
জুলাই বিপ্লবের ছিল সবার চিন্তার চিরাচরিত প্রথাকে ভেঙে ফেলার একটি অসম উদ্যোগ। ১৫ বছরের স্বৈরশাসনকে চ্যালেঞ্জ করা একদল তরুণের মরণপণ আন্দোলন। ছাত্ররা তাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামার পরে তৎকলীন শাসকগোষ্ঠী ভাবতেই পারেনি ছাত্রদের জ্বালানো এই শিখা যেকোনো সময় দাবানল হয়ে উঠতে পরে। তাই ছাত্রদের কথা শোনা তো দূরের কথা, তাদের উঠিয়ে দিতে পেটোয়া বাহিনীকে নামিয়ে দিলেন রাস্তায় আন্দোলন দমন করতে। দমনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সব সময় গতিশীল হয়। আন্দোলন সংগ্রামকে গতিশীল করতে শিল্প সংগ্রামের শোণিত ধারা বিপ্লবীদের সব সময় উদ্বুদ্ধ করে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত গান-কবিতা জাগিয়ে তোলে বিপ্লবী চেতনাকে। আন্দোলনের দমন-পীড়ন লেখক-শিল্পীদের যেভাবে প্রতিবাদী করে, তারা সেই পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে লেখেন গান, কবিতা, পথ নাটক, চিত্রশিল্পীরা আঁকেন ছবি-কার্টুন। যার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের শিক্ষা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন যেটা জুলাই অভ্যুত্থান নামে পরিচিত। এই আন্দোলনেও শিল্প-সংস্কৃতির ভূমিকাকে কোনো অংশে খাটো করে দেখার উপায় নেই। যারা পারেনি তারা অন্যভাবে সাহায্য করেছে। এভাবেই বিন্দু বিন্দু জলকণা আন্দোলনকে সিন্ধুতে পরিণত করেছে।
‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!’ ‘কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!’
সন্ত্রাস ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এটি ছিল মাইলফলক সেøাগান। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের খোলস ভেঙে স্লোগানে সড়ক প্রকম্পিত করে বেরিয়ে আসে দুর্বার পদাতিকরা। তারা বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের দ্রোহের চেতনায় আন্দোলিত হয়েছে। তারা আবৃত্তি করেছে, আবার গেয়েছে-কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট ... ... ... লাথি মার ভাঙরে তালা যতসব বন্দিশালা আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।’ এসব লাইন যে আকাশে-বাতাসে ঝড় তুলেছিল। সারা দেশে বিদ্রোহীদের হাতে ধরিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সব দ্রোহের কবিতা। একই সঙ্গে তারা গেয়েছে-‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদেরই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।’ গীতিকার ইথুন বাবু ফ্যাসিবাদীদের রক্ত চোখ উপেক্ষা করে মৌসুমী চৌধুরীর গলায় তুলে দিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠহার-দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো চলাকলা, কিছু বললে ধরছো চেপে সব জনগণের গলা।’ ‘মুগ্ধর জন্য এলিজি’ কবিতায় কবি শাহীন রেজা লিখেছেনÑ
‘মুগ্ধ’ আমার রক্তের কেউ নয় অথচ/ইউটিউবে দেখা ওর নিষ্পাপ মুখ আমাকে সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল/টিয়ার শেল আর তীব্র ধোঁয়ার মধ্যে /চোখ মুছতে মুছতে ‘পানি লাগবে পানি লাগবে’ বলে ছুটতে থাকা ছেলেটি/প্রচণ্ড বুলেটে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লে মনে হলো/‘মুগ্ধ’ নয়-লুটিয়ে পড়ল আমার স্বদেশ; বাংলাদেশ-‘দীর্ঘ দীর্ঘতর জুলাই’ কবি কামরুজ্জামান লিখেছেন-ঘুমাতে পারি না জুলাইর রাতগুলো হিম /হয়ে আসে শরীর হৃৎপিণ্ড অস্থিমজ্জা/অজস্র গুলির শব্দের আঁধার কালো/পঁচিশে মার্চের কথা স্মরণে আসছে যেন।
কবি তমিজ উদ্দীন লোদী তার ‘মা করো’ কবিতায় লিখেছেন-‘কী যে হয়েছে এখন/
কবিতা লিখতে গেলেই উঁকি দেন মাহমুদ দারবিশ/আঙুল উঁচিয়ে ধরেন মায়াকোভস্কি, নেরুদা/রক্তাক্ত ব্যান্ডেজমাখা লোরকার চোখ জ্বলে ওঠে /তারা যেন সমস্বরে বলে, এতো এতো অসঙ্গতি, এতো এতো তোলপাড় /তোমার কবিতা কই?/মনে মনে বলি আছে তো, কিন্তু আপনাদের মতো জ্বলে উঠতে পারলাম কই?’
এসব গান, গ্রাফিতি ও কবিতা আজও জুলাইয়ের প্রতিটি রক্তধারার প্রতিটি ঘটনার স্বাক্ষর বহন করছে। দিনে দিনে এগুলো হয়ে উঠবে ইতিহাসের দলিল।