
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (২৩ জুন, ১৯৩০)। আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যার। এক নামেই যার পরিচিতি। এই পরিচিতি গোটা বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে চলে গেছে। তিনি তার গুণের কারণে ছাত্র-অছাত্র সবার স্যার হয়ে যে শ্রদ্ধার আসনে বসে আছেন বহুকাল ধরে-এখানে তার সমান্তরালে কেউ নেই। তিনি বাগস্বাধীনতা, মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের নিরলস অবদানে সমৃদ্ধ তিনি তাদের অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা। তিনি একজন যশস্বী প্রাবন্ধিক। অন্যদিকে প্রবন্ধ সাহিত্য বিষয়টিই একটু নিরস ও বেশ খানিকটা দুর্বোধ্যতায় ভরা। সাহিত্যকে প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন করতে গেলে এমন হবে, এটাই স্বাভাবিক। পুঁজিবাদী সমাজ ও মধ্যবিত্তের চরিত্রসহ বড় বড় মানুষকে নিয়ে শ্রেণিকেন্দ্রিক বিচার এটা দুঃসাধ্য কাজ। তার পরও প্রবন্ধ সাহিত্যকে স্বচ্ছ জলের মতো করে দাঁড় করানো সহজ কাজ নয়। যে কাজটি আমাদের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার করে আসছেন। তার লেখার মধ্যে কোনো শাব্দিক জটিলতা নেই বললেই চলে। শব্দচয়ন, কাঠামো নির্মাণ, ভাষার সারল্য এতটাই সহজ করা যে স্যার যেভাবে কথা বলেন তেমন মজা করেই গদ্য লেখেন। তার কথার মতো প্রবন্ধের ভাষা কতটা সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে সেটা স্যারের লেখা পড়লে বোঝা যাবে। স্যারের লেখায় রাজনীতি আছে, আছে শ্রেণি চরিত্রের সুসমা, তার মধ্যেই সারল্যে স্থির তার গদ্য।
প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘শুধু মুখের কথাই জীবন্ত। যত দূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সে ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও লেখায় ঐক্য রক্ষা করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়। ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’ (কথার কথা : প্রবন্ধ সংগ্রহ)। স্যারের লেখা বই ‘আপনজনের মুখ’ কখনোই একবারে পড়তে পারিনি। একটা লেখা কত শক্তিশালী হতে পারে তা তার লেখা পড়ে সহজেই বোঝা যায়। ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ’, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ (১৯৭৫), আমার পিতার মুখ (১৯৭৬), বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক (১৯৭৬), বেকনের মৌমাছিরা (১৯৭৮), ‘বাঙালিকে কে বাঁচাবে?’, ‘কুমুর বন্ধন’ (১৯৭৭), শ্রেণী সময় ও সাহিত্য (১৯৯০)-এসব বইয়ের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত আর সঞ্চয় করে রাখার মতো সম্পদ রয়েছে অজস্র। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, শিবরাম চক্রবর্তী ও আরজ আলী মাতুব্বর সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ খুবই উঁচু ও সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ। সহজ ভাষায় ছোট ছোট পদবিন্যাসে তার লেখা খুবই ছন্দময়। প্রবন্ধ-সাহিত্যকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্বন্ধে বিশিষ্ট বাম রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক হায়দার আকবর খান রনো একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখা লিখেছিলেন ‘আমাদের বুধবার’ নামের একটি অনলাইন পত্রিকায় (২৪ জুন, ১৯১৪) অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একজন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীর নামÑশিরোনামের এই লেখায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবনের মননশীলতার যে বহুমাত্রিকতা এবং মার্কসবাদী লেখক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তার মননশীল সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছেন-১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘দ্বিতীয় ভূবন’ সাহিত্যবিষয়ক কয়েকটি অসাধারণ প্রবন্ধের সংকলন। অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা। এরিস্টটল, শেকসপিয়ার, টলস্টয়, ইয়েটস, বার্ট্রান্ড রাসেল, এলিয়ট, ফ্রানৎস ফাঁনো প্রভৃতি বিশ্ব ইতিহাস ও সাহিত্যের দিকপালের পাশাপাশি আছেন বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেইÑরবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মীর মশাররফ হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, জীবনানন্দ, সুকান্ত প্রমুখ। এই সংকলনের নামটি কেন ‘দ্বিতীয় ভূবন’? এই নামকরণের মধ্য দিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। তিনি মনে করেন, সাহিত্যজীবন বিচ্ছিন্ন নয়। এ কথা ঠিক যে সাহিত্য-সংস্কৃতির ভিত্তিকে প্রভাবিত করে। সেটাকে অস্বীকার করা হবে একপেশে ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি স্বয়ং ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে এমন একপেশে ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছিলেন। যাই হোক, সেই প্রসঙ্গ এখনকার আলোচ্য বিষয় নয়। আমি যেটা দেখাতে চাই তা হলো, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আধিবিদ্যকের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমাজ এবং সমাজের শ্রেণি দ্বন্দ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে কখনই বিচার করেননি। তিনি সাহিত্যের সামাজিক উৎসভূমি সন্ধান করেন। শ্রেণি বিশ্লেষণের মাইক্রোসকোপের তলায় ফেলে সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিচার করেন। তার একটি বইয়ের নাম ‘উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’। নামটির মধ্যেই ভিন্নতার সুর আছে, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির বিশিষ্টতাও তাতে ধরা পড়ে। এটা হলো মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো কিছু কিছু তাত্ত্বিকের মতো তিনি এভাবে শুরু করেন নাÑ‘মার্কস ইহা বলিয়াছেন, অতএব ইহা সত্য’। সেটা হলো মুখস্থ বিদ্যা, মার্কসবাদের যথাযথ প্রয়োগ নয়। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মার্কসবাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিত্তি করে বিশেষ সময় ও যুগের সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সঙ্গে সমাজের ও শ্রেণির সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূচনা, বিদ্যাসাগর থেকে যার যাত্রারম্ভ (রাজা রামমোহন রায় গদ্য লিখলেও ওটাকে ঠিক গদ্য সাহিত্য বলা যায় না) এবং ঊনিশ শতকের শেষভাগে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যার বিস্তার, সেই গদ্য সাহিত্য যে সমাজ বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রথম দেখিয়েছেন একজনই। তিনি হচ্ছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তার নব্বই পূর্ণ হয়েছে এটা আমাদের জন্য আনন্দের। আরো বহুদিন স্যার আমাদের সাহিত্যাঙ্গন ঐশ্বর্যমণ্ডিত করুক-এই প্রত্যাশা করছি।