
বজ্র-বিদ্যুৎ আর ‘মেঘের পরে মেঘ’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) দেখে জানা যায় গ্রীষ্ম বিদায়ের পদধ্বনি আর নয়ন-রঞ্জন সজল বর্ষার আগমন বার্তা। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ঘনকৃষ্ণ পুঞ্জীভূত মেঘের অপূর্ব উড়াল, যেন এক বহু বর্ণিল পাখি! শুধুই ছুটে চলা নিঃসীম শূন্য থেকে শূন্যে। মিছিলে মিছিলে তাদের সাথি শতসহস্র জলকণা। বন্ধনহীন বায়ুর পরশে তারা হয়ে যায় গর্ভবতী। যেন আকাশজুড়ে যক্ষপ্রিয়ার মনোবেদনা! ‘শ্রাবণ মাসে ঘন ঘন বরিষে/সেজাত সুতিআঁ একসরী নিন্দ না আইসে’।
(শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)
তারপর শুধু পুঞ্জীভূত রস। তারপর রসের টলোমলো টলোমলো উপচানো জোয়ার। আবুল হাসানের ‘ডাউন ট্রেনের মতো’ সব যেন ধেয়ে আসে কিংবা ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁয়ে’ (শহীদ কাদরী) যাওয়ার মতো শীতল ধারা। সবকিছুতেই তার স্পর্শ। শুষ্ক প্রান্তর, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, শূন্য জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল-বহুদিন পরে জাগে প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাস। স্পর্শ তার বাঁশবন থেকে ঘাসবনে। মেঘ দেখে আমরা কি কথা মনে করি! কালিদাসের কথা মনে করি। মেঘদূতের কথা মনে করি। কোনো কিছুতেই বর্ষা-বন্দনা থেমে থাকে না। এই বর্ষার সঙ্গেই যে জড়িয়ে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম! বৃষ্টি কি শুধু ধরার মাটিতেই পড়ে! পড়ে ‘মনের মাটিতেও’ (অমিয় চক্রবর্তী)। পড়ে আরো কত জায়গায়! ‘রক্তের মাটিতে শুনি রিমঝিমাঝিম যে আকাশ-গীতা’ (বিষ্ণু দে)। এভাবে ঝরে ‘আকাশ-গীতা’! ধারাপতনেও যে অনেক সুখ-‘আঁধার রাত, তোমার হাত, প্রেমের পথ ধরে/আমরা যাব রাত্রি যাবে, বৃষ্টি যাবে ঝরে (বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়)। কখনো কখনো ‘বৃষ্টিভেজা বাড়ির মতো রহস্যময়’ (অরুণ কুমার সরকার) হয়ে ওঠে সবকিছু। তখনই হয়তো ‘চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরোলো বনে!’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়)। তাতে কি ‘বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম’ (নরেশ গুহ)? না। মুছবে না। বৃষ্টিতে নামতেই হবে। কারণ ‘তোমার শার্ট কি বৃষ্টির চেয়ে দামি?’ (অমিতাভ দাশগুপ্ত)। কখনোই নয়। হলে কি আর ‘বৃষ্টির মেঘের তলে শোনা গেল আর্ত কেকা রব’ (উৎপল কুমার বসু)। যেত না। বৃষ্টি এভাবে প্রাকৃতিকতা থেকে উঠে এসে হৃদয়-বৃত্তিক আর ঐতিহাসিক হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে ব্যক্তিক অনুভবের সঙ্গে প্রাকৃতিক অনিবার্যতার সেতুও। উপস্থাপিত হয় অদ্ভুত রকম চিত্রকল্প। ‘ঝড় বয়ে যায় রজনীগন্ধাবনে’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)। আর যেন ‘তোমার নামে বৃষ্টি নামে’ (খন্দকার আশরাফ হোসেন)। এই যে ঝড়, বৃষ্টি, বিদ্যুতের চমক, স্তব্ধ মাঠের চিত্রকল্প, প্রেয়সী-এসবের মাঝে আকাশ কেমন আছে? প্রেমেন্দ্র মিত্র বর্ষা বন্দনায় লিখেছেনÑ‘কত বৃষ্টি হয়ে গেছে/কত ঝড়, অন্ধকার মেঘ/আকাশ কি সব মনে রাখে?’
এসব বিবিধ বর্ষা-মেদুরতা যতটা ক্ষীপ্রতায় খাতার মাঠে নেমে এলো ততটা গতিময় নয়-প্রকৃতির মাঠে প্রকৃত বৃষ্টির ধারা। তাই তো ‘কদম্ব ফুটিল ডালে, মেঘ তবু ঝরিল না সই’ (সজল সমুদ্র)-এর মতো আক্ষেপ উঠে আসে। ‘চুনী গোস্বামীর মতো সাবলীল সহজ বাতাস’ (তারাপদ রায়) কোথায়?
বর্ষার সঙ্গে নদী, নদীর সঙ্গে নৌকা, নৌকার সঙ্গে মাঝি। নদী-নৌকা-মাঝির সাধে দুই কূলের জীবন। এভাবে পুরো বাঙালি সভ্যতার জীবনধারা ও জীবনচক্র উঠে আসে। নদীর পানি যেন ‘দুগ্ধস্রোত’ (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)।
কে ভুলতে পারবে ‘আসমানি’কে? জসীমউদ্দীন নেই, কিন্তু তার ‘আসমানি’রা আজও ভেন্না পাতার ছাউনিতে থাকে, যেখানে একটুখানি বৃষ্টি হলেই ‘গড়িয়ে পড়ে পানি।’ বৃষ্টির সব মাহাত্ম্য কি তাহলে অজস্র বাসনার মধ্যে লীন হয়ে যায়!
হয়তো বা যায়। হয়তো বা যায় না। কিন্তু হাসির ঝাপটার মতো বৃষ্টিকে ঝরতেই হয়। নইলে যে কালিদাসের মন খারাপ হয়! বৃষ্টি না হলে তো নদী ভরবে না। তখন ‘খেয়াপারের তরণী’ কোথায় খুঁজে পাবে নজরুল? বর্ষা তো সুহৃদ। বিকল্প সন্ধ্যার, লিপিময় দৃশ্যের মতো এটা যে এত রহস্যময়। বৃষ্টি, সবার ভেতরেই আছে, এই কথাগুলো হোক জানাজানি।