কাজী মোতাহার হোসেনের যুক্তিবাদী চিন্তা ও সৃষ্টিবৈভব

ফারুক সুমন
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৩:২২

বিশ শতকে যে কজন মনীষীর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও চিন্তার দ্যুতি বাঙালি তথা বাংলাদেশি বাঙালি সমাজকে নানাভাবে দীপিত করেছে, কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭-৯ অক্টোবর, ১৯৮১) তাদের মধ্যে অন্যতম। তার প্রাগ্রসর চিন্তা এই অঞ্চলের মানুষকে মানবিক ও প্রগতিশীল ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি একাধারে একজন লেখক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, গাণিতিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তার যুক্তিবাদী চিন্তা, প্রগতিশীল মনোভাব ও বিজ্ঞানচর্চার একনিষ্ঠতা আমাদের মুগ্ধ করে বৈকি। তিনি শিল্পসাহিত্যবিষয়ক গবেষণাধর্মী নানা গদ্য লিখেছেন। এগুলো আমাদের শিল্পসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া একজন দাবাড়ু বা সংগীতানুরাগী হিসেবেও তার উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতা চোখে পড়ে। বক্ষ্যমাণ লেখায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মনীষীর সৃষ্টিবৈভব ও মহৎ উদ্যোগ সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনার প্রয়াস পাব। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে কখনো এককভাবে আবার কখনো বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তিনি সোচ্চার ছিলেন। পূর্ববাংলার মুসলিমদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতিশীল চিন্তা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সে সময় তার সঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন ও আবুল ফজল এই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। সংগঠনের কর্মপ্রচেষ্টাকে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে তখন বার্ষিক ‘শিখা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো, যেটি মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছে।
কাজী মোতাহার হোসেন পূর্ববাংলার মুসলমানদের মানসিক উৎকর্ষের জন্য বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। তন্মধ্যে ‘অসীমের সন্ধানে’, ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’, ‘আনন্দ ও মুসলমান গৃহ’, ‘সঙ্গীতচর্চা ও মুসলমান’, ‘নাস্তিকের ধর্ম’, ‘মানুষ মোহাম্মদ’, ‘ভুলের মূল্য’, ‘লেখক হওয়ার পথে’ বিশেষভাবে স্মরণীয়। এসব লেখা তৎকালীন সময়ের মতো বর্তমানেও সমাজের সুষ্ঠু বিকাশে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। কাজী মোতাহার হোসেন একজন মননশীল ও যুক্তিনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক ছিলেন। তার লেখায় বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিনির্ভর চিন্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। এসব লেখা মুসলিম সমাজে আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তারে ভূমিকা রাখে। কাজী মোতাহার হোসেন ধর্ম পালনে নিবেদিত ছিলেন। তবে তিনি ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিতেন না। ধর্মকেন্দ্রিক উগ্রতাকে তিনি অপছন্দ করতেন। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সৎ ও মহৎপ্রাণ দেশপ্রেমিক।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখার প্রশংসা করেছেন। প্রখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও ইংরেজ শিক্ষাবিদ ওয়াল্টার অ্যালেন জেনকিন্স তার শিক্ষক ছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে উদারমনা, সরল ও মহৎপ্রাণ মানুষ হিসেবে ভালোবাসতেন। মজার ব্যাপার হলো, তিনি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যান এই তিনটি বিভাগেই শিক্ষকতা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী হিসেবে ‘বোস-আইনস্টাইন থিওরি’র জনক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে কাছে পেয়েছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও মোতাহার হোসেনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিল। বিভিন্ন চিঠিতে কাজী নজরুল ইসলাম তাকে আদর করে ‘মোতিহার’ বলে সম্বোধন করতেন। কবি তার ব্যক্তিজীবনের নানা সুখ-দুঃখের কথা মোতিহারকে জানাতেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মোতাহার হোসেনের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। কথিত আছে যে, শরৎচন্দ্র তার ‘মহেশ’ গল্পটির আখ্যানের ধারণা কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে পেয়েছেন।
কাজী মোতাহার হোসেনের প্রথম লেখা ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি ছিল ‘গ্যালিলিও’ শিরোনামে বিজ্ঞানবিষয়ক একটি প্রবন্ধ। তার পর থেকে তার কলম আর থেমে থাকেনি। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে ‘সঞ্চায়ন’ (১৯৩৭, প্রবন্ধ সংকলন), ‘নজরুল কাব্য পরিচিতি’ (১৯৫৫), ‘সেই পথ লক্ষ্য করে’ (১৯৫৮), ‘সিম্পোজিয়াম’ (১৯৬৫), ‘গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস’ (১৯৭০), ‘আলোক বিজ্ঞান’ (১৯৭৪), ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (১৯৭৬), ‘প্লেটোর সিম্পোজিয়াম’ (অনুবাদ; ১৯৬৫) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাজী মোতাহার হোসেন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ভারত ভাগের পর সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তান পূর্ববাংলার মানুষের সঙ্গে বৈষম্য শুরু করে। তারা যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন মোতাহার হোসেন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাংলাকে উর্দু হরফে লেখা ও ধর্মীয় বিবেচনায় রবীন্দ্রবিরোধী কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। সে সময় তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি তুলেছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন। তৎকালে একজন স্বনামখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে তার সুখ্যাতি ছিল। বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ পি সি মহলানবিশের সান্নিধ্যে থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ চালু করার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
সর্বোপরি কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের দীপ্তিমান মনীষা। তার জ্ঞানচর্চা, যুক্তিবাদ, মানবিকতা ও প্রগতিশীল চিন্তাধারা নতুন প্রজন্মের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। আমাদের জন্য তার অবদান আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং অনুপ্রেরণাদায়ী।