Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

কবি নজরুলের অনুবাদক সত্তা

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১৭:৩৪

কবি নজরুলের অনুবাদক সত্তা

ছবি: সংগৃহীত

শুধু কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সাংবাদিক, সংগীতব্যক্তিত্বই নন, উৎকৃষ্ট অনুবাদকও ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার সৃষ্টিশীল জীবন ছিল স্বল্প সময়ের। এরই মধ্যে তিনি যথাসাধ্য বিশ্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের ভুবন গভীর আগ্রহ ও কৌতূহলে ভ্রমণ-মন্থন করেছেন।

সেই তৃষ্ণা, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ তিনি উপহার দিয়েছেন বাংলাভাষী পাঠকদের। সাহিত্যজীবনের শুরুর দিকে মৌলিক রচনার পাশাপাশি ফার্সি সাহিত্য থেকে অনুবাদে আকৃষ্ট হন। সেনাবাহিনীতে থাকার সময় অনুবাদ করেছিলেন ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ থেকে কয়েকটি গজল। 

তার ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কলকাতার শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স থেকে। রুবাইগুলো প্রথম বেরিয়েছিল মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ প্রকাশের তিন বছর পর বের হলো ‘রুবাইয়াৎ ই ওমর খৈয়াম’। সেটি ১৩৬৬ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের ঘটনা। এ গ্রন্থে রুবাই ছিল ১৯৭টি।

মূল ফার্সি থেকে নজরুল ইরানি কবি হাফিজ এবং ওমর খৈয়ামের রচনা অনুবাদ করেছেন। কবি তার শৈশবে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন। ফার্সি শেখেন চাচা কাজী বজলে করিমের কাছ থেকে। রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজের প্রথম কবিতাটি হচ্ছে... 

তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়

দৃষ্টি আমার পলক-হারা

রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ গ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলাম নাতিদীর্ঘ মুখবন্ধ লিখেছেন। একই সঙ্গে মরমি কবি হাফিজের সংক্ষিপ্ত জীবনীও সংযুক্ত করেছেন ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ শিরোনামে। 

মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘সত্যিকার হাফিজকে চিনতে হলে তার গজল-গান-প্রায় পঞ্চশতাধিক পড়তে হয়। তার রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়, এ যেন তার অবসর সময় কাটানোর জন্যই লেখা। অবশ্য এতেও তার সেই দর্শন, প্রেম, সেই শারাব সাকি তেমনিভাবেই জড়িয়ে আছে।’

এ যেন তার অতল সমুদ্রের বুদবুদ কণা। তবে এই ক্ষুদ্র বিম্ব হলেও এতে সারা আকাশের গ্রন্থ-তারার প্রতিবিম্ব পড়ে একে রামধনুর কণার মতো রাঙিয়ে তুলেছে। হয়তো ছোট বলেই এত সুন্দর।

আমি অরিজিন্যাল (মূল) ফার্সি হতেই এর অনুবাদ করেছি। আমার কাছে যে কটি ফার্সি ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ আছে, তার প্রায় সব কটিতেই পঁচাত্তরটি রুবাইয়াৎ দেখতে পাই। অথচ ফার্সি সাহিত্যের বিশ্ব-বিখ্যাত সমালোচক ব্রাউন সাহেব তার ঐরংঃড়ৎু ড়ভ চবৎংরধহ খরঃবৎধঃঁৎব-এ এবং মৌলানা শিবলী নোমানী তার ‘শেয়রুল-আজম’-এ মাত্র উনসত্তরটি রুবাইয়াতের উল্লেখ করেছেন। এবং এই দুজনই ফার্সি কবি ও কাব্য সম্বন্ধে ধঁঃযড়ৎরঃ বিশেষজ্ঞ। 

মুখবন্ধে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরো লিখেছেন, ‘ইরানী কবিদের অধিকাংশই তথাকথিত নাস্তিকরূপে আখ্যাত হলেও এঁরা ঠিক নাস্তিক ছিলেন না। এঁরা খোদাকে বিশ্বাস করতেন। শুধু স্বর্গ, নরক, রোজকিয়ামত (শেষ বিচারের দিন) প্রভৃতি বিশ্বাস  করতেন না। কাজেই শাস্ত্রাচারীর দল এঁদের উপর এত খাপ্পা ছিলেন। এঁরা সর্বদা নিজেদের ‘রিন্দান্’ বা স্বাধীন চিন্তাকারী, ব্যভিচারী বলে সম্বোধন করতেন। এর জন্য এঁদের প্রত্যেককেই জীবনে বহু দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছিল।” 

হাফিজের সব কাব্যের একটি সুরকায় বেখবর, আজ ফসলে গুল ও তরকে শারাব’। 

‘ওরে মূঢ়! এমন ফুলের ফসলের দিন-আর তুই কিনা শারাব ত্যাগ করে বসে আছিস।’

নজরুল অনুবাদিত হাফিজের ৭৩ সংখ্যক (শেষ) রুবাইটি এখানে উল্লেখ করি...

ওরে হাফিজ, শেষ কর তোর

কৃত্রিম এই কলমবাজি!

হল সময় খোলা পাতা

ঝোলায় তুলে রাখার আজি॥

দুই.

‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ এবারের প্রসঙ্গ। তিনটি রুবাই উদ্ধৃত করি

৯৭ সংখ্যক রুবাই

প্রেমের চোখে সুন্দর সেই হোক কালো কি গৌর-বরণ,

পরুক ওড়না রেশমি কিংবা পরুক জীর্ণ দীন-বসন।

থাকুক শুয়ে ধুলোয় সে কি থাকুক সোনার পালঙ্কে,

নরকে সে গেলেও প্রেমিক করবে সেথায় অন্বেষণ।

১৯৫ সংখ্যক রুবাই-

খৈয়াম! তোর দিন দুয়েকের এই যে দেহের শামিয়ানা

আত্মা নামক শাহানশাহের হেথায় ক্ষণিক আস্তানা।

তাম্বুওয়ালা মৃত্যু আসে আত্মা যখন লন বিদায়,

উঠিয়ে তাঁবু অগ্রে চলে; কোথায় সে যায় অ-জানা।

এবং তৃতীয় উদ্ধৃতি 

৬২ সংখ্যক রুবাই-

হুরি বলে থাকলে কিছু একটি হুরি মদ খানিক

ঘাস-বিছানো ঝর্ণাতীরে, অল্প-বয়েস বৈতালিক

এই যদি পাস, স্বর্গ নামক পুরনো সেই নরকটায়

চাসনে যেতে, স্বর্গ ইহাই, স্বর্গ যদি থাকেই ঠিক।

কবি নজরুল কী বলছেন কবি ওমর খৈয়াম সম্পর্কে? ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি ওমরের রুবাইয়াৎ বলে প্রচলিত প্রায় এক হাজার রুবাই থেকে কিঞ্চিদধিক দুশো রুবাই বেছে নিয়েছি; এবং তা ফার্সি ভাষার রুবাইয়াৎ থেকে। কারণ আমার বিবেচনায় এইগুলি ছাড়া বাকি রুবাই ওমরের প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইলের সঙ্গে একেবারে মিশ খায় না। রবীন্দ্রনাথের কবিতার পাশে আমার মতো কবির কবিতার মতো তা একেবারে বাজে।

বাকিগুলিতে ওমর খৈয়ামের ভাব নেই, ভাষা নেই,  এক কথায় স্টাইলের কোনো কিছু নেই। আর তা যদি ওমরেরই হয়, তবে তা অনুবাদ করে, প-শ্রম করার দরকার নেই। বাগানের গোলাপ তুলব; তাই বলে বাগানের আগাছাও তুলে আনতে হবে, এর কোনো মানে নেই। 

আমি আমার ওস্তাদি দেখাবার জন্য ওমর খৈয়ামের ভাব-ভাষা বা স্টাইলকে বিকৃত করিনি অবশ্য আমার সাধ্যমতো। এর জন্য আমার অজস্র পরিশ্রম করতে হয়েছে, বেগ পেতে হয়েছে। কাগজ-পেনসিলের, যাকে বলে আদ্যশ্রাদ্ধ, তা-ই করে ছেড়েছি। ওমরের রুবাইয়াতের সবচেয়ে বড় জিনিস ওর প্রকাশের ভঙ্গি বা ঢং।

ওমর আগাগোড়া মাতালের ‘পোজ’ নিয়ে তার রুবাইয়াৎ লিখে গেছেন মাতালের মতোই ভাষা, ভাব, ভঙ্গি, শ্লেষ, রসিকতা, হাসি, কান্না সব। কত বছর ধরে কত বিভিন্ন সময়ে তিনি এই কবিতাগুলি লিখেছেন, অথচ এর স্টাইল সম্বন্ধে কখনো এতটুকু চেতনা হারাননি। মনে হয়, এক দিনে বসে লেখা। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ওমরের সেই ঢঙটির মর্যাদা রাখতে। 


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫