
দ্রোহ ও প্রেমের কাব্যভাষা নির্মাণে বাঙালি কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (জন্ম : ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬, মৃত্যু : ২১ জুন ১৯৯১)। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জন্ম নেন এই অকাল প্রয়াত শিল্পস্রষ্টা। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে লিখেছেন দুই হাত খুলে। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে যার সংখ্যা মোটেও কম নয়। শব্দ প্রয়োগে, অলঙ্কার ব্যবহারে বা বাক্যবিন্যাসেই শুধু নয়, শ্রুতিমধুর ধ্বনিবিন্যাসেও তিনি ছিলেন পারঙ্গম, ছিলেন সচেতন ও সতর্ক। বাংলা আধুনিক কবিতার ধারায় রুদ্র সংযোজন করেছিলেন নতুন এক মাত্রা। প্রেম ও বিরহের পাশাপাশি তাঁর কবিতা কখনো ইতিহাস সচেতন, কখনোবা উচ্চকণ্ঠ। অতি সংক্ষিপ্ত কাব্য-জীবনে প্রতিভার পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশ না পেলেও ওই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন তার সামর্থ্য ও স্বকীয়তার স্বাক্ষর। বাংলার চিরায়ত লোকজীবনকে ঘিরে তার কাব্যিক স্বপ্ন-কামনা, সেই সঙ্গে দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার তার কবিতার পাঠককে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করে।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মাঝখানে বিস্তর ফারাক থেকে যায়। অপ্রত্যাশিত এক অরাজক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের কবিদের মনেও জন্ম নেয় নানা জিজ্ঞাসা ও ক্ষোভ। সমান্তরাল সময়ে রুদ্র তার সাহসী কলমে উচ্চারণ করেন দ্রোহের কথা। তিনি বলেন, ‘দিন তো এলো না!/পৃথিবীর মানচিত্রের থেকে ছিঁড়ে নেয়া সেই ভূমি /দুর্ভিক্ষের খরায় সেখানে মন্বন্তর এলো। /হত্যায় আর সন্ত্রাসে আর দুঃশাসনের ঝড়ে উবে গেল সাধ বেওয়ারিশ লাশে শাদা কাফনের ভিড়ে, /তীরের তরীকে ডুবালো নাবিক অচেতন ইচ্ছায়।’ (কবিতা : হাড়েরও ঘরখানি)
আবার নিজেই তিনি চলমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখতে চান। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেন রুদ্রের কবিতার এক অবিনাশী অনুপ্রেরণা। বিপন্ন স্বাধীনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাই তার অনবদ্য উচ্চারণ করেছেন-‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি,/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে’-(কবিতা : বাতাসে লাশের গন্ধ)
তার সময়ে এত কিছুর পরও রুদ্র স্বপ্ন দেখতেন এক উজ্জ্বল আগামীর। তিনি কল্পনা করেছেন এমন একটি আদর্শ সমাজকাঠামোর, যা হবে সুষম বণ্টনভিত্তিক জীবনবোধসম্পন্ন। জীবন বন্দনার এমন উদাহরণ বাংলা কবিতায় প্রকৃত অর্থেই অতুলনীয়, অনন্যসাধারণ। যেমন-‘আমাদের পুরুষেরা সুলতানের ছবির পুরুষদের মতো/স্বাস্থ্যবান, কর্মঠ আর প্রচণ্ড পৌরুষদীপ্ত হবে। /আমাদের নারীরা হবে শ্রমবতী, লক্ষ্মীমন্ত আর লাবণ্যময়ী আমাদের শিশুরা হবে পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পদ।’ (কবিতা : ইশতেহার)
প্রেম এবং এর ক্ষরণ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। সমালোচকদের মতে, প্রেমের আকুতি কিংবা বিরহ কবিতার মধ্য দিয়ে কখনো কখনো তার ব্যক্তিজীবনকে নির্দেশ করলেও অসাধারণ শব্দ-ব্যঞ্জনা এবং কাব্যের গভীরতা তার কবিতাকে করেছে নান্দনিক, সর্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ। প্রবল প্রেমের আকুতি নিয়ে তার চাওয়া-
‘কিছুটা তো চাই-হোক ভুল, হোক মিথ্যে প্রবোধ,/অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জ্যোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, /কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই।’ (কবিতা : অভিমানের খেয়া)
নিকট অতীতে প্রকাশিত রচনাবলিতে স্থান পেয়েছে তার কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, কাব্যনাট্য, সম্পাদকীয়, সাক্ষাৎকার, চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্র কাহিনি, পত্রগুচ্ছ প্রভৃতি। এগুলো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতারই পরিচয়বাহী।