বুকার পুরস্কারে ইতিহাস গড়লেন কন্নড় লেখিকা বানু মুশতাক

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১৭:১৯

ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
ভারতের কন্নড় ভাষার লেখিকা, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী বানু মুশতাক এবার রচনা করলেন নতুন ইতিহাস। তার লেখা ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অর্জন করেছে। প্রথম কন্নড় ভাষায় রচিত এবং প্রথম ছোটগল্প সংকলন হিসেবে এই সম্মান লাভ করল সংকলনটি।
বিবিসি তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিচারকম-লী তার লেখার চরিত্রচিত্রণকে বর্ণনা করেছেন ‘বেঁচে থাকার ও প্রতিরোধের এক অসাধারণ প্রতীক’ হিসেবে।
১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রচিত গল্পগুলোতে বানু মুশতাক তুলে ধরেছেন দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনের নানা স্তর, সংগ্রাম, নিপীড়ন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাঞ্জল চিত্র। সংকলনের ১২টি গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি, যিনি লেখিকার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন বুকার পুরস্কারের অর্থমূল্য, ৫০ হাজার পাউন্ড, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮১ লাখেরও বেশি।
পুরস্কার গ্রহণের সময় লেখিকা বলেন, ‘বইটি এক বিশ্বাস থেকে জন্ম নিয়েছে যেকোনো গল্পই ছোট নয়; মানুষের অভিজ্ঞতার বুননে প্রতিটি সুতোই এক পূর্ণ চিত্র বহন করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই বিভক্তির পৃথিবীতে সাহিত্যই একমাত্র পবিত্র আশ্রয়, যেখানে আমরা কয়েকটি পৃষ্ঠার জন্য হলেও একে অপরের মনে বাস করতে পারি।’
এক ‘সাহসী কণ্ঠস্বর’ বানু
বানু মুশতাক বেড়ে উঠেছেন কর্ণাটকের একটি ছোট মুসলিম পাড়ায়। যেখানে আশপাশের মেয়েরা উর্দুতে কোরআন পাঠ করত, সেখানে তিনি ভর্তি হন একটি কনভেন্ট স্কুলে এবং কন্নড় ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। প্রথমদিকে এই ভাষা ছিল তার কাছে একেবারেই অজানা, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেটিই হয়ে ওঠে তার লেখার প্রধান মাধ্যম।
রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশ ও ব্যক্তিগত টানাপড়েনের কারণে তার সাহিত্যযাত্রার শুরুটা সহজ ছিল না। ২৬ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করলেও দাম্পত্য জীবন ছিল তার জন্য রীতিমতো কঠিন। অন্যান্য অনেক নারীর মতো তিনিও পেড়িয়েছেন প্রসূতি-পরবর্তী কঠিন সময়।
‘দ্য উইক’-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বানু বলেন, ‘তখন আমি লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লেখার মতো কিছুই ছিল না। একসময় নিজের গায়ে সাদা পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার সন্তান ও স্বামী আমাকে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেছিল, যেন আমি তাদের ছেড়ে না যাই।’
এই অভিজ্ঞতাগুলোই পরে হয়ে ওঠে তার লেখার প্রেরণা। নারীর জটিল বাস্তবতা, আত্মসচেতনতা ও সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে গভীর উপলব্ধি ফুটে ওঠে তার সৃষ্ট গল্পগুলোতে।
বানু পেশাগতভাবে একসময় কাজ করেছেন সাংবাদিক হিসেবে, একটি জনপ্রিয় স্থানীয় ট্যাবলয়েডে। পরে তিনি যুক্ত হন বন্দায়া আন্দোলনে, যা সাহিত্যকে হাতিয়ার করে সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে তুলে ধরত। জীবনের প্রয়োজনে সাংবাদিকতা ছেড়ে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন পরিবারকে সহায়তা করতে।
এ পর্যন্ত তার ছয়টি ছোটগল্প সংকলন, একটি উপন্যাস ও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৪ সালে তার পূর্ববর্তী পাঁচটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ হাসিনা অ্যান্ড আদার স্টোরিস ) প্যান ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বারবার মুখ খুলে হুমকি পেয়েছেন বানু। ২০০০ সালে মুসলিম নারীদের মসজিদে প্রার্থনার অধিকার নিয়ে মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয় এবং তাকে ছুরি দিয়ে আক্রমণেরও চেষ্টা করা হয়।
তবু তিনি থামেননি। তার কথায়, ‘আমি সব সময় ধর্মীয় মৌলবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছি। সমাজ অনেক বদলালেও নারীর মৌলিক সংগ্রাম আজও অপরিবর্তিত।’
‘হার্ট ল্যাম্প’ কী নিয়ে লেখা
বইটিতে বানু মুশতাক সেই নারীদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেন, যারা নিপীড়নের মুখে নিশ্চুপ থেকে নিজেকে বিসর্জন দেয় না, বরং নিজেদের মতো করে গড়ে তোলে প্রতিরোধের পরিসর। প্রতিটি গল্পেই দেখা মেলে এমন নারী চরিত্রের, যারা জীবনের ক্ষুদ্র সিদ্ধান্তগুলোকেই অস্ত্র করে তোলে সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে।
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ‘ভারতীয় সাহিত্যে মুসলিম নারী প্রায়ই নিঃশব্দ ভুক্তভোগী কিংবা অন্য কারো আদর্শিক অবস্থানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হন। বানু মুশতাক সেই প্রচলিত বয়ানকে ভেঙে দিয়েছেন।’
এই গল্পগুলোর ভাষা সরল, কিন্তু অনুভবের দিক থেকে গভীর। প্রতিটি চরিত্র যেন জীবনের তীব্র বাস্তবতা ও আত্মসচেতনতায় নির্মিত এক জীবন্ত প্রতিবিম্ব। ‘হার্ট ল্যাম্প’ পাঠককে নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে প্রান্তিক মানুষের ক্ষীণ প্রতিবাদ রূপ নেয় সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ উচ্চারণে।
সমালোচকদের মতে, বানু মুশতাক প্রমাণ করেছেন সাহিত্যের শক্তি শুধু বিনোদনে নয়, বরং তা সমাজ বদলের বার্তা পৌঁছে দিতে পারে, হতে পারে আত্মসংঘাত থেকে মুক্তির পথ।