
২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব গোটা বাঙালি জাতিকে নাড়া দিয়ে গেছে গভীরভাবে। একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা হারিয়ে যেতে বসেছিল জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের হাতে। গুম-খুন ও সাংস্কৃতিক নৈরাজ্যের নরকপুরীতে পরিণত হয়েছিল স্বদেশ। ৫ আগস্ট জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। জুলাই বিপ্লব নিয়ে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা যেভাবে সরব হন, তা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। কবি, দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহারের একটি বই ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন’। ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট এটা প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটা অংশ জুলাই বিপ্লবে সে বই দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘গণঅভ্যুত্থান ও গঠন : বাংলাদেশের গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ প্রসঙ্গে’ বইটি নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই গ্রন্থটির পেছনে আমার নিজের ক্ষতবিক্ষত হৃৎপিণ্ডের অনেক টুকরা জড়িত।’ তিনি বলেন, ভেবেছি, একাত্তরের শহীদদের প্রতি কিছু দায় কি শোধ করা গেল? আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি যে, বাহাত্তরে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠন করতে পারিনি, সেই কাজ আমাদের অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এই গ্রন্থ। জুলাই বিপ্লবে কবিদের যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মাহবুব হাসান, আবদুল হাই শিকদার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মোশাররফ হোসেন খান, তমিজ উদদীন লোদী, জগলুল হায়দার, সায়ীদ আবুবকর, জাকির আবু জাফর, মনসুর আজিজ, সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব, নয়ন আহমেদ, রেদওয়ানুল হক, ফজলুল হক তুহিন, তাজ ইসলাম, হাসান নাজমুল, শাহীন রেজা প্রমুখ। ১৬ জুলাই, ২০২৪ রংপুরের আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর সব বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে ওঠে। এ সময় কবি সায়ীদ আবুবকরও ফুঁসে ওঠেন কবিতায়। তিনি লিখেছেনÑ‘পুকুরের পানির মতো এ নিস্তরঙ্গ মৃত্যুর শহরে আচমকা এ-কি/জীবনের উন্মাদনা! যে ছিল অচল, ছুটছে সে উল্কার গতিতে।/যে ছিল নিথর, উড়ছে সে ঈগলের অধীর ডানায়। কী হলো হঠাৎ......।’ কবি মাহবুব হাসান তাঁর
‘বোবা-কালা জনগণ’ কবিতায় লিখেছেন-‘জনগণ কি বোবা-কালা হয়ে গেছে?/আমি ভাবছি মানুষের সহ্য ক্ষমতা/বা প্রতিবাদের গৌরব কি মিথ?/চৌদিকে সন্ত্রাস ওত পেতে আছে চিতার চৌকিতে/রাজনৈতিক ছত্রপতির ছায়ার ভেতরে!’ ‘শহীদ আবু সাইদ’ কবিতায় আবদুল হাই শিকদার লিখেছেনÑ‘সাইদ সাইদ বলে ডেকে ডেকে পাড়া মাত করি,/ও পুত্র, বাপ আমার, ফিরে আয় ফ্যাসিবাদ উৎখাত করি।/সমস্ত বাংলা আজ সাইদ সাইদ/সাইদের রক্ত আনে রাহু মুক্ত ঈদ।’
তমিজ উদ্দীন লোদীর ‘ফেটে পড়ুক আশার গরিমা’ কবিতায় লিখেছেন-‘এতো এতো আলোকোথায় ছিল/আলোর পাখিরা নিয়ে এলো আলো/ঘোরতর অন্ধকারে জ্বলে ওঠা, ফিনিক দেয়া আলো/ক্রমশ বিস্তৃত হলো।’ জাকির আবু জাফর তার ‘দীপ্ত বাংলাদেশ’ কবিতায় লেখেন : ‘স্বৈরাচারীর জগদ্দল আজ শেষ/নতুন স্বপ্নে হাসছে বাংলাদেশ।/সংকট আর সংগ্রামে দৃঢ় বল/অনড় অটল বিশ্বাসে উচ্ছ্বল।/আত্মগর্বা উচ্চকণ্ঠ-রব/মানেনি কখনো, মানবে না পরাভব।/বীর-বীরত্বে বিস্ময় অনিঃশেষ/হাজার যুগের মুক্ত বাংলাদেশ।’
এ সময় একের পর এক ‘দ্রোহের কবিতা’ সংকলন প্রকাশিত হতে দেখা যায়। জুলাই বিপ্লব নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতে থাকে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন। এর মধ্যে সীমান্ত আকরামের ‘দ্রোহের কবিতা’ সংকলনটি উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রাফিতি দেখে উজ্জীবিত হয় পথচারীরা। একটা গ্রাফিতি ছিল ‘চিরকাল বসন্তের বাহিরেও কিছু ফুল ফোটে।’ কবি হাসান রুবায়াত লিখে রেখেছিলেন কোথাও, কিন্তু তরুণরা তা তুলে ধরল, যা জুলাই বিপ্লবের মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।