Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বিয়ের গান : ধামাইল থেকে সয়লা

Icon

আলমগীর খোরশেদ

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১৪:৪৩

বিয়ের গান : ধামাইল থেকে সয়লা

গ্রাম বাংলায় বিয়ের গান

যেকোনো জাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে বিয়ে নামক সামাজিক রীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। একই সঙ্গে যুক্ত  বিয়ের গানও। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিয়ের গানকে সয়লা বলে। এই সয়লাকে ঘিরে অনেক কথাই বলা যায়। সাধারণত নিরক্ষর নারীরা গীত বাঁধে, বিয়েতে গায় সেটাই ‘সয়লা’।  আবার একইভাবে সিলেট অঞ্চলের ধামাইল গানও বিয়ের গান। বিয়ে অনুষ্ঠানে এগুলো গীত হয়।

বিয়ে সংস্কৃতির এই রীতি নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ। বিয়ের গানও লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বলতম মাধ্যম। অতুল সুর এ দেশীয় বিয়ের ইতিহাস বর্ণনায় বলেছেন কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের রীতিনীতি ভৌগোলিক অবস্থান এবং সংস্কৃতি অনুযায়ী পাল্টেছে। বিয়ের আচারের মধ্যেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের ব্যবহারে বদল এসেছে। আবার অর্থ বদলেছে বিয়ের গানেরও। কিন্তু বিয়ের গান বলতে মূলত বোঝায় বিবাহ আচার, কন্যাপক্ষ, বরপক্ষকে নিয়ে বাঁধা গান। বিয়ের গানের সঙ্গে সেই জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কিত লোকের পরিচয় সম্পূর্ণ উঠে আসত। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে পাওয়া খবর থেকে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে নিয়ে মজাদার চটুল গান বাঁধে। বাঙালি বিয়ের গানে আবার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে আচারের ভিন্নতা অনুযায়ী গান বাঁধা হয় আলাদাভাবে। প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। আর এটা করতেন অন্তপুরের মহিলারাই। এখন যদিও এই গানের ধারাটি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তবুও প্রত্যন্ত গ্রামে কোথাও কোথাও এখনো বিয়েতে গান গাওয়ার প্রচলন আছে। এসব গান আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত, স্মৃতি ও স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকশিত। সিলেটের বেশ কিছু জনপ্রিয় আঞ্চলিক বিয়ের গান রয়েছে, যেগুলো প্রায় সব বাড়ির নারীরাই জানেন। তাই গীতের সঙ্গে প্রায় সবাই গলা মেলাতে পারে। গীতের তালে তালে নারীরা তুলে ধরেন

বরের মেজাজ, কনের চালচলন। সিলেটি বিয়ের গানের একটি নমুনা উল্লেখ করা হলো : দেখছি কইন্যার মাথা ভালা ডাব নারকেল জুড়ারে/দেখছি কইন্যার দাঁত ভালা আনারের দানারে/দামান্দেরও সাত ভাই সাত ঘুড়া ছুয়ারী/একেলা দামান রাজা চৌদল চুয়ারী/চৌদলের কিনারে পড়ে হীরা লাল মতিরে/চল যাই চল যাই দামান দেখিবারে। আবার দক্ষিণবঙ্গে এই গানই  গাওয়া হয় ভিন্নভাবেÑওই না কাপড় দেইখা আইলাম/তাঁতির দোকানে/সেই কাপড় এখন দেখি বেহুলার পিন্দনে।’ গ্রামে গায়েহলুদ মানেই একরাশ খুশি, আনন্দ, ঠাট্টা সম্পর্কীয়দের সঙ্গে রং আর কাদা মাখামাখি খেলা। ঠাট্টা সম্পর্কের যারা বেয়াই, বেয়াইন, দেবর, ভাবি, দাদা, দাদিদের মুখে শরীরে জোর করে কাদা ও হলুদ মাখিয়ে দিতে পিছু পিছু দৌড়ে যেতেন। এ নিয়ে অনেক সময় ভুলবোঝাবুঝি হতো, যা মন খারাপের অনুষঙ্গ হয়ে দীর্ঘদিন কথা বলা বন্ধ থাকত। বর বা কনেকে হলুদ মেহেদি পরানোর

সময় গায়েহলুদের গীত বা গান ধরত মেয়েরা।  কিশোরগঞ্জ বা ভাটি অঞ্চলের বিয়ের গানের রীতি ভিন্ন। তারা গায় ‘অলদি বাডি মেন্দি গিলা/আইজ কইন্যার বিয়া/আইব জামাই মাইজ রাইত/গরুর গাড়ি দিয়া।’ আবার কোথাও বর শ্বশুরবাড়িতে এলে শ্যালিকা তাকে সমাদরে বরণ করে নিত। শ্যালিকা বলত, ‘বাটা ভরা পান গো দুলাভাই/গৈটা ভরা চুন/মিষ্টি জর্দায় খান গো দুলাভাই যাইবেন খুন।’

এভাবেই বেঁচে থাকত গ্রামীণ আচার অনুষ্ঠান। প্রায় সাতশ বছর ধরে চলে আসা বিয়েতে নারীদের গান তথা বিয়ের গান। এখন বিদ্যুতে ফকফকা রাতের গ্রাম। ছন ও টিনের ঘর ছেড়ে দালানঘর বানিয়েছে মানুষ। বিনিময়ে হারিয়ে গেছে আমাদের সংস্কৃতি। বিয়ের গান এখন সেকেলে আজকের প্রজন্মের কাছে। অথচ বিয়ের গান লোকসংস্কৃতির অন্যতম উজ্জ্বল বাহন। এগুলো সংগ্রহ করা দরকার দেশের শিকড় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫