
কবি জসীমউদদীনের পোর্টেট। সংগৃহীত
জসীমউদদীনের ‘কবর’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পঠিত কবিতাগুলোর অন্যতম। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের কল্যাণেই নয়, এই সুনাম কবিতাটির বিন্যাস, বর্ণনা ও শিল্পগুণে। স্ত্রী-পুত্র-মেয়ে হারা এক গ্রামীণ বৃদ্ধ তার জীবনের দুঃসহ বেদনার কথা বর্ণনা করছেন উত্তর পুরুষের কাছে। সেই বেদনায় সাড়া দিয়ে প্রকৃতিও যেভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাতে কবিতাটি হয়ে উঠেছে আরো হৃদয়গ্রাহী। আজ আমরা ‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ উদযাপন করছি। কিন্তু কবিতাটি পাঠকের কাছে পৌঁছানো খুব সহজ হয়নি। কবি জসীমউদদীন যখন বাংলা সাহিত্যের আসরে, তখন চলছে বিশ শতকের তৃতীয় দশক। চলছে রবীন্দ্রবলয় ভাঙার প্রয়াস। সাহিত্যে আধুনিকতার নতুন সুর নির্মাণে তখন চলছে ব্যস্ততা। সে সময়ে বাংলা কাব্যের আসরে জসীমউদদীনের আবির্ভাব খুব সহজ হয়নি। সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় তখনো রবাহুত জসীমউদদীন। প্রত্যাখ্যানের বেদনা তাকে করতে হচ্ছে।
সেই বেদনার অশ্রু, সেই ব্যথাভরা হৃদয়ের আকুতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবর কবিতা প্রকাশের পর দীনেশচন্দ্র সেনকে লিখিত পত্রে। কবি জসীমউদদীনের সঙ্গে কার্যসূত্রে সম্পর্ক ছিল ‘কল্লোল’ পত্রিকার। তখন এই পত্রিকাটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি লেখক গোষ্ঠী। যারা তৎকালে তো বটেই, পরবর্তী সময়েও বাংলা সাহিত্যকে শাসন করেছেন, রাজত্ব করেছেন পাঠকের হৃদয়ে। ১৯২৫ সালে এই কল্লোলেই প্রকাশের জন্য জসীমউদদীন তার ‘কবর’ কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পত্রিকা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন কবিতাটি অনাদরে ফেলে রাখে। পরে একটি সংখ্যায় প্রকাশ করে, পত্রিকার একদম শেষে, খুব ছোট হরফে। এ প্রসঙ্গে জসীমউদদীন নিজেই তার আত্মজৈবনিক গদ্যে লেখেন, ‘অনেক গড়িমসির পর কল্লোলের কোন সংখ্যায় একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় অতি ছোট অক্ষরে কবিতাটি ছাপলেন কল্লোল কর্তৃপক্ষ।’ [জসীমউদদীন, যাঁদের দেখছি, দীনেশচন্দ্র প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা ৭১-৭২] কল্লোলের পৃষ্ঠায় ‘কবর’ নামে বিখ্যাত কবিতাটি প্রকাশিত হয়ে শুরুতেই সকল রসিক কাব্যপাঠককে চমকে দিয়েছিল, এমন নয়। যতটা প্রত্যাশা ছিল, কবিতাটি সেভাবে সুধী মহলের দৃষ্টি কাড়েনি। বরং নজর এড়িয়ে যায়। কিন্তু নিজের লেখা সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা নিয়ে জসীমউদদীন তার কবিতাটি দীনেশচন্দ্র সেনকে পড়ে দেখতে সাহিত্য আড্ডার একাল-সেকাল অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন।
গ্রাম্য গান সংগ্রহের কাজে জসীমউদদীনের সঙ্গে দীনেশচন্দ্রের পত্রালাপ ছিল। কবির পত্র পেয়ে তিনি কবিতাটি পাঠ করেন। কবিতাটি তাকে ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো’ আকৃষ্ট করে। দীনেশচন্দ্র কবিত্বময় ভাষায় কবিতাটির প্রশংসা করে কবিকে পত্র দিলে অভিমানী জসীমউদদীন প্রতি-উত্তরে দীনেশচন্দ্রকে লেখেন, ‘এমন কত কবিতাই ত রচনা করেছি; কিন্তু কোনো ভালো মাসিক পত্রিকাই তা ছাপায় না। কবিতা লিখে আর কী হবে? [জসীমউদদীন, যাদের দেখছি, দীনেশচন্দ্র প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা : ৬৭-৬৮] এই পত্রালাপের মাসখানেকের মধ্যেই দীনেশচন্দ্র সেন ‘ফরোয়ার্ড নামের একটি ইংরেজি পত্রে জসীমউদদীনের কবিতার প্রশংসা করে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ওই প্রবন্ধেই তিনি মুসলমান কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলামের পরই জসীমউদদীনের স্থান নির্দেশ করেন। সেদিন দীনেশচন্দ্র শুধু প্রবন্ধ লিখেই কবিকে উৎসাহিত করেননি, তিনি উদ্যোগী হয়ে ‘কবর’ কবিতাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য তালিকাভুক্তও করেন। সে সময় জসীমউদদীন বিএ ক্লাসের ছাত্র। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতার যে মূল্যায়ন, এমনটি বাংলাদেশের আর কোনো কবি বা সাহিত্যিকের ভাগ্যে জোটেনি। কবর কবিতাকে ‘বাংলা কবিতার নতুন দিগদর্শন’ বলে চিহ্নিত করে এর অনন্য সৃষ্টি মহিমারই স্বীকৃতি জানিয়ে কল্লোলযুগ গ্রন্থে অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত বলেন, ‘একটি কবিতা গেঁয়ো মাঠের সজল-শীতল বাতাসে উড়ে আসে কল্লোলে’।
কবিতাটি প্রসঙ্গে ড. সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় তার জসীমউদদীন গ্রন্থে বলেন, ‘বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি ও হৃদয়ানুভূতির সার্থক সমাবেশে কবিতাটি দুর্লভ শিল্পসার্থকতার অধিকারী হয়েছে। পল্লীবৃদ্ধের দুঃসহ বেদনার এ চিত্র এক হিসেবে পল্লীবাসীর দুঃখ-বেদনারই আন্তরিক ও প্রতিনিধি স্থানীয় চিত্র। কবর কবিতাটি আবহমান বাংলার অনাড়ম্বর সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। আধুনিক কাব্যের সব জটিলতা, দুর্বোধ্যতা ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত কবিতাটিতে রয়েছে আন্তরিকতার স্পর্শ, যা শতবর্ষ পেরিয়ে এসেও কবিতাটিকে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। মৃত্যুর পটভূমিতে করুণাঘন জীবনসংগ্রামের যে চিরায়ত রূপ ফুটে উঠেছে রাখালি কাব্যগ্রন্থের ‘কবর’ কবিতায়, তা জসীমউদদীনের রচনাসম্ভারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আধুনিক বাংলা কাব্যে ব্যতিক্রম কবি প্রতিভা জসীমউদদীন নাগরিক সাহিত্যের বিপরীতে লৌকিক জীবননির্ভর লোকসাহিত্যের অমূল্য রত্নের সন্ধান দিয়েছেন। তাই ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো’ তার কবিতা আজও বাঙালি পাঠকের ‘অন্তরকে স্পর্শ করে’, তার কবিতা পড়ে আজও বাঙালি পাঠক ‘কাঁদে’।