্গতা কেবল এক দুঃখের নাম নয়। সাহিত্যে এটি এক জ্ঞানের পথ, যেখানে মানুষ নিজেকে দেখে ছায়ায়, জলের প্রতিফলনে, অথবা অন্য এক মানুষের মৌন দৃষ্টিতে। কামু, কাফকা, জীবনানন্দ, প্লাথ, মার্কেজ- সবাই যেন বলছেন এক সুরে- তুমি একা, কিন্তু একাকিত্বেই লুকিয়ে আছে তোমার অন্তরতম সম্ভাবনা।

এই সম্ভাবনার দিগন্তে দাঁড়িয়ে সাহিত্য তার আলো জ্বালে, শব্দে রচনা করে সেই নিঃসঙ্গতার সৌন্দর্য, যা আমাদের একা করেও একাগ্র করে, বিচ্ছিন্ন করেও ভাবনায় যুক্ত করে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫